যেভাবে তিনি তরুণদের প্রভাবিত করলেন
আজ বাংলাদেশের স্বাধীন বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার মৃত্যুদিন। মৃত্যুর এত দিন পরও কেন তিনি এতটা প্রাসঙ্গিক? তরুণ সমাজ কেন তাঁর চিন্তা ধারণ করে, তাঁকে নিয়ে কথা বলে?—এই মনীষীর প্রয়াণ দিবসে এসব প্রশ্নের তত্ত্ব-তালাশ।
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ
আহমদ ছফা। অকৃতদার, একগুঁয়ে, বোহেমিয়ান এই মানুষকে নিয়ে সিকি শতাব্দী পরেও আমাদের মধ্যে একটা দারুণ উত্তেজনা বিরাজ করে। আমরা যাঁরা এখন চল্লিশ পেরোনো—চালশে, যাঁরা ছফাকে সামনাসামনি তেমন করে পাইনি, কিন্তু একটা লম্বা সময় ছফায় বুঁদ ছিলাম, তাঁরা কেন ছফা নিয়ে উচ্চকিত? কেন এখনো এতটা প্রাসঙ্গিক তিনি?
আহমদ ছফার অনেকগুলো সত্তা। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা চিন্তক তিনি। তিনি যে শুধু চিন্তা করতেন আর লিখতেন তাই না, সেসব বাস্তবায়নের জন্য রীতিমতো মাঠে নেমে পড়তেন। নিজের চিন্তা আর কাজের সমন্বয়ে ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ ছফা যেন কার্ল মার্ক্সের সেই কথাকেই সত্য বলে প্রতিপন্ন করতে চাইতেন, দার্শনিকেরা দুনিয়ার অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছে, এখন সময় পরিবর্তনের। তাই একসময় তিনি গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ লেখক শিবির। তুলে এনেছিলেন চিত্রকর এসএম সুলতানকে।
স্বাধীন বাংলাদেশে হেন কোনো যৌক্তিক আন্দোলন নেই, যেখানে ছফার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল না। এই আহমদ ছফাই আবার ভাবালু। লিখছেন ‘পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ’-এর মতো অন্যবদ্য বই, যেখানে পরম মমতা আর অসীম ভালোবাসায় উঠে এসেছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বন্ধন ও সম্পর্ক। পুরো বইয়ে কী যে মায়া! এখানে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর দার্শনিক, প্রতিবাদী আর বোহেমিয়ান সত্তা।
তবে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ আর ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ লিখে একাধিক প্রজন্মকে চিন্তার খোরাক জুগিয়েছেন আহমদ ছফা। বাংলাদেশের রাজনীতি আর ‘সুশীল সমাজ’-এর ফাঁকফোকরগুলো দেখিয়েছেন যুক্তি আর বিপুল ক্রোধে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে সেই সময়ের শাসকদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছিলেন ছফা। আর তাঁর এই খড়গহস্ত হওয়ার পেছনে যথার্থ কার্যকারণ যে ছিল, ইতিহাসই সে সাক্ষ্য দেয়।
আবার বিগত বছরগুলোতে আমাদের দেশ যে স্বৈরশাসনের ছায়ায় ছিল, এ সময় বেঁচে থাকলে কেমন হতো ছফার ভূমিকা? কী করতেন তিনি?
কথাটি নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো, আহমদ ছফা সম্ভবত জনপ্রিয় ফেসবুকার হতেন। তাঁর একেকটা নাতিদীর্ঘ কিন্তু সরল ভাষায় লেখা স্ট্যাটাসের জন্য হয়তো উন্মুখ হয়ে থাকতেন এখনকার তরুণেরা। বিভিন্ন লেখাজোকায় প্রায়ই সুবিধাভোগী শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের দিকে ছুটে যেত তাঁর কটাক্ষের তীর। ছাড় দিতেন না ক্ষমতাসীনদেরও—সে যে দলই হোক না কেন। তবে এর চেয়েও জরুরি যে কাজ ছফা সবসময় করেছেন তা হলো, বিপুল সংখ্যক তরুণের সামনে ইতিহাসের এমন কিছু প্রসঙ্গ, এমন কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, যা তাঁদের ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
মোদ্দা কথা হলো, বক্সের বাইরে গিয়ে, প্রগতি-অপ্রগতির খোপ বাঁধা বাইনারির বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি যেমন ভাবতে পারতেন, সেই ভাবনা তাঁর মৃত্যুর এত বছর পর এখন আমাদেরও ভাবায়, উসকানি দেয়। তাই বলতে পারি, এ সময়ে জীবিত থাকলে সময়ের দাবি মেনে ছফা হয়তোবা ইউটিউবার হতেন। ইউটিউবে যুক্তিপূর্ণ আলাপের ফাঁকে ফাঁকে কখনোবা আমরা শুনতে পেতাম তাঁর বাঁশির সুর। পেতাম কি? কোনোদিন হয়তো রাস্তার কুকুর বা গাছ জড়িয়ে ধরে ভিডিও করতেন। জীবদ্দশায় ছফা তো এমনই ছিলেন, তাই না?
এসব ভাবতে ভাবতে মনে হলো, রাগী রাগী একটা চেহারা আমার ঘরে জানালায় উঁকি দিয়ে বলছে, ‘হারামজাদা! ফাজলামি চিন্তা বন্ধ কর। ’তাঁর কথা শুনে ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম, ‘গুরু, টেকনোগ্লোবাল নিউলিবারেল সময়ে আমরা একটু ফিচেল আছি। আর আমাদের ফোকাসের স্প্যানও কম। মাঝেমধ্যে তাই একটু মশকরা না করলে সিরিয়াস আলাপে ঢোকাই দায় হয়ে পড়ে।’
হ্যাঁ, সিরিয়াস আলাপ তো বটেই, বারবার আমরা গণ-অন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান করে বাংলাদেশের ইতিহাস বদলাই। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্রকে বুঝে নেওয়ার দায় আমাদের আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছুকাল পরেই কলমকে খাপখোলা তলোয়ার বানিয়ে ন্যালাখ্যাঁপা আহমদ ছফা লিখেছিলেন ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, খানিক আগেই বইটির নাম নিয়েছি। সে আমলের বুদ্ধিজীবীদের সংকীর্ণ দলান্ধতা এবং নামে বুদ্ধিজীবী হলেও একঘেঁয়ে, চিন্তাহীন আর ক্ষেত্রবিশেষে হীন স্বার্থের বুলি যে কতটা ফাঁপা ও ক্ষতিকর, এ বইয়ের ছত্রে ছত্রে তিনি তা দেখিয়েছিলেন। বাকশালী শাসনের বিরুদ্ধে তিনি যেমন বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিলেন, তেমনি সোচ্চার ছিলেন ধর্মীয় উগ্রপন্থা নিয়েও।
একই কথা খাটে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়েও। আদতে ছফা ছিলেন সেই প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ, যিনি বাংলাদেশের সমাজ ও ইতিহাসকে ভারতের প্রভাববলয় থেকে আলাদা চোখে দেখতেন। কিন্তু কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। বাংলাদেশ-ভারত প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইতিহাসের সূত্র টেনে তিনি বরং যুক্তি দিতেন। আর যুক্তির সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন স্বাধীন বুদ্ধিজীবীর আবেগও।
এ রকম চিন্তা থেকেই আহমদ ছফা লিখেছিলেন ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। এখানে মাদরাসা ছাত্রদের সঙ্গে তথাকথিত ‘প্রগতিশীলদের’দূরত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি দেখিয়েছেন বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিকভাবে পাওয়া হীনমন্যতাও। নিজের লেখায় বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয় এবং কলকাতাকেন্দ্রিক চাপানো পরিচয়—এই দুই বিষয় বিশ্লেষণ করে আমাদের জাতীয় পরিচয় অন্বেষণ করেছেন তিনি।
ছফা চলে যাওয়ার দুই দশক পরে এসব আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা এখন আরও বড় হয়ে উঠেছে। গুরুত্বও বেড়েছে।
ফলে কল্পনা করি যে আহমদ ছফা যদি কোনোক্রমে আরও দুই দশক বেঁচে থাকতেন, তবে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটা দেশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী যখন নীরব ভূমিকা পালন করেছেন, ছফা তখন কথা বলতেন। হাসিনা সরকারের অনাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন।
এ সময় বেঁচে থাকলে আহমদ ছফা যে অনলাইন ও অফলাইনে দাপিয়ে বেড়াতেন, তাতে সন্দেহ সামান্যই। যে ছফা তরুণদের পছন্দ করতেন, তারুণ্যের ভাবনাকে গুরুত্ব দিতেন, গত জুলাইয়ে তরুণেরা যখন ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসককে চোখ রাঙালো, তাঁদের তিনি যে সমর্থন দেবেন, এতে সন্দেহ কী!
সাহিত্যিক হলেও আহমদ ছফা আসলে আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক। তিনি মনে করতেন, কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। গেল শতকের নব্বই দশকের পর থেকে একটা সময় পর্যন্ত এদেশে বিরাজনীতিকরণের ঢেউ উঠেছিল। প্রচলিত বিভিন্ন গণমাধ্যম আর এনজিও—এই দুইয়ে মিলে ‘আই হেইট পলিটিক্স’ প্রজন্ম গড়ে তোলার সূচনা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে ছফার অবস্থান ছিল নিঃসঙ্গ শেরপার মতো।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এখন সোশ্যাল মিডিয়ার প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাওয়ার পরও সেই একই লড়াই আমরা দেখতে পাই। এই মাধ্যমের নানা রকম সীমাবদ্ধতা থাকলেও তথাকথিত মূলধারার নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটা গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার পরিসর হয়ে দাঁড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। এখানে এখন শত শত তরুণ চিন্তক অনেকটা ছফার ভঙ্গিতেই জীর্ণ, ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবিতাকে প্রশ্ন করতে থাকেন।
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে লেখা ছফার বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’তে লেখকের ওস্তাদ আব্দুর রাজ্জাকের ভাষ্য এমন, ‘পড়ার কাজটি অইল অন্যরকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না। আপনার ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইরা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই।’
আহমদ ছফা এই চিন্তার সিলসিলা বহন করেন। আর সিলসিলাটি এখন প্রবাহিত হচ্ছে আমাদের মধ্যে। ফলে আমরা নিজের ভাষায়, আমাদের মতো করে চিন্তার প্রকাশ করতে শিখছি। হতে পারে সব চিন্তাই হয়তো ঠিক না, প্রাসঙ্গিকতারও খামতি থাকতে পারে। তবে এ কথা সত্য যে এখনকার তরুণ সমাজের অধিকাংশ নিজের মতো করে চিন্তা করতে শিখেছে, যেকোনো কিছুকে প্রশ্ন করতে শিখেছে, এটিই বাংলাদেশের স্বাধীন বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার আজীবন সংগ্রামের সাফল্য। এ কারণেও তিনি আমাদের আপনজন, প্রাসঙ্গিকও।
লেখক: গবেষক ও অনুবাদক।
আহমদ ছফা। অকৃতদার, একগুঁয়ে, বোহেমিয়ান এই মানুষকে নিয়ে সিকি শতাব্দী পরেও আমাদের মধ্যে একটা দারুণ উত্তেজনা বিরাজ করে। আমরা যাঁরা এখন চল্লিশ পেরোনো—চালশে, যাঁরা ছফাকে সামনাসামনি তেমন করে পাইনি, কিন্তু একটা লম্বা সময় ছফায় বুঁদ ছিলাম, তাঁরা কেন ছফা নিয়ে উচ্চকিত? কেন এখনো এতটা প্রাসঙ্গিক তিনি?
আহমদ ছফার অনেকগুলো সত্তা। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা চিন্তক তিনি। তিনি যে শুধু চিন্তা করতেন আর লিখতেন তাই না, সেসব বাস্তবায়নের জন্য রীতিমতো মাঠে নেমে পড়তেন। নিজের চিন্তা আর কাজের সমন্বয়ে ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ ছফা যেন কার্ল মার্ক্সের সেই কথাকেই সত্য বলে প্রতিপন্ন করতে চাইতেন, দার্শনিকেরা দুনিয়ার অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছে, এখন সময় পরিবর্তনের। তাই একসময় তিনি গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ লেখক শিবির। তুলে এনেছিলেন চিত্রকর এসএম সুলতানকে।
স্বাধীন বাংলাদেশে হেন কোনো যৌক্তিক আন্দোলন নেই, যেখানে ছফার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল না। এই আহমদ ছফাই আবার ভাবালু। লিখছেন ‘পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ’-এর মতো অন্যবদ্য বই, যেখানে পরম মমতা আর অসীম ভালোবাসায় উঠে এসেছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বন্ধন ও সম্পর্ক। পুরো বইয়ে কী যে মায়া! এখানে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর দার্শনিক, প্রতিবাদী আর বোহেমিয়ান সত্তা।
তবে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ আর ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ লিখে একাধিক প্রজন্মকে চিন্তার খোরাক জুগিয়েছেন আহমদ ছফা। বাংলাদেশের রাজনীতি আর ‘সুশীল সমাজ’-এর ফাঁকফোকরগুলো দেখিয়েছেন যুক্তি আর বিপুল ক্রোধে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে সেই সময়ের শাসকদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছিলেন ছফা। আর তাঁর এই খড়গহস্ত হওয়ার পেছনে যথার্থ কার্যকারণ যে ছিল, ইতিহাসই সে সাক্ষ্য দেয়।
আবার বিগত বছরগুলোতে আমাদের দেশ যে স্বৈরশাসনের ছায়ায় ছিল, এ সময় বেঁচে থাকলে কেমন হতো ছফার ভূমিকা? কী করতেন তিনি?
কথাটি নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো, আহমদ ছফা সম্ভবত জনপ্রিয় ফেসবুকার হতেন। তাঁর একেকটা নাতিদীর্ঘ কিন্তু সরল ভাষায় লেখা স্ট্যাটাসের জন্য হয়তো উন্মুখ হয়ে থাকতেন এখনকার তরুণেরা। বিভিন্ন লেখাজোকায় প্রায়ই সুবিধাভোগী শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের দিকে ছুটে যেত তাঁর কটাক্ষের তীর। ছাড় দিতেন না ক্ষমতাসীনদেরও—সে যে দলই হোক না কেন। তবে এর চেয়েও জরুরি যে কাজ ছফা সবসময় করেছেন তা হলো, বিপুল সংখ্যক তরুণের সামনে ইতিহাসের এমন কিছু প্রসঙ্গ, এমন কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, যা তাঁদের ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
মোদ্দা কথা হলো, বক্সের বাইরে গিয়ে, প্রগতি-অপ্রগতির খোপ বাঁধা বাইনারির বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি যেমন ভাবতে পারতেন, সেই ভাবনা তাঁর মৃত্যুর এত বছর পর এখন আমাদেরও ভাবায়, উসকানি দেয়। তাই বলতে পারি, এ সময়ে জীবিত থাকলে সময়ের দাবি মেনে ছফা হয়তোবা ইউটিউবার হতেন। ইউটিউবে যুক্তিপূর্ণ আলাপের ফাঁকে ফাঁকে কখনোবা আমরা শুনতে পেতাম তাঁর বাঁশির সুর। পেতাম কি? কোনোদিন হয়তো রাস্তার কুকুর বা গাছ জড়িয়ে ধরে ভিডিও করতেন। জীবদ্দশায় ছফা তো এমনই ছিলেন, তাই না?
এসব ভাবতে ভাবতে মনে হলো, রাগী রাগী একটা চেহারা আমার ঘরে জানালায় উঁকি দিয়ে বলছে, ‘হারামজাদা! ফাজলামি চিন্তা বন্ধ কর। ’তাঁর কথা শুনে ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম, ‘গুরু, টেকনোগ্লোবাল নিউলিবারেল সময়ে আমরা একটু ফিচেল আছি। আর আমাদের ফোকাসের স্প্যানও কম। মাঝেমধ্যে তাই একটু মশকরা না করলে সিরিয়াস আলাপে ঢোকাই দায় হয়ে পড়ে।’
হ্যাঁ, সিরিয়াস আলাপ তো বটেই, বারবার আমরা গণ-অন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান করে বাংলাদেশের ইতিহাস বদলাই। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্রকে বুঝে নেওয়ার দায় আমাদের আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছুকাল পরেই কলমকে খাপখোলা তলোয়ার বানিয়ে ন্যালাখ্যাঁপা আহমদ ছফা লিখেছিলেন ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, খানিক আগেই বইটির নাম নিয়েছি। সে আমলের বুদ্ধিজীবীদের সংকীর্ণ দলান্ধতা এবং নামে বুদ্ধিজীবী হলেও একঘেঁয়ে, চিন্তাহীন আর ক্ষেত্রবিশেষে হীন স্বার্থের বুলি যে কতটা ফাঁপা ও ক্ষতিকর, এ বইয়ের ছত্রে ছত্রে তিনি তা দেখিয়েছিলেন। বাকশালী শাসনের বিরুদ্ধে তিনি যেমন বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিলেন, তেমনি সোচ্চার ছিলেন ধর্মীয় উগ্রপন্থা নিয়েও।
একই কথা খাটে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়েও। আদতে ছফা ছিলেন সেই প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ, যিনি বাংলাদেশের সমাজ ও ইতিহাসকে ভারতের প্রভাববলয় থেকে আলাদা চোখে দেখতেন। কিন্তু কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। বাংলাদেশ-ভারত প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইতিহাসের সূত্র টেনে তিনি বরং যুক্তি দিতেন। আর যুক্তির সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন স্বাধীন বুদ্ধিজীবীর আবেগও।
এ রকম চিন্তা থেকেই আহমদ ছফা লিখেছিলেন ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। এখানে মাদরাসা ছাত্রদের সঙ্গে তথাকথিত ‘প্রগতিশীলদের’দূরত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি দেখিয়েছেন বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিকভাবে পাওয়া হীনমন্যতাও। নিজের লেখায় বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয় এবং কলকাতাকেন্দ্রিক চাপানো পরিচয়—এই দুই বিষয় বিশ্লেষণ করে আমাদের জাতীয় পরিচয় অন্বেষণ করেছেন তিনি।
ছফা চলে যাওয়ার দুই দশক পরে এসব আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা এখন আরও বড় হয়ে উঠেছে। গুরুত্বও বেড়েছে।
ফলে কল্পনা করি যে আহমদ ছফা যদি কোনোক্রমে আরও দুই দশক বেঁচে থাকতেন, তবে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটা দেশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী যখন নীরব ভূমিকা পালন করেছেন, ছফা তখন কথা বলতেন। হাসিনা সরকারের অনাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন।
এ সময় বেঁচে থাকলে আহমদ ছফা যে অনলাইন ও অফলাইনে দাপিয়ে বেড়াতেন, তাতে সন্দেহ সামান্যই। যে ছফা তরুণদের পছন্দ করতেন, তারুণ্যের ভাবনাকে গুরুত্ব দিতেন, গত জুলাইয়ে তরুণেরা যখন ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসককে চোখ রাঙালো, তাঁদের তিনি যে সমর্থন দেবেন, এতে সন্দেহ কী!
