১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাঁদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তাঁরা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাতচল্লিশের সেই দেশভাগ বা পার্টিশনের প্রভাব এখনো বহন করে চলেছি আমরা। একে কোনো একরৈখিক বয়ানে বেঁধে ফেলা দুষ্কর। আদতে এর রূপান্তর এখনো হয়তো রয়েছে অপেক্ষায়। এই সময়ে দাঁড়িয়ে সেই উত্তঙ্গ সময়ে ফিরে দেখা।
জাভেদ হুসেন
১৯৪৭ সালের পার্টিশন আমাদের মনে জাগায় রক্তপাত, দাঙ্গা, বাস্তুচ্যুতি আর আতঙ্কের ছবি। এ গল্পের অন্য দিকও আছে। সবার অভিজ্ঞতা এক ছিল না। পূর্ববঙ্গের অনেক হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেন। আবার পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে বহু মুসলমান এসে বসতি গড়লেন পূর্ববঙ্গে। পাঞ্জাবের শিখ মুসলমানেরা দেশ অদলবদল করলেন। কেউ দেশ ছাড়লেন, কেউ রইলেন, কিন্তু সবার জীবনই বদলে গেল।
পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য এই বিভাজন কেবল ক্ষত নয়; এটি ছিল নতুন রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের সুযোগ। পাকিস্তানের অংশ হয়ে তাঁরা প্রথমবার নিজেদের আলাদা সত্তা ভাবতে শুরু করল। যা পরের ইতিহাসে খুলে দিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পথ।
পার্টিশনের দায় শুধু ব্রিটিশদের নয়। স্থানীয় রাজনীতি তাতে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিল। কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজ আর পূর্ববঙ্গের দরিদ্র মুসলমান কৃষকদের দীর্ঘদিনের বৈষম্য ও অবিশ্বাস এ বিভাজনকে যেন প্রায় অনিবার্য করে তুলেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ‘অভিন্ন বাঙালিত্ব’–এর রোমান্টিক ধারণা টিকে ছিল। কিন্তু যে বিচারেই দেখা হোক না কেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি স্বতন্ত্র পথ অর্জন করেছে। দুই বাংলার পথ ক্রমেই হয়েছে আলাদা। আদতে পশ্চিমবঙ্গের অভিজাতদের সাংস্কৃতিক উচ্চম্মন্যতা আর বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সত্তা গড়ার চেষ্টা—এই সম্পর্ক এক জটিল পথ অতিক্রম করছে। ১৯৪৭ যে আলাদা যাত্রার সূচনা করেছিল, ইতিহাস সেই ফারাককে আরও গভীর করেছে।
দেশভাগ বা ভারতভাগ বললে যেন এক বিশাল, চিরন্তন, অবিভক্ত ভারতবর্ষের ছবি ফুটে ওঠে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে কখনোই দীর্ঘ সময় ধরে গোটা উপমহাদেশ একটি একক রাজনৈতিক শাসনের অধীনে ছিল না।
মৌর্য সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ–তৃতীয় শতক) চন্দ্রগুপ্ত ও অশোকের আমলে অনেক বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের তামিল রাজ্যগুলোর মতো অঞ্চলগুলো ছিল এর বাইরে।
গুপ্ত যুগ (চতুর্থ–ষষ্ঠ শতক) উত্তর ভারতে শক্তিশালী হলেও পূর্ব ও দক্ষিণে বহু স্বাধীন রাজ্য ছিল।
মুঘল সাম্রাজ্য (১৬শ–১৭শ শতক) চূড়ান্ত সফলতার সময়ে বিশাল হলেও উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল, দক্ষিণের কিছু অংশ, এমনকি আফগানিস্তানের পাশের সীমান্ত অঞ্চল সবসময়ই আঞ্চলিক রাজাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বড় বড় এই সব সাম্রাজ্যগুলো কখনো প্রসারিত, কখনো সংকুচিত হয়েছে। অনেক জায়গায় কেন্দ্রীয় শাসন কেবল খাজনা আদায় বা আনুগত্য নেওয়া পর্যন্ত সীমিত ছিল। বাস্তবে প্রথমবার উপমহাদেশে একক প্রশাসনিক কাঠামো আসে ব্রিটিশ রাজের হাত ধরে। রেল, ডাক, টেলিগ্রাফ, একক মুদ্রা, একীভূত আইন—এসব ব্রিটিশেরা বানাল তাদের শাসনের সুবিধার জন্য। তা-ও এর ভেতরে ছিল শতাধিক দেশীয় রাজ্য। যেমন হায়দরাবাদ, কাশ্মীর, ত্রিবাঙ্কুর ইত্যাদি। এরা প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন চালাত, শুধু বৈদেশিক নীতি ছিল ব্রিটিশদের হাতে।
তাই ১৯৪৭-এর আগে ‘অখণ্ড ভারত’ আসলে ছিল ঔপনিবেশিক প্রশাসনের জোড়াতালি—ইতিহাসের কোনো শাশ্বত সত্য নয়।
আজ আমরা ‘দেশ’ বা ‘জাতীয়তা’ দিয়ে নিজকে চিহ্নিত করি। কিন্তু এসবের মধ্যে পতাকা, কেন্দ্রীয় সরকার, নির্দিষ্ট সীমান্ত—এসব ধারণা ভারতবর্ষে খুব পুরোনো নয়। প্রাচীনকালে মানুষের প্রধান পরিচয় ছিল ধর্ম, ভাষা, রাজ্য বা জাতি। যেমন ‘বঙ্গবাসী’, ‘মালাবারবাসী’ বা ‘মোগলদের প্রজা’। কিন্তু মানুষ কখনোই নিজেদের একটি দেশের নাগরিক বলে ভাবত না।
