সীমান্ত সংঘাত
মো. রাশেদুল ইসলাম
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া হঠাৎ করেই যেন সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। গত ২৪ জুলাই সকালে বিশ্বকে চমকে দিয়ে কম্বোডিয়ার গোলা ছুটে গেল প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের উদ্দেশে। প্রতি-উত্তর দিতে দেরি করেনি থাই সেনারাও। সেই থেকে গোলা পাল্টা-গোলা নিক্ষেপ চলছে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে।
কম্বোডিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য ইতিমধ্যেই এফ-১৬ জঙ্গি বিমান ব্যবহার করেছে থাইল্যান্ড। এ পর্যন্ত হতাহত হয়েছে কয়েক ডজন সামরিক ও বেসামরিক মানুষ। যুদ্ধ-বিরতির ব্যাপারে আলোচনা চললেও থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে উত্তেজনা যেন থামছেই না। যেকোনো সময় আবার শুরু হতে পারে সংঘাত। সীমান্তের দুই পাশের সাধারণ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে নিরাপদ স্থানে। তারা শীঘ্রই ঘরে ফিরতে পারবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, এই আঞ্চলিক প্রসারণের সম্ভাবনাও ভাবাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোকে।
সীমানা নিয়ে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বিবাদের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৮৬৩ সালে কম্বোডিয়ায় ফরাসি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের একটি আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। থাইল্যান্ডের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয় হয় মূলত ১৯০৭ সালে।
এই বিতর্কিত সীমানা নিয়েই ১৯৫৩ সালে স্বাধীনতা লাভ করে কম্বোডিয়া। সেই থেকে একট লম্বা সময় পর্যন্ত সীমান্ত নিয়ে বড় ধরনের কোনো সংঘাতে জড়ায়নি দুই দেশ। ২০০৮ সালে কম্বোডিয়া যখন থাই সীমান্তের বিবদমান এলাকায় অবস্থিত একাদশ শতকের হিন্দু মন্দির প্রেয়া বিহেয়ারকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্তির চেষ্টা করে তখনি বড় বাধা আসে থাইল্যান্ডের দিক থেকে।
এর পরের বছরগুলোতে সীমান্ত নিয়ে বিচ্ছিন্ন সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে দেশ দুটি; প্রাণ গেছে দুই দেশের বেশ কিছু সেনার। বিষয়টি সুরাহার জন্য কম্বোডিয়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও যায় —প্রথমে ১৯৬৩ সালে ও পরে ২০১১ সালে। ২০১৩ সালে আদালত কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দেয় এবং মন্দির ও তার সংলগ্ন এলাকার দায়িত্ব দেশটির ওপর অর্পণ করে। কিন্তু আদালত ‘এমেরাল্ড ট্রায়াঙ্গল’ নামে পরিচিত কম্বোডিয়া, লাওস ও থাইল্যান্ডের বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চলের অন্যান্য ইস্যু সম্পর্কে কোনো সমাধান দেয়নি। অন্যদিকে, থাইল্যান্ড প্রেয়া বিহেয়ার মন্দির নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়কেও মেনে নেয়নি।
এ বছর মে মাসে সীমান্তে একজন কম্বোডীয় সেনা নিহত হলে সীমানা নিয়ে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় থাইল্যান্ড থেকে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সেবা এবং জ্বালানিসহ বিভিন্ন থাই পণ্য আমদানি বন্ধ করার ঘোষণা দেয় কম্বোডিয়া। ১৫ জুন তৎকালীন থাই প্রধানমন্ত্রী পেতোংতার্ন সিনাওয়াত্রা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কম্বোডিয়ার রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলেন। কিন্তু তাতে উত্তেজনা তেমন কমেনি। বরং, বিষয়টি চলমান বিবাদে নতুন মাত্রা যোগ করে।
সিনাওয়াত্রার সঙ্গে হুন সেনের কথোপকোথন ফাঁস হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায়, হুন সেন নিজেই এটা করিয়েছেন। এর ফলে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন সিনাওয়াত্রা। উল্লেখ্য, পেতোংতার্ন সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের সাবেক প্র্ধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার কন্যা। বর্তমানে পেতোংতার্ন থাইল্যান্ডের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন হুন সেনের ছেলে হুন মানেত।
এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই ১৬ ও ২৩ জুলাই সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণ ঘটে। এতে করে বেশ কিছু থাই সীমান্তরক্ষী আহত হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। কম্বোডিয়া থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে থাইল্যান্ড। প্রতিক্রিয়া হিসেবে কম্বোডিয়াও থাইল্যান্ডে নিযুক্ত তার রাষ্ট্রদূতকে সরিয়ে নেয়। সীমান্তের বেশ কয়েকটি চেক পয়েন্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
অবশেষে ২৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার, দুই দেশ তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত যুদ্ধ শুরু করে। কে যুদ্ধ শুরু করেছে সে ব্যপারে দুই দেশই পরস্পরকে দায়ী করছে। ইতিমধ্যেই ৩০ জনের বেশি মানুষ এই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। প্রায় দুই লাখ মানুষকে সীমান্ত অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। আশার কথা হলো, গত দুই দিনে সংঘর্ষ অনেকটা কমে এসেছে। দেশ দুটি মালয়েশিয়ায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে।
এখানে লক্ষণীয় যে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত নিরসনে আসিয়ান অঞ্চলের অন্যতম রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করছে। আসিয়ানের অন্যতম নেতা হিসেবে মালয়েশিয়ার আগ্রহের বিষয়টি বেশ পরিস্কার। দেশটি চাইবে না যে তার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হোক।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি এ সংঘাতের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব নিশ্চয়ই মালয়শিয়াসহ আসিয়ানের অন্য সদস্যদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। অন্যদিকে, এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের আগ্রহের বিষয়টি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক কতৃত্বের সঙ্গেও সম্পর্কিত। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া এই দুই পরাশক্তির সঙ্গেই একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। তবে কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাইল্যান্ডের রয়েছে শক্তিশালী অংশীদারত্ব।
যুক্তরাষ্ট্র থাইল্যান্ডকে এই অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি ও কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশী দেশ হিসেবেই দেখে থাকে। থাইল্যান্ডের সামরিক সরঞ্জামাদির একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। চলমান সংঘাতে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান ব্যবহার করে দেশটি ইতিমধ্যে সে প্রমাণও রেখেছে।
এর বিপরীতে, কম্বোডিয়ার কৌশলগত জোরদার সম্পর্ক রয়েছে চীনের সঙ্গে। দেশটি ১৯৮০-এর দশকে সমাজতন্ত্রের পথ থেকে সরে এসে বাজার অর্থনীতির পথে হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু ‘চৈনিক সমাজতান্ত্রিক’ দেশ চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভে কম্বোডিয়ার রয়েছে এক বিশেষ অবস্থান। সামরিক ও অর্থনৈতিক—সব দিক থেকেই দেশটি মূলত চীনের ওপর নির্ভরশীল।
সুতরাং, থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার সংঘাত যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ‘মাথাব্যথার’ কারণ হবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা সেটিই দেখছি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই সংকট নিরসনে তাঁর আগ্রহের কথা প্রচার করেছেন। তাঁর সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিওর দূতিয়ালিও বেশ চোখে পড়ার মতো। ধারণা করা যায়, এই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোনো সংঘাতে প্রচ্ছন্নভাবে জড়ানোরও কোনো সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের নেই, বিশেষত যে সংঘাতে চীনের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
অন্যদিকে, মালয়েশিয়াসহ অন্য আসিয়ান দেশসমূহ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ‘দ্য আসিয়ান ওয়ে’র ভাবমূর্তি নিয়েও বেশ শঙ্কিত। মিয়ানমারের দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ, শরণার্থী সংকট ইত্যাদি ইতিমধ্যেই আসিয়ানের মধ্যে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া, আসিয়ানের প্রতিবেশী দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্যেও এ সংঘাত চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ করে এ অঞ্চলের শ্রম বাজারের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ এ সংঘাতকে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গেই পর্যবেক্ষণ করছে। কেননা, বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে নানা কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে; এর ফলে ভারতে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর নীতি অবলম্বন করেছে ভারত সরকার।
এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা, ব্যবসা ও ভ্রমণের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশীদের প্রধান বিকল্প। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও বাংলাদেশীদের ভিসাপ্রাপ্তি কঠিন হয়ে উঠেছে । থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত সংঘাত বাংলাদেশের এই ভিসা সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
শেষ কথা হলো, যুদ্ধ-ভারাক্রান্ত বিশ্ব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন। থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার এ সীমান্ত সংঘাত বন্ধ করার যে উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নেয়া হয়েছে তাকে স্বাগত জানাচ্ছে সবাই। আপাতত মালয়েশিয়ার দিকেই চোখ থাকবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মানুষের।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া হঠাৎ করেই যেন সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। গত ২৪ জুলাই সকালে বিশ্বকে চমকে দিয়ে কম্বোডিয়ার গোলা ছুটে গেল প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের উদ্দেশে। প্রতি-উত্তর দিতে দেরি করেনি থাই সেনারাও। সেই থেকে গোলা পাল্টা-গোলা নিক্ষেপ চলছে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে।
কম্বোডিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য ইতিমধ্যেই এফ-১৬ জঙ্গি বিমান ব্যবহার করেছে থাইল্যান্ড। এ পর্যন্ত হতাহত হয়েছে কয়েক ডজন সামরিক ও বেসামরিক মানুষ। যুদ্ধ-বিরতির ব্যাপারে আলোচনা চললেও থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে উত্তেজনা যেন থামছেই না। যেকোনো সময় আবার শুরু হতে পারে সংঘাত। সীমান্তের দুই পাশের সাধারণ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে নিরাপদ স্থানে। তারা শীঘ্রই ঘরে ফিরতে পারবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, এই আঞ্চলিক প্রসারণের সম্ভাবনাও ভাবাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোকে।
সীমানা নিয়ে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বিবাদের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৮৬৩ সালে কম্বোডিয়ায় ফরাসি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের একটি আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। থাইল্যান্ডের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয় হয় মূলত ১৯০৭ সালে।
এই বিতর্কিত সীমানা নিয়েই ১৯৫৩ সালে স্বাধীনতা লাভ করে কম্বোডিয়া। সেই থেকে একট লম্বা সময় পর্যন্ত সীমান্ত নিয়ে বড় ধরনের কোনো সংঘাতে জড়ায়নি দুই দেশ। ২০০৮ সালে কম্বোডিয়া যখন থাই সীমান্তের বিবদমান এলাকায় অবস্থিত একাদশ শতকের হিন্দু মন্দির প্রেয়া বিহেয়ারকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্তির চেষ্টা করে তখনি বড় বাধা আসে থাইল্যান্ডের দিক থেকে।
এর পরের বছরগুলোতে সীমান্ত নিয়ে বিচ্ছিন্ন সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে দেশ দুটি; প্রাণ গেছে দুই দেশের বেশ কিছু সেনার। বিষয়টি সুরাহার জন্য কম্বোডিয়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও যায় —প্রথমে ১৯৬৩ সালে ও পরে ২০১১ সালে। ২০১৩ সালে আদালত কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দেয় এবং মন্দির ও তার সংলগ্ন এলাকার দায়িত্ব দেশটির ওপর অর্পণ করে। কিন্তু আদালত ‘এমেরাল্ড ট্রায়াঙ্গল’ নামে পরিচিত কম্বোডিয়া, লাওস ও থাইল্যান্ডের বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চলের অন্যান্য ইস্যু সম্পর্কে কোনো সমাধান দেয়নি। অন্যদিকে, থাইল্যান্ড প্রেয়া বিহেয়ার মন্দির নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়কেও মেনে নেয়নি।
এ বছর মে মাসে সীমান্তে একজন কম্বোডীয় সেনা নিহত হলে সীমানা নিয়ে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় থাইল্যান্ড থেকে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সেবা এবং জ্বালানিসহ বিভিন্ন থাই পণ্য আমদানি বন্ধ করার ঘোষণা দেয় কম্বোডিয়া। ১৫ জুন তৎকালীন থাই প্রধানমন্ত্রী পেতোংতার্ন সিনাওয়াত্রা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কম্বোডিয়ার রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলেন। কিন্তু তাতে উত্তেজনা তেমন কমেনি। বরং, বিষয়টি চলমান বিবাদে নতুন মাত্রা যোগ করে।
সিনাওয়াত্রার সঙ্গে হুন সেনের কথোপকোথন ফাঁস হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায়, হুন সেন নিজেই এটা করিয়েছেন। এর ফলে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন সিনাওয়াত্রা। উল্লেখ্য, পেতোংতার্ন সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের সাবেক প্র্ধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার কন্যা। বর্তমানে পেতোংতার্ন থাইল্যান্ডের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন হুন সেনের ছেলে হুন মানেত।
এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই ১৬ ও ২৩ জুলাই সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণ ঘটে। এতে করে বেশ কিছু থাই সীমান্তরক্ষী আহত হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। কম্বোডিয়া থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে থাইল্যান্ড। প্রতিক্রিয়া হিসেবে কম্বোডিয়াও থাইল্যান্ডে নিযুক্ত তার রাষ্ট্রদূতকে সরিয়ে নেয়। সীমান্তের বেশ কয়েকটি চেক পয়েন্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
অবশেষে ২৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার, দুই দেশ তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত যুদ্ধ শুরু করে। কে যুদ্ধ শুরু করেছে সে ব্যপারে দুই দেশই পরস্পরকে দায়ী করছে। ইতিমধ্যেই ৩০ জনের বেশি মানুষ এই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। প্রায় দুই লাখ মানুষকে সীমান্ত অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। আশার কথা হলো, গত দুই দিনে সংঘর্ষ অনেকটা কমে এসেছে। দেশ দুটি মালয়েশিয়ায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে।
এখানে লক্ষণীয় যে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত নিরসনে আসিয়ান অঞ্চলের অন্যতম রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করছে। আসিয়ানের অন্যতম নেতা হিসেবে মালয়েশিয়ার আগ্রহের বিষয়টি বেশ পরিস্কার। দেশটি চাইবে না যে তার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হোক।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি এ সংঘাতের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব নিশ্চয়ই মালয়শিয়াসহ আসিয়ানের অন্য সদস্যদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। অন্যদিকে, এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের আগ্রহের বিষয়টি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক কতৃত্বের সঙ্গেও সম্পর্কিত। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া এই দুই পরাশক্তির সঙ্গেই একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। তবে কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাইল্যান্ডের রয়েছে শক্তিশালী অংশীদারত্ব।
যুক্তরাষ্ট্র থাইল্যান্ডকে এই অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি ও কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশী দেশ হিসেবেই দেখে থাকে। থাইল্যান্ডের সামরিক সরঞ্জামাদির একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। চলমান সংঘাতে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান ব্যবহার করে দেশটি ইতিমধ্যে সে প্রমাণও রেখেছে।
এর বিপরীতে, কম্বোডিয়ার কৌশলগত জোরদার সম্পর্ক রয়েছে চীনের সঙ্গে। দেশটি ১৯৮০-এর দশকে সমাজতন্ত্রের পথ থেকে সরে এসে বাজার অর্থনীতির পথে হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু ‘চৈনিক সমাজতান্ত্রিক’ দেশ চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভে কম্বোডিয়ার রয়েছে এক বিশেষ অবস্থান। সামরিক ও অর্থনৈতিক—সব দিক থেকেই দেশটি মূলত চীনের ওপর নির্ভরশীল।