সাহিত্যিক হলেও আহমদ ছফা আসলে আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক। তিনি মনে করতেন, কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। গেল শতকের নব্বই দশকের পর থেকে একটা সময় পর্যন্ত এদেশে বিরাজনীতিকরণের ঢেউ উঠেছিল। প্রচলিত বিভিন্ন গণমাধ্যম আর এনজিও—এই দুইয়ে মিলে ‘আই হেইট পলিটিক্স’ প্রজন্ম গড়ে তোলার সূচনা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে ছফার অবস্থান ছিল নিঃসঙ্গ শেরপার মতো।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এখন সোশ্যাল মিডিয়ার প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাওয়ার পরও সেই একই লড়াই আমরা দেখতে পাই। এই মাধ্যমের নানা রকম সীমাবদ্ধতা থাকলেও তথাকথিত মূলধারার নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটা গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার পরিসর হয়ে দাঁড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। এখানে এখন শত শত তরুণ চিন্তক অনেকটা ছফার ভঙ্গিতেই জীর্ণ, ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবিতাকে প্রশ্ন করতে থাকেন।
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে লেখা ছফার বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’তে লেখকের ওস্তাদ আব্দুর রাজ্জাকের ভাষ্য এমন, ‘পড়ার কাজটি অইল অন্যরকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না। আপনার ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইরা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই।’
আহমদ ছফা এই চিন্তার সিলসিলা বহন করেন। আর সিলসিলাটি এখন প্রবাহিত হচ্ছে আমাদের মধ্যে। ফলে আমরা নিজের ভাষায়, আমাদের মতো করে চিন্তার প্রকাশ করতে শিখছি। হতে পারে সব চিন্তাই হয়তো ঠিক না, প্রাসঙ্গিকতারও খামতি থাকতে পারে। তবে এ কথা সত্য যে এখনকার তরুণ সমাজের অধিকাংশ নিজের মতো করে চিন্তা করতে শিখেছে, যেকোনো কিছুকে প্রশ্ন করতে শিখেছে, এটিই বাংলাদেশের স্বাধীন বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার আজীবন সংগ্রামের সাফল্য। এ কারণেও তিনি আমাদের আপনজন, প্রাসঙ্গিকও।
লেখক: গবেষক ও অনুবাদক।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাঁদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তাঁরা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাতচল্লিশের সেই দেশভাগ বা পার্টিশনের প্রভাব এখনো বহন করে চলেছি আমরা। একে কোনো একরৈখিক বয়ানে বেঁধে ফেলা দুষ্কর।
৮ ঘণ্টা আগেনব্বইয়ের ক্লান্তি কিংবা বার্ধক্য-জরায় যতীন স্যার কখনোই নিঃসঙ্গতায় ছিলেন না। বাংলার প্রাকৃতজনের দার্শনিক জ্ঞান ও শান্তির দ্রোণাচার্য যতীন সরকার জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাতপাই, রামকৃষ্ণ রোডের 'বানপ্রস্থ' নামের বাড়িতে মানুষের সান্নিধ্যেই থাকতেন।
১ দিন আগেতারেক মাসুদ নামটি খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ কাজ নয়। আমি তাঁর ছাত্র, অনুসারী, সহযোগী বা উত্তরসূরি হলেও অন্য অনেকের মতোই আমিও তাঁকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম। কিন্তু এই ভাই ডাকার অভ্যস্ততা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এত গভীরে প্রোত্থিত যে আনুষ্ঠানিক কারণেও শুধু নামটি উচ্চারণে আমার অস্বস্তি হয়।
১ দিন আগেমাত্র ২৮ বছরের তরুণ ছিলেন আল-জাজিরার ফিলিস্তিনি প্রতিবেদক আনাস আল শরীফ। স্পষ্টতার সঙ্গে তুলে ধরতেন ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার অমানবিক রূপ। তাঁর প্রতিবেদনে প্রাণহীন শুষ্ক তথ্য ছাড়িয়ে উঠে আসত অবরুদ্ধ জীবনের নিখাদ ও অনাবৃত প্রতিচ্ছবি।
২ দিন আগে