ইউরোপে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা (নেশন স্টেট) গড়ে ওঠে ১৮শ–১৯শ শতকে। আর ভারতবর্ষে তা আসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে। ব্রিটিশ শাসনের কারণে এক ভাষায় প্রশাসন, একই আইন, সারা দেশে পত্রিকা ও রেলপথের যোগাযোগ তৈরি হয়। আর এগুলো ধীরে ধীরে মানুষের মনে ‘আমরা এক দেশের বাসিন্দা’—এই ধারণা বপন করে।
ঊনবিংশ থেকে বিংশ শতকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এই নতুন কল্পিত ‘দেশ’কে রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে নিয়ে যায়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তারা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। একদিন আগেও তারা একই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করত, একই হাটে পণ্য বিক্রি করত, পাশাপাশি খেতের ধান কাটায় হাত লাগাত। কিন্তু হঠাৎ এক কাগজে আঁকা রেখা পরিচয় বদলে দিল তাদের। নিজ ভূমিতে তারা হয়ে গেল—ভিনদেশি।
কিছু বড় নেতা আর ইংরেজদের প্রশাসনের টেবিলে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত কোটি মানুষের জীবনে নামিয়ে আনল অচিন্তিত আঘাত। পরিচয়ের ছিন্নতা, অস্থির অভিবাসন, আত্মপরিচয়ের সংকট—এই তিন বাস্তবতা মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিল। ‘আমি কে? আমার দেশ কোনটা?’—প্রশ্নগুলো উপমহাদেশের মানুষের জীবনে আগে কখনো আসেনি।
এই সময়কালকে সংস্কৃতির এক ভাঙন বলে চিহ্নিত করা যায়। পরিবারগুলো ছিন্ন হয়ে গেল। উৎসবের রীতিও গেল বদলে। সীমান্ত পেরোনো মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রাখার সুযোগ থাকে কম। বিপরীতে তাদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে নিজেদের অতীত ভুলে যেতে সফল হওয়া। মানুষের যখন বাস্তুচ্যুতি ঘটে, তখন স্বভাবতই নিজের হাট, মেলা, সংগীত থেকে ছিন্ন হওয়া মানুষগুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে বাধ্য হয়।
মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, ব্রিটিশ প্রশাসনের চাপ ও অবিশ্বাস—এসব প্রপঞ্চ একসঙ্গে মিলিয়ে এই পথকে এক রকম ‘অপরিহার্য’ করে তুলেছিল। এক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কৌশলও ছিল খাসা। কৌশল ছিল এদের মাঝখানের চিড়কে আরও বাড়িয়ে তোলা। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আর অর্থনৈতিক-আঞ্চলিক অসাম্য—সবকিছু মিলিয়ে ত্বরান্বিত হয়েছিল বিভাজন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশভাগ এক দ্বৈত বাস্তবতা। পূর্ববঙ্গের অনেক হিন্দু পরিবার রাতারাতি চলে যায় পশ্চিমবঙ্গে। অনেকের প্রিয়জন ছিন্ন, অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আসেন। তবে সেই একই সময় কলকাতার ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের ঘটনা পূর্ববঙ্গকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিল। ‘দেশভাগ’ বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের জন্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশভাগ তাই দুই মুখের: একদিকে বেদনা, উচ্ছেদ ও হারানো প্রিয়জনের ক্ষত। অন্যদিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব ভাগ্য গড়ার সুযোগ। এ দ্বৈততা বোঝা ছাড়া দেশভাগের পূর্ণ ইতিহাস বোঝা অসম্ভব।
দেশভাগের গল্প শুধু মানচিত্রের বদল নয়, মানুষের মনেরও এক ভয়াবহ বদল। সাদত হাসান মান্টোর গল্পে যেমন দেখি, একজন মানুষ গতকাল পর্যন্ত যার সঙ্গে এক হুক্কা টানত, সে-ই আজ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার রক্তদর্শনের জন্য। ঘৃণা কখনো কখনো এত দ্রুত গজায় যে মনে হয়, তা যেন বহু বছর ধরে মাটির নিচে চাপা ছিল, শুধু এক ফোঁটা রক্তপাতের অপেক্ষায়।
জওহরলাল নেহরু বিলেতে পড়ালেখা করা মানুষ। দুঁদে রাজনীতিবিদ। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ নামে এক ঢাউস বই লিভে ভারত-আত্মার খোঁজ করেছেন। সেই নেহরুও দেশভাগের দাঙ্গা দেখে হতবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘ভেবেছিলাম, আমি আমার মানুষদের চিনি। এখন মনে হচ্ছে, আমি তাদের একেবারেই চিনতাম না।’ সভ্যতার রঙিন আবরণের নিচে বর্বরতার যে পাতলা স্তর লুকিয়ে আছে, দেশভাগের দাঙ্গা তা ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলেছিল।
