leadT1ad

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

তদন্ত কমিশনের জবানবন্দির সমন যেভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

প্রতিবেদনে জয়নুল আবেদীন লিখেছেন, ‘কমিশন আন্তরিকভাবে জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ধারাবাহিক অস্বীকৃতির মুখে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৫, ০১: ১৬
শেখ হাসিনা। সংগৃহীত ছবি

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার তদন্তে গঠিত বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধান কমিশনের কাছে জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও দলটির শীর্ষ নেতারা।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট গঠিত এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনের এক প্রতিবেদনে এই অস্বীকৃতির বিবরণ উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে জয়নুল আবেদীন লিখেছেন, ‘কমিশন আন্তরিকভাবে জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ধারাবাহিক অস্বীকৃতির মুখে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’

জয়নুল আবেদীন জানান, হামলার সাত দিন পর তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানার জন্য ও তাঁর ব্যবহৃত গাড়িটি পরিদর্শন করতে তাঁর বাসভবনে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কমিশনের কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের অনীহার কারণে চিঠিটি হস্তান্তর করতে পারেননি।

এরপর একই অনুরোধ জানিয়ে ২০০৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর আরেকটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু সেটিও কোনো জবাব পায়নি বলে দাবি করেন তিনি।

জয়নুল আবেদীন আরও জানান, তিনি একাধিকবার ফোন করে দলের সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে সাক্ষাতের অনুরোধ জানান। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ জলিলকে এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করা হয়। তখন তিনি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন। তিন দিন পর এম এ জলিল কমিশনের এক সচিবকে টেলিফোনে জানান যে শেখ হাসিনার সঙ্গে কমিশনের সাক্ষাৎ সম্ভব নয়। তবে কমিশন চাইলে গাড়িটি পরিদর্শন করতে পারবে।

জয়নুল আবেদীন দাবি করেন, তিনি আবারও হাসিনার বাসভবন ‘সুধা সদন’-এ একটি চিঠি পাঠান। কিন্তু শেখ হাসিনার বাসার কর্মীদের অসহযোগিতার কারণে এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

জয়নুল আবেদীনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মীদের কাছেও অনুরূপ চিঠি পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু কোনো সাড়া পাননি।

২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে উইকিলিকস-এ প্রকাশিত একটি মার্কিন গোপন তারবার্তায়ও এই প্রসঙ্গ উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, দুই দিন আগে ঢাকায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তৎকালীন ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি টর্কেল প্যাটারসন ও তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরীর মধ্যে বৈঠক হয়েছিল।

ওই বৈঠকে প্যাটারসন জোর দিয়ে বলেন, একটি সরকারের দায়িত্ব তার নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া ও বিরোধী দলের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা। এ জন্য রাজনৈতিক ভেদাভেদ পাশে রেখে এই অপরাধের সমাধানে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু শমসের মবিন চৌধুরী সেই আহ্বান এড়িয়ে যান। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে একমত প্রকাশ করে তিনি দোষ চাপান আওয়ামী লীগের ওপর। তিনি বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে শেখ হাসিনার অস্বীকৃতি জানানোই প্রমাণ করে তারা (আওয়ামী লীগ) তদন্তে সহযোগিতা করছে না।

বিএনপি এই হামলার সঙ্গে জড়িত নয় দাবি করে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, কোনো সরকার এতটা বোকা নয় যে নিজেদের ওপরই এ ধরনের হামলা চালাবে।

তারবার্তায় উপসংহারে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ‘তদন্তে অক্ষমতার ব্যাখ্যা দিতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে।’ সরকার আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করেছে, ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’র কথা বলছে, এমনকি ভারতের দিকে আঙুল তুলেছে কিন্তু এর কোনোটিরই প্রমাণ দিতে পারেনি।

হামলার পরপরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন।

সেই সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রতিহত করতে’ খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ না করে চিঠি লিখে সহযোগিতা চেয়েছিলেন।

রাত ১০টা ৫০ মিনিটে খালেদার দূতেরা সুধা সদনের কাছাকাছি পৌঁছালেও ছাত্রলীগ কর্মীদের তীব্র প্রতিবাদের কারণে তারা চিঠি হস্তান্তর করতে পারেননি।

এর আগে, গোয়েন্দাদের কাছ থেকে শেখ হাসিনার ধানমন্ডির বাসভবনে সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্কবার্তা পাওয়ার পর খালেদা জিয়া তার সফর বাতিল করেন।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা খালেদার সম্ভাব্য সফরকে ‘প্রহসন ও জনগণের মনোযোগ সরানোর চেষ্টা’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন।

অগ্রগতি থেমে যায়

২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে থমাস এবং সাবেক সেনাপ্রধান ও আওয়ামী লীগের প্রাক্তন মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নুরুদ্দীন খানের মধ্যে একটি বৈঠক নিয়েও উইকিলিকসে তথ্য উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, ‘তিনি অভিযোগ করেন, ২১ আগস্ট হামলার পর শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে ভুল পদক্ষেপ নেন। স্বাধীন তদন্তের দাবি না তুলে ধারাবাহিক হরতাল ডেকে সরকার পতনের চেষ্টা করেন।’

তাঁর মতে, এ কারণেই হাসিনা জনসমর্থন হারান এবং তৎকালীন সরকার আর অপরাধ সমাধানে তাগিদ অনুভব করেনি।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা বিশ্বাস করতেন, বিএনপিই এই হামলার পেছনে রয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।

হামলার এক বছর পরও ন্যায়বিচার চেয়ে শেখ হাসিনার জোরালো দাবি বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে দিশেহারা করে তুলেছিল।

ওই সময়ে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধেও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে দলটি সব অভিযোগ অস্বীকার করে।

জল্পনা চলতেই থাকে, কিন্তু জনগণের সামনে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত