leadT1ad

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত /হতাহতদের পরিবারে উৎকণ্ঠা, ট্রমা কাটাতে কাউন্সেলিংয়ে জোর বিশেষজ্ঞদের

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
ওয়ার্ডে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা চলছে, দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছেন উৎকণ্ঠিত স্বজনেরা। স্ট্রিম ছবি

উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রিশাদ সালেহীন। রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পঞ্চম তলায় মেঝেতে বসে আছে সে। পাশে দুই বন্ধু তাঁকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। কথোপকথনে বোঝা গেলো, রিশাদ তাঁর ছোট বোনকে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। বন্ধুরা তাঁকে মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার কথাই বলছিল।

জানা গেলো, বিমান বিধ্বস্তের সময় রিফাতদের ক্লাস চলছিল। সোয়া ১টার দিকে যখন বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, তখন তাঁরা সবাই ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে আসে। রিশাদ তখন দৌড়ে দুর্ঘটনাস্থলের কাছে যান। তাঁর বোন ওই ভবনেই ছিল। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে। ওইদিন ক্লাস শেষে কোচিং করছিল রিশাদের বোন আলভিরা।

বিমান বিধ্বস্তের কিছুক্ষণ পর আলভিরাকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর নেওয়া হয় হাসপাতালে। গত মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ছিল সে। এখন সে আছে ৫২০ নম্বর কক্ষে।

রিশাদের পরিবার থাকে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের খালপাড় এলাকায়। তাঁর বোনের শরীরের ৮ শতাংশ পুড়ে গেছে।

এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিশুদের স্কুলে ফেরানো। যেখানে শিশু দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাত সেখানে তাদের ফেরাতেই হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে। স্কুলে এনে জোর দিতে হবে সনাতন লেখাপড়ায় নয়, বরং খেলাধুলা, গান বাজনা, ছবি আঁকা, বন্ধুদের সাথে কথা বলে সময় কাটানো, চড়ুইভাতি ইত্যাদি কাজে। গওহার নঈম ওয়ারা, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব, ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরাম

রিশাদের ভাষ্য, বিমানটি যখন বিধ্বস্ত হয় তখন আমাদের ক্লাস প্রায় শেষ। বোনের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, চিন্তা হয়। ভেতরে গিয়ে ওর মুখের দিকে আর তাকাতে পারি না। কিছু লাগলে বাইরে থেকে নিয়ে আসছি। আর এখানে অপেক্ষা করছি।

একটু পাশেই রাসেল আহমেদ নামে আরেকজন ব্যক্তিকে দেখা গেলো। তিনি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ক্যাম্পাসের কলেজ শাখার শিক্ষক। তাঁর চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে রাইসা দিয়াবাড়িতে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়েছে। এতে তাঁর মুখের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। এই বাবার চিন্তা হলো— মেয়ের চেহারা আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা, সেটি নিয়ে।

রিশাদ ও রাসেলের মতোই মানসিক অবস্থা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অন্য হতাহতদের স্বজনদেরও। এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী ও তাঁর স্বজন এবং প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের জন্য ট্রমা কাউন্সেলিংয়ের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাঁরা বলছেন, শিশুর মানসিক অবস্থা বোঝা ও মোকাবিলায় সকলেরই সচেতন হতে হবে। সাইকোলজিস্টের মাধ্যমে মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করানো প্রয়োজন। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শও দেন তাঁরা।

ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব গওহার নঈম ওয়ারা অবশ্য তথাকথিত কাউন্সিলিংয়ের আগে অন্য ‘হিলিং প্রসেস’-এর দিকে মনযোগী হওয়ার কথা বলছেন।

তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিশুদের স্কুলে ফেরানো। যেখানে শিশু দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাত সেখানে তাদের ফেরাতেই হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে। স্কুলে এনে জোর দিতে হবে সনাতন লেখাপড়ায় নয়, বরং খেলাধুলা, গান বাজনা, ছবি আঁকা, বন্ধুদের সাথে কথা বলে সময় কাটানো, চড়ুইভাতি ইত্যাদি কাজে।’

গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘এসবের মধ্যে দিয়ে তাদের মনটা থিতু হলে আস্তে আস্তে পড়াশোনা-পরীক্ষার মতো কাজে হাত দেওয়া যাবে। মা-বাবাকেও স্কুলে আসতে দিতে হবে। তাঁদেরকেও নানাভাবে মানসিক সহযোগিতা দিতে হবে। দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে নয়, অন্য প্রসঙ্গে তাদের সাথে আলাপ করবেন শিক্ষকেরা। যেমন : প্যারেন্টিং, রান্নার মতো বিষয়। এছাড়া আমাদের সফল নারী ও পুরুষ, ফুটবল ও ক্রিকেট দল, তাঁরা স্কুলে শিশুদের সাথে খেলতে আসতে পারে। তবে তার আগে সেলিব্রেটিদের একটা ওরিয়েন্টেশন দিতে হবে।’

এছাড়া দুর্ঘটনার ছবি বা ঘটনার দৃশ্যায়ন থেকে শিশুদের দূরে রাখার পরামর্শও দেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলছেন, এই হতাহতদের পরিবার ও রোগীদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করতে হবে। শুধু এখনই নয়, ভবিষ্যতে তাঁদের মানসিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি স্ট্রিমকে বলেন, মানসিক দিকটা নিয়ে মোটাদাগে দেশের কারোই কোনো চিন্তা নেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ চিন্তা করছে না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঘটনার পরও মানসিক সেবার ঘাটতির বিষয়টি আমরা দেখেছি। এখন সরকারকে কো-অর্ডিনেট করতে হবে ভবিষ্যতে যাতে ভুক্তভোগীদের এই সেবাটা দেওয়া যায়। কারণ, পরবর্তীতে অনেকের চেহারায় দগ্ধ ও ক্ষতের ছাপ দেখা যেতে পারে। তখন এই সেবা প্রয়োজন হবে।

ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রধান ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইসমত জাহান হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে অভিভাবকদের মানসিক অবস্থা বোঝা ও কাউন্সেলিংয়ের চেষ্টা করছেন। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, এমন দুর্ঘটনার পর ভুক্তভোগীদের প্রথমে ট্রমা হিলিং প্রসেসে নিয়ে আসা প্রয়োজন, তাঁরা যাতে ট্রমাটাইজ না হয়।

তাঁর মতে, যারা অগ্নিদগ্ধ হয়েছে বর্তমানে তো বটেই সামনেও দীর্ঘ একটা সময় তাঁদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ভুগতে হবে। তবে তাঁদের ও পরিবারের সদস্যদের এই সময়টাতে শক্ত রাখতে হবে। তাঁদের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়েছে। সে জায়গায় আশ্বস্ত করতে হবে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে হাসপাতালগুলোতে রোগী ও স্বজনদের কাউন্সেলিংয়ের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন সদস্যের এ কমিটিতে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, হাসপাতাল সমাজসেবা কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের একজন করে সহ-সমাজসেবা কর্মকর্তা রয়েছেন।

ইসমত জাহান বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটে আমরা রোগীদের সঙ্গে কাজ করতে পারছি না। যেহেতু, তাঁদের কাছে গেলে ইনফেকশনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তবে আমরা তাঁদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছি। অন্য হাসপাতালে রোগীদের মানসিক সেবাও দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সামনের দিনে এই রোগী ও তাঁর পরিবারসহ শিক্ষকদেরও মানসিক কাউন্সেলিং জরুরি। এজন্য সমাজসেবা এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

তাঁর পরামর্শ হলো— ট্রমা তৈরি করতে পারে এ ধরনের ছবি ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এ ধরনের ছবি ও ভিডিও অনেকের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। অর্থাৎ, পরোক্ষ ট্রমা তৈরি হতে পারে। আর রোগীর আপনজনদের উচিত তাঁদের জন্য কমফোর্টের জায়গা তৈরি করা, মন দিয়ে তাঁদের কথা শোনা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত