এশিয়ায় আস্থা হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। একসময় এশীয় মিত্ররা তাকে অনুসরণ করত। কারণ যুক্তরাষ্ট্র গায়ের জোরে নয়, মন জয় করে নেতৃত্ব দিত। নিরাপত্তা দিত, বাজার উন্মুক্ত করত এবং এমন প্রতিষ্ঠান গড়ত যেখানে অন্যরা স্বেচ্ছায় যোগ দিতে চাইত। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব বৈধতা পেত। কিন্তু আজ যুক্তরাষ্ট্র নিজ হাতে তাদের সেই ঐতিহ্য দুর্বল করে দিচ্ছে।
স্ট্রিম ডেস্ক
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ নাই বলেন, সফল নেতৃত্ব কেবল জোর খাটিয়ে অর্জন করা যায় না। এর জন্য দরকার সফট পাওয়ার। কথা ও কাজের মিল, বিশ্বাসযোগ্যতা আর পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে রাজি করানোর ক্ষমতাই নেতৃত্বের মূল শক্তি।
যুক্তরাষ্ট্র আগে এটা বুঝত। গায়ের জোরে নয়, মন জয় করে নেতৃত্ব দিত। নিরাপত্তা দিত, বাজার উন্মুক্ত করত। এমন প্রতিষ্ঠান গড়ত যেখানে অন্যরা স্বেচ্ছায় যোগ দিতে চাইত। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব বৈধতা পেত। একে অনেক সময় বলা হতো “আমন্ত্রণভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদ।”
কিন্তু আজ যুক্তরাষ্ট্র নিজ হাতে তাদের সেই ঐতিহ্য দুর্বল করে দিচ্ছে। সহযোগীদের পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বোঝানোর বদলে এখন চাপ, হুমকি ও লেনদেনের ওপর বেশি নির্ভর করছে।
এমনকি মিত্রদের প্রকাশ্যে “কৃতঘ্ন” বলেও কটাক্ষ করছে। অভিযোগ তুলছে, মিত্ররা বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যয় যথেষ্টভাবে বহন করছে না। নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিকে এখন দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুদের ওপরও হঠাৎ শুল্ক আরোপ করছে।
ফলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই চীনের কাজ সহজ করে দিচ্ছে। এশিয়াকে অভ্যন্তরীণভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং নিজেদের মধ্যে নতুন সমঝোতার ভিত্তি খুঁজতে বাধ্য করছে।
এশিয়ার সবাই চীনের শিকারি আচরণ দেখে। কিন্তু অস্বস্তিকর সত্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রও ক্রমে যেন একধরনের দমনকারী শক্তির মতো আচরণ করছে। ফলে তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও সতর্ক হয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র নিজ স্বার্থে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে এখন আর তার কথা নেতৃত্বের মতো শোনায় না। এতে মিত্ররা অনিশ্চয়তার আতঙ্ক অনুভব করছে। তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র আর নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা রক্ষা করতে পারবে না। বরং মনে হচ্ছে, ক্ষমতাহীন এক শক্তি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সে আর আগের মতো নেতৃত্ব দিতে পারছে না।
দায়িত্বের ভাগ অন্যদেরও নিতে বলাটা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বলার ভঙ্গিটা এমন যে তা অহংকার প্রকাশ পায়, আর তা মিত্রদের জাতীয় অহমে আঘাত করে।
পরাশক্তি নিয়ে কাজ করেন, এমন একজন বিশ্লেষক সতর্ক করে বলেছেন, ‘ক্ষমতাধারী রাষ্ট্রগুলোকে সহানুভূতি দেখাতে হবে, থাকতে হবে ন্যায়ের পক্ষে। উদীয়মান শক্তিগুলোর মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার বিষয়ে আন্তরিকতা দেখাতে হবে।’ ওয়াশিংটন এর আগেও একবার একথা ভুলে গিয়েছিল। এজন্য তাকে চড়া মাশুলও দিতে হয়।
১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর জাপানের হামলার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল তেল নিষেধাজ্ঞা। তবে এর গভীরতর শিকড়ে ছিল বর্ণবাদ ও বৈষম্য। ১৯১৯ সালের ভার্সাই শান্তি সম্মেলনে জাপানকে একটি পরাশক্তি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবুও তাদের প্রকাশ্যে উপেক্ষা করা হয়।