মানুষের ভেতরে অন্যকে আতংকিত করার এক ধরনের প্রবণতা থাকে। আদিম ইতিহাসের অন্ধকার, অনিশ্চয়তা থেকে যার জন্ম। ভয়, অনিশ্চয়তা আর গোষ্ঠীগত পরিচয় হুমকির মুখে পড়লে, তা হঠাৎ ফেটে বের হয়ে আসে। সমাজ-তাত্ত্বিক আশিস নন্দী অবশ্য বলেন, উপনিবেশিক শাসন মানুষের আত্মপরিচয়কে এমনভাবে বিকৃত করেছিল যে সীমারেখা বদল মানেই হয়ে গিয়েছিল শত্রুকে মুছে ফেলা।
দেশভাগ ঘিরে যে দাঙ্গার হিংস্রতা, এর তূলনা মেলা ভার। এর আগে উপমহাদেশে বড় সংঘর্ষ হলেও সাধারণ জনগণের মধ্যে কাউকে জাতিগতভাবে সম্পূর্ণ নির্মূল করার প্রবণতা ছিল না। মধ্যযুগে ধর্ম, ভাষা, আচার নিয়ে বিরোধ থাকলেও পাশাপাশি বসবাস ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন ধর্মভিত্তিক বিভাজনের বীজ এমনভাবে বুনে দিয়েছিল যে, দেশভাগের দিনগুলোতে সেই জমা ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছিল বিস্ফোরণের মতো।
আজও সেই স্মৃতি আমাদের সঙ্গে আছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা ভয়, অবিশ্বাস ও ক্ষতের উত্তরাধিকার আমরা বয়ে চলেছি—যেন দেশভাগ বা পার্টিশনের দাঙ্গা শেষ হয়নি, শুধু রূপ বদলেছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর মিয়ানমারে এখন সংখ্যালঘুদের নিয়ে যে হিংস্রতার রাজনীতি, তার জন্ম দেশভাগের রাজনীতির মধ্যে।
দেশভাগের কাহিনিতে রাজনৈতিক মোড় আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তখন ভারতবর্ষ ছিল বিশাল, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে টুকরো টুকরো। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে সেই টুকরোগুলোকে এক ছাতার নিচে আনল, নিজেদের স্বার্থে।
কিন্তু এই একীকরণের ভেতরেই বোনা হচ্ছিল বিভাজনের বীজ। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্রিটিশদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলিম সৈন্যেরা একসঙ্গে লড়েছিল। এই লড়াই ব্রিটিশ শাসকদের মনে এক ধরনের ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারা তখন ধর্মভিত্তিক বিভাজনের কৌশলকে আরও সূক্ষ্মভাবে চালু করলেন, পরে যাকে আমরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ (ভাগ করো ও শাসন করো) নামে জানি।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন ঘোষণা করলেন বঙ্গভঙ্গ। পূর্ববঙ্গকে আলাদা করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ করা হলো। আর পশ্চিমবঙ্গে থাকল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হয়ে। উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক সুবিধা। কিন্তু বাস্তবে এটা ছিল ধর্মীয় বিভাজনের প্রথম বড় পদক্ষেপ। প্রবল প্রতিবাদে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হয়। কিন্তু বিভাজনের মনস্তাত্ত্বিক রেখা রয়েই যায়।
এরপর রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন চরিত্র হাজির—মুসলিম লীগ (১৯০৬)। শুরুতে তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম স্বার্থরক্ষা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে রূপ নেয়। এর পেছনে বড় ভূমিকা ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের।
১৯৩০-এর দশকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের নেতা হয়ে ওঠেন। সামনে আসে ‘দুই জাতি তত্ত্ব’। হিন্দু ও মুসলিম দুটি আলাদা জাতি, তাই তাদের আলাদা রাষ্ট্র প্রয়োজন। এই তত্ত্ব রাজনীতিকে এমন এক পথে নিয়ে গেল, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্বল হতে থাকে ব্রিটিশেরা। অন্যদিকে ভারতীয়দের স্বাধীনতার দাবিও তীব্র হয়। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা ভেঙে যায়। একই বছরে কলকাতায় ঘটে ভয়াবহ ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। দিকে দিকে শুরু হলো দাঙ্গা। এই রক্তপাত স্পষ্ট করে দিল—দুটি সম্প্রদায়কে এক রাষ্ট্রে রাখা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ঘোষণা করলেন, ব্রিটিশেরা ভারত ছেড়ে যাবে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে শেষ ভাইসরয় বানিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হলো দেশভাগের প্রক্রিয়া শেষ করার। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও শিখ নেতাদের দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো, ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করা হবে: ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান আবার হবে দুই অংশে—পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান।
১৫ আগস্ট ১৯৪৭। স্বাধীন হলো ভারত। এর একদিন আগে জন্ম নিল পাকিস্তান। কিন্তু সেরিল রেডক্লিফ এই উপমহাদেশকে যেভাবে রেখায় রেখায় ভাগ করেছিলেন, তাতে কাগজে টানা সেই রেখাগুলো হয়ে গেল রক্তাক্ত নদী। কোটি কোটি মানুষ ছাড়ল ঘর। লাখো মানুষ প্রাণ হারাল। দেশভাগ হয়ে গেল স্বাধীনতার উল্লাস আর ইতিহাসের গভীরতম ক্ষতের দিন।
দেশভাগ বা পার্টিশনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম গণ-অভিবাসন। আনুমানিক এক কোটি মানুষ এক দিক থেকে আরেক দিকে পাড়ি জমাল। পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গের দিকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিম পরিবার পূর্ববঙ্গের দিকে। আর পাঞ্জাব অঞ্চলে তখন চলছে উল্টো স্রোত। ট্রেনভর্তি মানুষ চলেছে অজানার পথে। অনেক ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছেছে ফাঁকা—সব যাত্রী নিহত।
এই অভিবাসনের সঙ্গী ছিল ভয়াবহ দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা গ্রাস করেছিল শহর ও গ্রাম, পুড়ছিল ঘরবাড়ি, লাশে ভরে যাচ্ছিল রাস্তা। কোনো পরিসংখ্যানই হয়তো পুরো সত্যটা বলতে পারবে না। আনুমানিক দু-আড়াই লাখ থেকে ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এ দাঙ্গায়। অনেকে হারিয়েছে প্রিয়জন, কেউ হারিয়েছে শৈশবের ঘর, কেউ নিজের ভাষা বা পরিচিত আচার।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও প্রভাব ছিল দীর্ঘমেয়াদী। নতুন জায়গায় গিয়ে শূন্য থেকে জীবন শুরু করতে হয়েছিল লাখো মানুষকে। কেউ সফল হয়েছিলেন, কেউ পারেননি। নগরগুলোতে চাপ বেড়ে গিয়েছিল। গ্রামগুলোতে শ্রমশক্তির ধরণ বদলে গিয়েছিল হঠাৎ করে। ব্যবসা, জমি, বাজার—সবকিছু নতুন করে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছিল পরবর্তী দশকগুলোতে।
সাংস্কৃতিক ক্ষতও কম ছিল না। যে হাটে হিন্দু-মুসলিম-শিখ কেনা-বেচা করত, যেখানে উৎসবে ধর্মের দেয়াল যৌক্তিক উচ্চতার ছিল, সাতচল্লিশের এই ঘটনা সেই রং মুছে দিল। মিশ্র সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন গেল হারিয়ে। অভিবাসীরা অনেকে নিজের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে পারেননি নতুন পরিবেশে।
তবে সবটাই অন্ধকার ছিল না। নতুন জায়গায় গড়ে উঠেছিল নতুন বন্ধন, নতুন পাড়া, নতুন বাজার। অনেকেই নতুন জীবন গড়ার সাহসী প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত—তিন দেশই দেশভাগ বা পার্টিশনের পর নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ে নিজেদের পুনর্গঠন করেছে।
কিন্তু এই ঘটনার ফলাফল বলতে গেলে, সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার ছিল মনস্তাত্ত্বিক। ভয়, অবিশ্বাস, ও অতীতের ক্ষত এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলে এসেছে—যেন এক অদৃশ্য সীমানা আমাদের ভেতরেই বসে গেছে। স্বাধীনতার আনন্দের আড়ালে তাই রয়ে গেছে এক দীর্ঘশ্বাসও, যা আজ আরও গভীর থেকে গভীর। আদতে দেশভাগ বা পার্টিশনের রূপান্তর ঘটেই চলেছে এখনো।
লেখক: লেখক ও অনুবাদক
১৯৪৭ সালের পার্টিশন আমাদের মনে জাগায় রক্তপাত, দাঙ্গা, বাস্তুচ্যুতি আর আতঙ্কের ছবি। এ গল্পের অন্য দিকও আছে। সবার অভিজ্ঞতা এক ছিল না। পূর্ববঙ্গের অনেক হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেন। আবার পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে বহু মুসলমান এসে বসতি গড়লেন পূর্ববঙ্গে। পাঞ্জাবের শিখ মুসলমানেরা দেশ অদলবদল করলেন। কেউ দেশ ছাড়লেন, কেউ রইলেন, কিন্তু সবার জীবনই বদলে গেল।
পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য এই বিভাজন কেবল ক্ষত নয়; এটি ছিল নতুন রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের সুযোগ। পাকিস্তানের অংশ হয়ে তাঁরা প্রথমবার নিজেদের আলাদা সত্তা ভাবতে শুরু করল। যা পরের ইতিহাসে খুলে দিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পথ।
পার্টিশনের দায় শুধু ব্রিটিশদের নয়। স্থানীয় রাজনীতি তাতে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিল। কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজ আর পূর্ববঙ্গের দরিদ্র মুসলমান কৃষকদের দীর্ঘদিনের বৈষম্য ও অবিশ্বাস এ বিভাজনকে যেন প্রায় অনিবার্য করে তুলেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ‘অভিন্ন বাঙালিত্ব’–এর রোমান্টিক ধারণা টিকে ছিল। কিন্তু যে বিচারেই দেখা হোক না কেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি স্বতন্ত্র পথ অর্জন করেছে। দুই বাংলার পথ ক্রমেই হয়েছে আলাদা। আদতে পশ্চিমবঙ্গের অভিজাতদের সাংস্কৃতিক উচ্চম্মন্যতা আর বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সত্তা গড়ার চেষ্টা—এই সম্পর্ক এক জটিল পথ অতিক্রম করছে। ১৯৪৭ যে আলাদা যাত্রার সূচনা করেছিল, ইতিহাস সেই ফারাককে আরও গভীর করেছে।
দেশভাগ বা ভারতভাগ বললে যেন এক বিশাল, চিরন্তন, অবিভক্ত ভারতবর্ষের ছবি ফুটে ওঠে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে কখনোই দীর্ঘ সময় ধরে গোটা উপমহাদেশ একটি একক রাজনৈতিক শাসনের অধীনে ছিল না।
মৌর্য সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ–তৃতীয় শতক) চন্দ্রগুপ্ত ও অশোকের আমলে অনেক বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের তামিল রাজ্যগুলোর মতো অঞ্চলগুলো ছিল এর বাইরে।
গুপ্ত যুগ (চতুর্থ–ষষ্ঠ শতক) উত্তর ভারতে শক্তিশালী হলেও পূর্ব ও দক্ষিণে বহু স্বাধীন রাজ্য ছিল।
মুঘল সাম্রাজ্য (১৬শ–১৭শ শতক) চূড়ান্ত সফলতার সময়ে বিশাল হলেও উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল, দক্ষিণের কিছু অংশ, এমনকি আফগানিস্তানের পাশের সীমান্ত অঞ্চল সবসময়ই আঞ্চলিক রাজাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বড় বড় এই সব সাম্রাজ্যগুলো কখনো প্রসারিত, কখনো সংকুচিত হয়েছে। অনেক জায়গায় কেন্দ্রীয় শাসন কেবল খাজনা আদায় বা আনুগত্য নেওয়া পর্যন্ত সীমিত ছিল। বাস্তবে প্রথমবার উপমহাদেশে একক প্রশাসনিক কাঠামো আসে ব্রিটিশ রাজের হাত ধরে। রেল, ডাক, টেলিগ্রাফ, একক মুদ্রা, একীভূত আইন—এসব ব্রিটিশেরা বানাল তাদের শাসনের সুবিধার জন্য। তা-ও এর ভেতরে ছিল শতাধিক দেশীয় রাজ্য। যেমন হায়দরাবাদ, কাশ্মীর, ত্রিবাঙ্কুর ইত্যাদি। এরা প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন চালাত, শুধু বৈদেশিক নীতি ছিল ব্রিটিশদের হাতে।
তাই ১৯৪৭-এর আগে ‘অখণ্ড ভারত’ আসলে ছিল ঔপনিবেশিক প্রশাসনের জোড়াতালি—ইতিহাসের কোনো শাশ্বত সত্য নয়।
আজ আমরা ‘দেশ’ বা ‘জাতীয়তা’ দিয়ে নিজকে চিহ্নিত করি। কিন্তু এসবের মধ্যে পতাকা, কেন্দ্রীয় সরকার, নির্দিষ্ট সীমান্ত—এসব ধারণা ভারতবর্ষে খুব পুরোনো নয়। প্রাচীনকালে মানুষের প্রধান পরিচয় ছিল ধর্ম, ভাষা, রাজ্য বা জাতি। যেমন ‘বঙ্গবাসী’, ‘মালাবারবাসী’ বা ‘মোগলদের প্রজা’। কিন্তু মানুষ কখনোই নিজেদের একটি দেশের নাগরিক বলে ভাবত না।
ইউরোপে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা (নেশন স্টেট) গড়ে ওঠে ১৮শ–১৯শ শতকে। আর ভারতবর্ষে তা আসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে। ব্রিটিশ শাসনের কারণে এক ভাষায় প্রশাসন, একই আইন, সারা দেশে পত্রিকা ও রেলপথের যোগাযোগ তৈরি হয়। আর এগুলো ধীরে ধীরে মানুষের মনে ‘আমরা এক দেশের বাসিন্দা’—এই ধারণা বপন করে।
ঊনবিংশ থেকে বিংশ শতকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এই নতুন কল্পিত ‘দেশ’কে রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে নিয়ে যায়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তারা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। একদিন আগেও তারা একই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করত, একই হাটে পণ্য বিক্রি করত, পাশাপাশি খেতের ধান কাটায় হাত লাগাত। কিন্তু হঠাৎ এক কাগজে আঁকা রেখা পরিচয় বদলে দিল তাদের। নিজ ভূমিতে তারা হয়ে গেল—ভিনদেশি।