সুতরাং, থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার সংঘাত যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ‘মাথাব্যথার’ কারণ হবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা সেটিই দেখছি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই সংকট নিরসনে তাঁর আগ্রহের কথা প্রচার করেছেন। তাঁর সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিওর দূতিয়ালিও বেশ চোখে পড়ার মতো। ধারণা করা যায়, এই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোনো সংঘাতে প্রচ্ছন্নভাবে জড়ানোরও কোনো সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের নেই, বিশেষত যে সংঘাতে চীনের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
অন্যদিকে, মালয়েশিয়াসহ অন্য আসিয়ান দেশসমূহ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ‘দ্য আসিয়ান ওয়ে’র ভাবমূর্তি নিয়েও বেশ শঙ্কিত। মিয়ানমারের দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ, শরণার্থী সংকট ইত্যাদি ইতিমধ্যেই আসিয়ানের মধ্যে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া, আসিয়ানের প্রতিবেশী দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্যেও এ সংঘাত চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ করে এ অঞ্চলের শ্রম বাজারের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ এ সংঘাতকে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গেই পর্যবেক্ষণ করছে। কেননা, বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে নানা কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে; এর ফলে ভারতে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর নীতি অবলম্বন করেছে ভারত সরকার।
এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা, ব্যবসা ও ভ্রমণের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশীদের প্রধান বিকল্প। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও বাংলাদেশীদের ভিসাপ্রাপ্তি কঠিন হয়ে উঠেছে । থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত সংঘাত বাংলাদেশের এই ভিসা সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
শেষ কথা হলো, যুদ্ধ-ভারাক্রান্ত বিশ্ব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন। থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার এ সীমান্ত সংঘাত বন্ধ করার যে উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নেয়া হয়েছে তাকে স্বাগত জানাচ্ছে সবাই। আপাতত মালয়েশিয়ার দিকেই চোখ থাকবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মানুষের।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাঁদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তাঁরা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাতচল্লিশের সেই দেশভাগ বা পার্টিশনের প্রভাব এখনো বহন করে চলেছি আমরা। একে কোনো একরৈখিক বয়ানে বেঁধে ফেলা দুষ্কর।
৯ ঘণ্টা আগেনব্বইয়ের ক্লান্তি কিংবা বার্ধক্য-জরায় যতীন স্যার কখনোই নিঃসঙ্গতায় ছিলেন না। বাংলার প্রাকৃতজনের দার্শনিক জ্ঞান ও শান্তির দ্রোণাচার্য যতীন সরকার জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাতপাই, রামকৃষ্ণ রোডের 'বানপ্রস্থ' নামের বাড়িতে মানুষের সান্নিধ্যেই থাকতেন।
১ দিন আগেতারেক মাসুদ নামটি খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ কাজ নয়। আমি তাঁর ছাত্র, অনুসারী, সহযোগী বা উত্তরসূরি হলেও অন্য অনেকের মতোই আমিও তাঁকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম। কিন্তু এই ভাই ডাকার অভ্যস্ততা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এত গভীরে প্রোত্থিত যে আনুষ্ঠানিক কারণেও শুধু নামটি উচ্চারণে আমার অস্বস্তি হয়।
১ দিন আগেমাত্র ২৮ বছরের তরুণ ছিলেন আল-জাজিরার ফিলিস্তিনি প্রতিবেদক আনাস আল শরীফ। স্পষ্টতার সঙ্গে তুলে ধরতেন ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার অমানবিক রূপ। তাঁর প্রতিবেদনে প্রাণহীন শুষ্ক তথ্য ছাড়িয়ে উঠে আসত অবরুদ্ধ জীবনের নিখাদ ও অনাবৃত প্রতিচ্ছবি।
২ দিন আগে