সে সময় ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্লেমাঁসো অবমাননাকর মন্তব্য করেন, ‘ভাবুন তো, দুনিয়ায় স্বর্ণকেশী নারীরা আছে; আর আমরা এখানে এই কুৎসিত জাপানিদের সঙ্গে আটকে আছি।’ এ ছাড়া জাপানের প্রস্তাবিত জাতিগত সমতার ধারা বিষয়টিকে বিনা আলোচনায় প্রত্যাখ্যান করা হয়। ‘কাউন্সিল অব ফোর’ গঠন করা হলে জাপানকে সেখানেও রাখা হয়নি।
এই অবজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় ১৯২৪ সালের অভিবাসন আইনের মাধ্যমে। সেখানে এশীয়দের ‘নাগরিকত্বের অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট উইলসনের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এডওয়ার্ড হাউস ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক করেছিলেন, ‘জাপানকে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। পশ্চিমারা যদি প্রাচ্যে জাপানের প্রভাব মেনে না নেয়, তাহলে একসময় এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।’
কার্ল ফন ক্লজভিতস লিখেছিলেন, ‘যুদ্ধ হলো ভিন্ন পথে রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা।’ সমতা চেয়ে কূটনীতি ও আবেদন ব্যর্থ হলে টোকিও মনে করে, কেবল যুদ্ধই এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে যেখানে তাকে আর অধস্তন শক্তি হিসেবে দেখা হবে না।
সে হিসাব শিগগিরই মিটল—১৯৪১ সালের যুদ্ধে। জাপানি ঔপন্যাসিক সেয়ি ইতো সেই বছরের ডিসেম্বরেই লিখেছিলেন, ‘আমাদের নিয়তি এমন যে, শীর্ষস্থানীয় শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে যুদ্ধ না করলে আমরা পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাব না।’
ইতিহাসবিদ জন ডাওয়ার ব্যাখ্যা করেন, জাপানি নেতারা তাদের যুদ্ধকে এভাবে উপস্থাপন করেছিলেন—তারা নাকি ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে মানচুরিয়াকে রক্ষা করেছে এবং চীনকে আংশিকভাবে ইংরেজ ও আমেরিকান শোষণ থেকে মুক্ত করেছে। আর তাদের পরবর্তী লক্ষ্য ‘পূর্ব এশিয়াকে শ্বেতাঙ্গ আক্রমণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত করা।’
এখান থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলো—একটি উদীয়মান শক্তিকে বারবার মর্যাদা ও সমতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলে, শেষ পর্যন্ত সে নিজেই নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
প্রায় এক শতাব্দী পর একই প্রবণতা আবারও দেখা যাচ্ছে। ‘চায়না ইনিশিয়েটিভ’–এর অধীনে চীনা গবেষক ও শিক্ষাবিদদের ক্রমবর্ধমান যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ ও ভিসা প্রত্যাখ্যানের মুখে পড়তে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কেবল জাতিগত পরিচয়ের জন্য তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে।
সমস্যা হলো, এই আচরণ এখন শুধু চীনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। আমেরিকার এশীয় মিত্রদের ওপরও এর প্রভাব পড়ছে।
২০২৫ সালে কোরিয়ান বংশোদ্ভূত এক পিএইচডি শিক্ষার্থীকে সান ফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় আটকে রাখা হয়। অথচ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের স্থায়ী বাসিন্দা। তার বৈধ কাগজপত্রও ছিল।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জাপানি নাগরিকরাও একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। এমনকি সাধারণ পর্যটক ও হাওয়াই ভ্রমণকারী তরুণীরাও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে পারেননি। অভিবাসন কর্মকর্তারা অস্পষ্ট ‘সন্দেহ’ দেখিয়ে ইচ্ছেমতো নিয়ম প্রয়োগ করে এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দক্ষিণ কোরীয় ও জাপানিদের কাছে ওয়াশিংটনের এই নির্বিচার কড়াকড়ি এক স্পষ্ট বার্তা বহন করছে। তা হলো, জাতিগত পরিচয় এখনো গুরুত্বপূর্ণ। এই আচরণ যেন ১৯২৪ সালের সেই পুরোনো বার্তাকেই ফিরিয়ে আনছে—এশীয়দের কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাস বা গ্রহণ করা হবে না।
