leadT1ad

যতীন সরকারের শেষ দিনগুলো

প্রাকৃতজনের দার্শনিক, লেখক, শিক্ষক যতীন সরকার ৮৯ বছর বয়সে পরলোক গমন করেছেন। লিখেছেন পঞ্চাশের অধিক বই। যার মধ্যে ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’ অন্যতম। নিজেকে সব সময় শিক্ষক পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা এই লেখক পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পদকসহ বহু সম্মাননা। শেষ জীবনে থাকতেন নেত্রকোনার নিজ বাড়ি ‘বানপ্রস্থে’। যতীন সরকারের শেষ দিনগুলো নিয়ে লিখেছেন তাঁর ঘনিষ্টজন কবি সরোজ মোস্তফা

যতীন সরকারের শেষ দিনগুলো। স্ট্রিম গ্রাফিক

নব্বইয়ের ক্লান্তি কিংবা বার্ধক্য-জরায় যতীন স্যার কখনোই নিঃসঙ্গতায় ছিলেন না। বাংলার প্রাকৃতজনের দার্শনিক জ্ঞান ও শান্তির দ্রোণাচার্য যতীন সরকার জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাতপাই, রামকৃষ্ণ রোডের 'বানপ্রস্থ' নামের বাড়িতে মানুষের সান্নিধ্যেই থাকতেন। তাঁকে দেখাশোনা করতেন দুর্গাপুরের দীপক সাংমা। নিঃসঙ্গতায় তিনি কখনোই ছিলেন না। বরং আগন্তুকেরা স্যারকে ঘরের ভেতরে একান্তে-নিভৃতে বিশ্রামে পাঠাতেন। সকালে-সন্ধ্যায় তাঁর কাছে কেউ-না-কেউ আসবেনই। মানুষকে সঙ্গ দিতে এবং সঙ্গ নিতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তাঁর কাছে জ্ঞান ও চিন্তার ধারণা নিতে আসতেন। লোকধর্ম, লোকজ্ঞান, লোকসাহিত্যের অতীত ও ঐতিহ্যবিষয়ক নানা জিজ্ঞাসা নিয়ে আসতেন। এরকম জ্ঞানার্থীর চিন্তা ও ধারণার সমাধান করেছেন তিনি। অনুসন্ধানী গবেষক ও আগ্রহী জিজ্ঞাসুদের উৎস ও সূত্র ধরিয়ে দিতেন তিনি। প্রত্যেকের মনের অন্ধ-বন্ধ জানালাগুলোকে খুলে দিতেন তিনি।

আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি একটা আক্ষেপহীন, পরিতৃপ্ত মন নিয়ে যতীন সরকার অনন্তের পথে ধাবিত হয়েছেন। তাঁর এই যাত্রা শান্তির হোক।

সারা জীবন যা করেছেন, শেষ বেলাতেও যতীন সরকার তা-ই করে গেছেন। একজন শিক্ষক তিনি। শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থীর চিন্তা ও মনকেই জাগ্রত রেখেছেন। বাণপ্রস্থের আঙিনাটা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতেন। সবাই এখানে আসতে পারতেন। নব্বুইয়ে উপনীত হয়ে তিনি আসলে বাইরে যেতে পারতেন না। বাণপ্রস্থের বাড়িতে সব রকমের অনুষ্ঠানের হতো। কী রবীন্দ্রচর্চা, কী নজরুল চর্চা, কী পহেলা বৈশাখ, কী সংগীতানুষ্ঠান—সব রকমের আয়োজনে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। 'বানপ্রস্থ' যথার্থ অর্থেই একটি আশ্রম ছিল। জ্ঞানচর্চার আশ্রম। প্রতিটি আয়োজনেই তিনি দীর্ঘ বক্তৃতা করতেন। সেসব বক্তৃতায়, জীবন অভিজ্ঞতায়, সময় ও জীবনকে ব্যাখ্যা করতেন। ইতিহাস ও তথ্য দিয়ে সব সময় ও আগামীকে মূল্যায়ন করতেন। সেসব কথায়-বক্তৃতায় ওঠে আসত আগামীর সম্ভাবনা ও আশাবাদ।

নিজ বাড়ি বানপ্রস্থে যতীন সরকারের আবক্ষ মূর্তি। ছবি: সরোজ মোস্তফা
নিজ বাড়ি বানপ্রস্থে যতীন সরকারের আবক্ষ মূর্তি। ছবি: সরোজ মোস্তফা