কিছু বড় নেতা আর ইংরেজদের প্রশাসনের টেবিলে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত কোটি মানুষের জীবনে নামিয়ে আনল অচিন্তিত আঘাত। পরিচয়ের ছিন্নতা, অস্থির অভিবাসন, আত্মপরিচয়ের সংকট—এই তিন বাস্তবতা মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিল। ‘আমি কে? আমার দেশ কোনটা?’—প্রশ্নগুলো উপমহাদেশের মানুষের জীবনে আগে কখনো আসেনি।
এই সময়কালকে সংস্কৃতির এক ভাঙন বলে চিহ্নিত করা যায়। পরিবারগুলো ছিন্ন হয়ে গেল। উৎসবের রীতিও গেল বদলে। সীমান্ত পেরোনো মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রাখার সুযোগ থাকে কম। বিপরীতে তাদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে নিজেদের অতীত ভুলে যেতে সফল হওয়া। মানুষের যখন বাস্তুচ্যুতি ঘটে, তখন স্বভাবতই নিজের হাট, মেলা, সংগীত থেকে ছিন্ন হওয়া মানুষগুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে বাধ্য হয়।
মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, ব্রিটিশ প্রশাসনের চাপ ও অবিশ্বাস—এসব প্রপঞ্চ একসঙ্গে মিলিয়ে এই পথকে এক রকম ‘অপরিহার্য’ করে তুলেছিল। এক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কৌশলও ছিল খাসা। কৌশল ছিল এদের মাঝখানের চিড়কে আরও বাড়িয়ে তোলা। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আর অর্থনৈতিক-আঞ্চলিক অসাম্য—সবকিছু মিলিয়ে ত্বরান্বিত হয়েছিল বিভাজন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশভাগ এক দ্বৈত বাস্তবতা। পূর্ববঙ্গের অনেক হিন্দু পরিবার রাতারাতি চলে যায় পশ্চিমবঙ্গে। অনেকের প্রিয়জন ছিন্ন, অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আসেন। তবে সেই একই সময় কলকাতার ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের ঘটনা পূর্ববঙ্গকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিল। ‘দেশভাগ’ বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের জন্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশভাগ তাই দুই মুখের: একদিকে বেদনা, উচ্ছেদ ও হারানো প্রিয়জনের ক্ষত। অন্যদিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব ভাগ্য গড়ার সুযোগ। এ দ্বৈততা বোঝা ছাড়া দেশভাগের পূর্ণ ইতিহাস বোঝা অসম্ভব।
দেশভাগের গল্প শুধু মানচিত্রের বদল নয়, মানুষের মনেরও এক ভয়াবহ বদল। সাদত হাসান মান্টোর গল্পে যেমন দেখি, একজন মানুষ গতকাল পর্যন্ত যার সঙ্গে এক হুক্কা টানত, সে-ই আজ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার রক্তদর্শনের জন্য। ঘৃণা কখনো কখনো এত দ্রুত গজায় যে মনে হয়, তা যেন বহু বছর ধরে মাটির নিচে চাপা ছিল, শুধু এক ফোঁটা রক্তপাতের অপেক্ষায়।
জওহরলাল নেহরু বিলেতে পড়ালেখা করা মানুষ। দুঁদে রাজনীতিবিদ। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ নামে এক ঢাউস বই লিভে ভারত-আত্মার খোঁজ করেছেন। সেই নেহরুও দেশভাগের দাঙ্গা দেখে হতবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘ভেবেছিলাম, আমি আমার মানুষদের চিনি। এখন মনে হচ্ছে, আমি তাদের একেবারেই চিনতাম না।’ সভ্যতার রঙিন আবরণের নিচে বর্বরতার যে পাতলা স্তর লুকিয়ে আছে, দেশভাগের দাঙ্গা তা ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলেছিল।
মানুষের ভেতরে অন্যকে আতংকিত করার এক ধরনের প্রবণতা থাকে। আদিম ইতিহাসের অন্ধকার, অনিশ্চয়তা থেকে যার জন্ম। ভয়, অনিশ্চয়তা আর গোষ্ঠীগত পরিচয় হুমকির মুখে পড়লে, তা হঠাৎ ফেটে বের হয়ে আসে। সমাজ-তাত্ত্বিক আশিস নন্দী অবশ্য বলেন, উপনিবেশিক শাসন মানুষের আত্মপরিচয়কে এমনভাবে বিকৃত করেছিল যে সীমারেখা বদল মানেই হয়ে গিয়েছিল শত্রুকে মুছে ফেলা।
দেশভাগ ঘিরে যে দাঙ্গার হিংস্রতা, এর তূলনা মেলা ভার। এর আগে উপমহাদেশে বড় সংঘর্ষ হলেও সাধারণ জনগণের মধ্যে কাউকে জাতিগতভাবে সম্পূর্ণ নির্মূল করার প্রবণতা ছিল না। মধ্যযুগে ধর্ম, ভাষা, আচার নিয়ে বিরোধ থাকলেও পাশাপাশি বসবাস ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন ধর্মভিত্তিক বিভাজনের বীজ এমনভাবে বুনে দিয়েছিল যে, দেশভাগের দিনগুলোতে সেই জমা ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছিল বিস্ফোরণের মতো।