আজকের আঞ্চলিক উত্তেজনার প্রধান কারণ বর্ণবাদ নয়। তবু এশিয়াকে আবারও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারা কখনোই সমান মর্যাদা পাবে না। একে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে বেইজিং।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পররাষ্ট্র কমিশনের প্রধান ওয়াং ই বলেছেন, ‘আমেরিকানরা চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকে আসা সবাইকে কেবল এশীয় হিসেবেই দেখে। কোনও পার্থক্য করে না। ইউরোপেও একই অবস্থা। আপনি যতই চুল সোনালি রং আর নাক ধারালো করুন না কেন, আপনি ইউরোপীয় বা আমেরিকান হতে পারবেন না। পশ্চিমাদের মতো হতে পারবেন না।’
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের অধিকাংশ মানুষ এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে। তবে ক্রমেই অনেকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে—বেইজিং কি ভুল বলছে, নাকি অস্বস্তিকর সত্য তুলে ধরছে?
নতুন এশীয় জোটবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। এর কারণ চীনের কোনো আকর্ষণীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্রকে আর আত্মবিশ্বাসী ও নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে না দেখা।
গত ১৬ আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রে এক জাপানি রাজনীতি বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। তিনি সতর্ক করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়েই দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের বিকল্প নিরাপত্তা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করা উচিত।
কারণ, ভবিষ্যতের ট্রাম্প প্রশাসন উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমিয়ে দিতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণশীল নীতিনির্ধারকেরাও খোলাখুলি যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছেন।
টোকিও গোপনে বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ পুনরায় শুরু করেছে। কোনো সমীহ থেকে নয়, বরং নিজেদের রক্ষার জন্য।
এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং রিজিওনাল কমপ্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ-এর মতো চীনের সহায়তাপ্রাপ্ত উদ্যোগগুলোতেও আঞ্চলিক অংশগ্রহণ বাড়ছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক-এর প্রতি আগ্রহ কমছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই এই নতুন জোটবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। এশিয়া এমন কারণে দূরে সরে যাচ্ছে না যে তারা চীনের কর্তৃত্ববাদ পছন্দ করে। বরং তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তির সঙ্গে থেকে ক্রমাগত অসম্মানিত বোধ করছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের সঙ্গে মুখে মুখে সমান অংশীদারের ভাষায় কথা বললেও তাদের অধস্তন হিসেবে দেখে।
এশিয়া এখনও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু তারা আর যুক্তরাষ্ট্রকে অন্ধভাবে অনুসরণ করবে না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এখনও আমেরিকার হাতে। তবে সময় এখন তার পক্ষে নেই।
(এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত হানজিন লিউ ও জিও লিউর লেখা অবলম্বনে)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ নাই বলেন, সফল নেতৃত্ব কেবল জোর খাটিয়ে অর্জন করা যায় না। এর জন্য দরকার সফট পাওয়ার। কথা ও কাজের মিল, বিশ্বাসযোগ্যতা আর পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে রাজি করানোর ক্ষমতাই নেতৃত্বের মূল শক্তি।
যুক্তরাষ্ট্র আগে এটা বুঝত। গায়ের জোরে নয়, মন জয় করে নেতৃত্ব দিত। নিরাপত্তা দিত, বাজার উন্মুক্ত করত। এমন প্রতিষ্ঠান গড়ত যেখানে অন্যরা স্বেচ্ছায় যোগ দিতে চাইত। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব বৈধতা পেত। একে অনেক সময় বলা হতো “আমন্ত্রণভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদ।”