একজন পরিপূর্ণ আশাবাদী মানুষ ছিলেন। প্রায়ই বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ৮১ বছর বেঁচে ছিলেন, আমি রবীন্দ্রনাথের থেকে বড়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন, বেঁচেই ছিলেন। আমি বেঁচে আছি কিন্তু লিখতে পারছি না। এটাকে ঠিক বেঁচে থাকা বলা যাবে না।‘ তাঁর আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি ছিল। তাঁর দেখা কিংবা শোনা পূর্বতন জীবনকে খুব সুন্দর করে বর্ণনা করতে পারতেন।

একজন পরিপূর্ণ আশাবাদী মানুষ ছিলেন। প্রায়ই বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ৮১ বছর বেঁচে ছিলেন, আমি রবীন্দ্রনাথের থেকে বড়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন, বেঁচেই ছিলেন। আমি বেঁচে আছি কিন্তু লিখতে পারছি না। এটাকে ঠিক বেঁচে থাকা বলা যাবে না।‘ তাঁর আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি ছিল। তাঁর দেখা কিংবা শোনা পূর্বতন জীবনকে খুব সুন্দর করে বর্ণনা করতে পারতেন।

ছিলেন সম্পূর্ণ নীরোগ। কোন ঔষধ তাঁর লাগতো না। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী দীপক সাংমা ছুটিতে যাওয়ার পর পত্রিকা নিতে গিয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন। এই পড়ে যাওয়াই কাল হলো। কোমরের জয়েন্টের হাড় ভেঙে গেল।

পল্লব চক্রবর্তী, স্বপন পাল, আলমগীর ভাই, দেবজ্যোতি, সাখাওয়াত, খারুপ স্যার সবাই মিলে যতীন স্যারকে ডাক্তার রিপনের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। রিপন বললেন, ঢাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই যে গেলেন, আজ বানপ্রস্থে ফিরেছেন সবাইকে বিদায় বলার জন্য। যাওয়ার আগের দিন পল্লব চক্রবর্তীকে তিনি বললেন , 'আমি সুস্থ, সৃষ্টিশীল, কৃতী, সম্মানিত, আনন্দময়।' জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মানুষের সমাজ ও জীবনকে আনন্দময়ীর চোখে দেখেছেন। জীবনটা শান্তির-আনন্দের এমন কথা যিনি বলতে পারেন– তিনি বাংলার প্রাকৃতজনের দার্শনিক।

যতীন সরকারের সঙ্গে লেখক।
যতীন সরকারের সঙ্গে লেখক।

জীবনকে নিয়ে কোনো রকমের দ্বিধা তাঁর ছিল না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মার্কসবাদে আস্থা রাখতেন। তিনি বলতেন, 'আমি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাস করি। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীর দৃষ্টিতে আমি বলতে পারি, আমি মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী ছিলাম, আছি এবং থাকব।‘ জীবনের শেষ মুহূর্তে উপনীত হয়েও তিনি বিশ্বাস করতেন, ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে মার্ক্সীয় দর্শনের নতুন পৃথিবী। এই মাটি থেকেই তাঁর এই ধারণা তৈরি হয়েছিল। খুব সাধারণ পরিবারে জন্মেছেন, সেই পরিবারে বিত্ত ছিল না কিন্তু জ্ঞানচর্চা ছিল। মানুষকে জানার-বোঝার একটা অন্বেষণ ছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘যে সমাজে জন্মেছি, সেই সমাজ ও প্রতিবেশেই তৈরি হয়েছে আমার মনন। প্রকৃতি ও প্রাকৃতজনই আমার জানা-বোঝার পৃথিবী। নিজের জীবন নিয়ে আমি খুব খুশি। আমার সাতপাঁচ ভাবনা নেই। বহু রঙিন না হতে পারার আক্ষেপ নেই।'

আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি একটা আক্ষেপহীন, পরিতৃপ্ত মন নিয়ে যতীন সরকার অনন্তের পথে ধাবিত হয়েছেন। তাঁর এই যাত্রা শান্তির হোক। তিনি কখনোই জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বলতেন, ‘আমি একজন বস্তুবাদী মানুষ। আমি পরলোকে বিশ্বাস করি না, এটাই তো স্বাভাবিক। মৃত্যুর মাধ্যমেই আমার জীবনের সমাপ্তি হবে।'

Ad 300x250

সম্পর্কিত