আজও সেই স্মৃতি আমাদের সঙ্গে আছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা ভয়, অবিশ্বাস ও ক্ষতের উত্তরাধিকার আমরা বয়ে চলেছি—যেন দেশভাগ বা পার্টিশনের দাঙ্গা শেষ হয়নি, শুধু রূপ বদলেছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর মিয়ানমারে এখন সংখ্যালঘুদের নিয়ে যে হিংস্রতার রাজনীতি, তার জন্ম দেশভাগের রাজনীতির মধ্যে।
দেশভাগের কাহিনিতে রাজনৈতিক মোড় আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তখন ভারতবর্ষ ছিল বিশাল, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে টুকরো টুকরো। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে সেই টুকরোগুলোকে এক ছাতার নিচে আনল, নিজেদের স্বার্থে।
কিন্তু এই একীকরণের ভেতরেই বোনা হচ্ছিল বিভাজনের বীজ। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্রিটিশদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলিম সৈন্যেরা একসঙ্গে লড়েছিল। এই লড়াই ব্রিটিশ শাসকদের মনে এক ধরনের ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারা তখন ধর্মভিত্তিক বিভাজনের কৌশলকে আরও সূক্ষ্মভাবে চালু করলেন, পরে যাকে আমরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ (ভাগ করো ও শাসন করো) নামে জানি।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন ঘোষণা করলেন বঙ্গভঙ্গ। পূর্ববঙ্গকে আলাদা করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ করা হলো। আর পশ্চিমবঙ্গে থাকল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হয়ে। উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক সুবিধা। কিন্তু বাস্তবে এটা ছিল ধর্মীয় বিভাজনের প্রথম বড় পদক্ষেপ। প্রবল প্রতিবাদে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হয়। কিন্তু বিভাজনের মনস্তাত্ত্বিক রেখা রয়েই যায়।
এরপর রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন চরিত্র হাজির—মুসলিম লীগ (১৯০৬)। শুরুতে তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম স্বার্থরক্ষা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে রূপ নেয়। এর পেছনে বড় ভূমিকা ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের।
১৯৩০-এর দশকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের নেতা হয়ে ওঠেন। সামনে আসে ‘দুই জাতি তত্ত্ব’। হিন্দু ও মুসলিম দুটি আলাদা জাতি, তাই তাদের আলাদা রাষ্ট্র প্রয়োজন। এই তত্ত্ব রাজনীতিকে এমন এক পথে নিয়ে গেল, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্বল হতে থাকে ব্রিটিশেরা। অন্যদিকে ভারতীয়দের স্বাধীনতার দাবিও তীব্র হয়। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা ভেঙে যায়। একই বছরে কলকাতায় ঘটে ভয়াবহ ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। দিকে দিকে শুরু হলো দাঙ্গা। এই রক্তপাত স্পষ্ট করে দিল—দুটি সম্প্রদায়কে এক রাষ্ট্রে রাখা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ঘোষণা করলেন, ব্রিটিশেরা ভারত ছেড়ে যাবে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে শেষ ভাইসরয় বানিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হলো দেশভাগের প্রক্রিয়া শেষ করার। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও শিখ নেতাদের দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো, ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করা হবে: ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান আবার হবে দুই অংশে—পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান।
১৫ আগস্ট ১৯৪৭। স্বাধীন হলো ভারত। এর একদিন আগে জন্ম নিল পাকিস্তান। কিন্তু সেরিল রেডক্লিফ এই উপমহাদেশকে যেভাবে রেখায় রেখায় ভাগ করেছিলেন, তাতে কাগজে টানা সেই রেখাগুলো হয়ে গেল রক্তাক্ত নদী। কোটি কোটি মানুষ ছাড়ল ঘর। লাখো মানুষ প্রাণ হারাল। দেশভাগ হয়ে গেল স্বাধীনতার উল্লাস আর ইতিহাসের গভীরতম ক্ষতের দিন।