কিন্তু আজ যুক্তরাষ্ট্র নিজ হাতে তাদের সেই ঐতিহ্য দুর্বল করে দিচ্ছে। সহযোগীদের পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বোঝানোর বদলে এখন চাপ, হুমকি ও লেনদেনের ওপর বেশি নির্ভর করছে।
এমনকি মিত্রদের প্রকাশ্যে “কৃতঘ্ন” বলেও কটাক্ষ করছে। অভিযোগ তুলছে, মিত্ররা বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যয় যথেষ্টভাবে বহন করছে না। নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিকে এখন দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুদের ওপরও হঠাৎ শুল্ক আরোপ করছে।
ফলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই চীনের কাজ সহজ করে দিচ্ছে। এশিয়াকে অভ্যন্তরীণভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং নিজেদের মধ্যে নতুন সমঝোতার ভিত্তি খুঁজতে বাধ্য করছে।
এশিয়ার সবাই চীনের শিকারি আচরণ দেখে। কিন্তু অস্বস্তিকর সত্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রও ক্রমে যেন একধরনের দমনকারী শক্তির মতো আচরণ করছে। ফলে তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও সতর্ক হয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র নিজ স্বার্থে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে এখন আর তার কথা নেতৃত্বের মতো শোনায় না। এতে মিত্ররা অনিশ্চয়তার আতঙ্ক অনুভব করছে। তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র আর নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা রক্ষা করতে পারবে না। বরং মনে হচ্ছে, ক্ষমতাহীন এক শক্তি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সে আর আগের মতো নেতৃত্ব দিতে পারছে না।
দায়িত্বের ভাগ অন্যদেরও নিতে বলাটা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বলার ভঙ্গিটা এমন যে তা অহংকার প্রকাশ পায়, আর তা মিত্রদের জাতীয় অহমে আঘাত করে।
পরাশক্তি নিয়ে কাজ করেন, এমন একজন বিশ্লেষক সতর্ক করে বলেছেন, ‘ক্ষমতাধারী রাষ্ট্রগুলোকে সহানুভূতি দেখাতে হবে, থাকতে হবে ন্যায়ের পক্ষে। উদীয়মান শক্তিগুলোর মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার বিষয়ে আন্তরিকতা দেখাতে হবে।’ ওয়াশিংটন এর আগেও একবার একথা ভুলে গিয়েছিল। এজন্য তাকে চড়া মাশুলও দিতে হয়।
১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর জাপানের হামলার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল তেল নিষেধাজ্ঞা। তবে এর গভীরতর শিকড়ে ছিল বর্ণবাদ ও বৈষম্য। ১৯১৯ সালের ভার্সাই শান্তি সম্মেলনে জাপানকে একটি পরাশক্তি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবুও তাদের প্রকাশ্যে উপেক্ষা করা হয়।
সে সময় ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্লেমাঁসো অবমাননাকর মন্তব্য করেন, ‘ভাবুন তো, দুনিয়ায় স্বর্ণকেশী নারীরা আছে; আর আমরা এখানে এই কুৎসিত জাপানিদের সঙ্গে আটকে আছি।’ এ ছাড়া জাপানের প্রস্তাবিত জাতিগত সমতার ধারা বিষয়টিকে বিনা আলোচনায় প্রত্যাখ্যান করা হয়। ‘কাউন্সিল অব ফোর’ গঠন করা হলে জাপানকে সেখানেও রাখা হয়নি।
এই অবজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় ১৯২৪ সালের অভিবাসন আইনের মাধ্যমে। সেখানে এশীয়দের ‘নাগরিকত্বের অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট উইলসনের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এডওয়ার্ড হাউস ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক করেছিলেন, ‘জাপানকে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। পশ্চিমারা যদি প্রাচ্যে জাপানের প্রভাব মেনে না নেয়, তাহলে একসময় এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।’
কার্ল ফন ক্লজভিতস লিখেছিলেন, ‘যুদ্ধ হলো ভিন্ন পথে রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা।’ সমতা চেয়ে কূটনীতি ও আবেদন ব্যর্থ হলে টোকিও মনে করে, কেবল যুদ্ধই এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে যেখানে তাকে আর অধস্তন শক্তি হিসেবে দেখা হবে না।
সে হিসাব শিগগিরই মিটল—১৯৪১ সালের যুদ্ধে। জাপানি ঔপন্যাসিক সেয়ি ইতো সেই বছরের ডিসেম্বরেই লিখেছিলেন, ‘আমাদের নিয়তি এমন যে, শীর্ষস্থানীয় শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে যুদ্ধ না করলে আমরা পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাব না।’
ইতিহাসবিদ জন ডাওয়ার ব্যাখ্যা করেন, জাপানি নেতারা তাদের যুদ্ধকে এভাবে উপস্থাপন করেছিলেন—তারা নাকি ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে মানচুরিয়াকে রক্ষা করেছে এবং চীনকে আংশিকভাবে ইংরেজ ও আমেরিকান শোষণ থেকে মুক্ত করেছে। আর তাদের পরবর্তী লক্ষ্য ‘পূর্ব এশিয়াকে শ্বেতাঙ্গ আক্রমণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত করা।’
এখান থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলো—একটি উদীয়মান শক্তিকে বারবার মর্যাদা ও সমতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলে, শেষ পর্যন্ত সে নিজেই নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
প্রায় এক শতাব্দী পর একই প্রবণতা আবারও দেখা যাচ্ছে। ‘চায়না ইনিশিয়েটিভ’–এর অধীনে চীনা গবেষক ও শিক্ষাবিদদের ক্রমবর্ধমান যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ ও ভিসা প্রত্যাখ্যানের মুখে পড়তে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কেবল জাতিগত পরিচয়ের জন্য তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে।
সমস্যা হলো, এই আচরণ এখন শুধু চীনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। আমেরিকার এশীয় মিত্রদের ওপরও এর প্রভাব পড়ছে।
২০২৫ সালে কোরিয়ান বংশোদ্ভূত এক পিএইচডি শিক্ষার্থীকে সান ফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় আটকে রাখা হয়। অথচ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের স্থায়ী বাসিন্দা। তার বৈধ কাগজপত্রও ছিল।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জাপানি নাগরিকরাও একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। এমনকি সাধারণ পর্যটক ও হাওয়াই ভ্রমণকারী তরুণীরাও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে পারেননি। অভিবাসন কর্মকর্তারা অস্পষ্ট ‘সন্দেহ’ দেখিয়ে ইচ্ছেমতো নিয়ম প্রয়োগ করে এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দক্ষিণ কোরীয় ও জাপানিদের কাছে ওয়াশিংটনের এই নির্বিচার কড়াকড়ি এক স্পষ্ট বার্তা বহন করছে। তা হলো, জাতিগত পরিচয় এখনো গুরুত্বপূর্ণ। এই আচরণ যেন ১৯২৪ সালের সেই পুরোনো বার্তাকেই ফিরিয়ে আনছে—এশীয়দের কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাস বা গ্রহণ করা হবে না।
আজকের আঞ্চলিক উত্তেজনার প্রধান কারণ বর্ণবাদ নয়। তবু এশিয়াকে আবারও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারা কখনোই সমান মর্যাদা পাবে না। একে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে বেইজিং।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পররাষ্ট্র কমিশনের প্রধান ওয়াং ই বলেছেন, ‘আমেরিকানরা চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকে আসা সবাইকে কেবল এশীয় হিসেবেই দেখে। কোনও পার্থক্য করে না। ইউরোপেও একই অবস্থা। আপনি যতই চুল সোনালি রং আর নাক ধারালো করুন না কেন, আপনি ইউরোপীয় বা আমেরিকান হতে পারবেন না। পশ্চিমাদের মতো হতে পারবেন না।’
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের অধিকাংশ মানুষ এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে। তবে ক্রমেই অনেকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে—বেইজিং কি ভুল বলছে, নাকি অস্বস্তিকর সত্য তুলে ধরছে?