দেশভাগ বা পার্টিশনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম গণ-অভিবাসন। আনুমানিক এক কোটি মানুষ এক দিক থেকে আরেক দিকে পাড়ি জমাল। পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গের দিকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিম পরিবার পূর্ববঙ্গের দিকে। আর পাঞ্জাব অঞ্চলে তখন চলছে উল্টো স্রোত। ট্রেনভর্তি মানুষ চলেছে অজানার পথে। অনেক ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছেছে ফাঁকা—সব যাত্রী নিহত।
এই অভিবাসনের সঙ্গী ছিল ভয়াবহ দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা গ্রাস করেছিল শহর ও গ্রাম, পুড়ছিল ঘরবাড়ি, লাশে ভরে যাচ্ছিল রাস্তা। কোনো পরিসংখ্যানই হয়তো পুরো সত্যটা বলতে পারবে না। আনুমানিক দু-আড়াই লাখ থেকে ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এ দাঙ্গায়। অনেকে হারিয়েছে প্রিয়জন, কেউ হারিয়েছে শৈশবের ঘর, কেউ নিজের ভাষা বা পরিচিত আচার।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও প্রভাব ছিল দীর্ঘমেয়াদী। নতুন জায়গায় গিয়ে শূন্য থেকে জীবন শুরু করতে হয়েছিল লাখো মানুষকে। কেউ সফল হয়েছিলেন, কেউ পারেননি। নগরগুলোতে চাপ বেড়ে গিয়েছিল। গ্রামগুলোতে শ্রমশক্তির ধরণ বদলে গিয়েছিল হঠাৎ করে। ব্যবসা, জমি, বাজার—সবকিছু নতুন করে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছিল পরবর্তী দশকগুলোতে।
সাংস্কৃতিক ক্ষতও কম ছিল না। যে হাটে হিন্দু-মুসলিম-শিখ কেনা-বেচা করত, যেখানে উৎসবে ধর্মের দেয়াল যৌক্তিক উচ্চতার ছিল, সাতচল্লিশের এই ঘটনা সেই রং মুছে দিল। মিশ্র সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন গেল হারিয়ে। অভিবাসীরা অনেকে নিজের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে পারেননি নতুন পরিবেশে।
তবে সবটাই অন্ধকার ছিল না। নতুন জায়গায় গড়ে উঠেছিল নতুন বন্ধন, নতুন পাড়া, নতুন বাজার। অনেকেই নতুন জীবন গড়ার সাহসী প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত—তিন দেশই দেশভাগ বা পার্টিশনের পর নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ে নিজেদের পুনর্গঠন করেছে।
কিন্তু এই ঘটনার ফলাফল বলতে গেলে, সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার ছিল মনস্তাত্ত্বিক। ভয়, অবিশ্বাস, ও অতীতের ক্ষত এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলে এসেছে—যেন এক অদৃশ্য সীমানা আমাদের ভেতরেই বসে গেছে। স্বাধীনতার আনন্দের আড়ালে তাই রয়ে গেছে এক দীর্ঘশ্বাসও, যা আজ আরও গভীর থেকে গভীর। আদতে দেশভাগ বা পার্টিশনের রূপান্তর ঘটেই চলেছে এখনো।
লেখক: লেখক ও অনুবাদক
নব্বইয়ের ক্লান্তি কিংবা বার্ধক্য-জরায় যতীন স্যার কখনোই নিঃসঙ্গতায় ছিলেন না। বাংলার প্রাকৃতজনের দার্শনিক জ্ঞান ও শান্তির দ্রোণাচার্য যতীন সরকার জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাতপাই, রামকৃষ্ণ রোডের 'বানপ্রস্থ' নামের বাড়িতে মানুষের সান্নিধ্যেই থাকতেন।
১ দিন আগেতারেক মাসুদ নামটি খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ কাজ নয়। আমি তাঁর ছাত্র, অনুসারী, সহযোগী বা উত্তরসূরি হলেও অন্য অনেকের মতোই আমিও তাঁকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম। কিন্তু এই ভাই ডাকার অভ্যস্ততা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এত গভীরে প্রোত্থিত যে আনুষ্ঠানিক কারণেও শুধু নামটি উচ্চারণে আমার অস্বস্তি হয়।
১ দিন আগেমাত্র ২৮ বছরের তরুণ ছিলেন আল-জাজিরার ফিলিস্তিনি প্রতিবেদক আনাস আল শরীফ। স্পষ্টতার সঙ্গে তুলে ধরতেন ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার অমানবিক রূপ। তাঁর প্রতিবেদনে প্রাণহীন শুষ্ক তথ্য ছাড়িয়ে উঠে আসত অবরুদ্ধ জীবনের নিখাদ ও অনাবৃত প্রতিচ্ছবি।
২ দিন আগেহুমায়ুন আজাদ আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বের লেখক হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত; নিজেও কবিতা লেখার ফিরিস্তি হিসেবে সেই পরিচয়কে বিশেষভাবে জাহির করেছেন। শিল্পের নির্মাণে এবং শিল্পের উপস্থাপন-কৌশলের বেলায়ও এই বিষয় সত্য বলে প্রতীয়মান হবে তাঁর সাহিত্য-পাঠের বেলায়।
২ দিন আগে