নতুন এশীয় জোটবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। এর কারণ চীনের কোনো আকর্ষণীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্রকে আর আত্মবিশ্বাসী ও নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে না দেখা।
গত ১৬ আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রে এক জাপানি রাজনীতি বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। তিনি সতর্ক করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়েই দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের বিকল্প নিরাপত্তা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করা উচিত।
কারণ, ভবিষ্যতের ট্রাম্প প্রশাসন উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমিয়ে দিতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণশীল নীতিনির্ধারকেরাও খোলাখুলি যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছেন।
টোকিও গোপনে বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ পুনরায় শুরু করেছে। কোনো সমীহ থেকে নয়, বরং নিজেদের রক্ষার জন্য।
এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং রিজিওনাল কমপ্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ-এর মতো চীনের সহায়তাপ্রাপ্ত উদ্যোগগুলোতেও আঞ্চলিক অংশগ্রহণ বাড়ছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক-এর প্রতি আগ্রহ কমছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই এই নতুন জোটবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। এশিয়া এমন কারণে দূরে সরে যাচ্ছে না যে তারা চীনের কর্তৃত্ববাদ পছন্দ করে। বরং তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তির সঙ্গে থেকে ক্রমাগত অসম্মানিত বোধ করছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের সঙ্গে মুখে মুখে সমান অংশীদারের ভাষায় কথা বললেও তাদের অধস্তন হিসেবে দেখে।
এশিয়া এখনও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু তারা আর যুক্তরাষ্ট্রকে অন্ধভাবে অনুসরণ করবে না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এখনও আমেরিকার হাতে। তবে সময় এখন তার পক্ষে নেই।
(এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত হানজিন লিউ ও জিও লিউর লেখা অবলম্বনে)
গত ৫ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত জেনেভাতে অনুষ্ঠিত হলো গ্লোবাল প্লাস্টিক চুক্তির ৬ষ্ঠ বৈঠক। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে এই সম্মেলন। অথচ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ থেকে শুরু করে মাউন্ট এভারেস্ট—প্লাস্টিক দূষণ পৌঁছে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চলে।
১৭ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি বিনা অনুমতিতে রাষ্ট্রের ‘সংবেদনশীল’ তথ্য প্রকাশের অভিযোগে পুলিশ কনস্টেবল অমি দাশকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজের ওয়াকিটকি বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
১ দিন আগেসাম্প্রতিক প্রবণতায় এর উত্তর পাওয়া যাবে। তালেবানের সঙ্গে গোপন আলোচনা থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে আড়ালে চলা সমঝোতা—সব জায়গাতেই এই ছোট্ট উপসাগরীয় দেশটি বিশ্বে মধ্যস্থতার অন্যতম নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হয়ে উঠছে। এর পেছনে রয়েছে তাদের বিপুল অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও কৌশলগত অস্পষ্ট অবস্থান।
২ দিন আগেপৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক অবস্থা গঠনের সময় ইন্ডিয়ান প্লেটের সঙ্গে ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষ হয়। কয়েক কোটি বছর আগের ওই ঘটনায় বর্তমান হিমালয় পর্বতশ্রেণির সৃষ্টি। ওই সময়ই সিলেটের জাফলংয়ের ডাউকি নদীর পূর্ব তীরে বিশাল আকারের পাথররাজি মাটির ওপরে উঠে আসে।
২ দিন আগে