leadT1ad

মার্কিন নথিতে কিসিঞ্জারের মন্তব্য, ‘আমরা কি তাঁকে (শেখ মুজিব) এটা গত বছর বলিনি?’

মুজিব হত্যার পর পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জারের বৈঠকে যা হয়েছিল

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করে একদল সেনা সদস্য। ওই দিন সকাল ৮টায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন।

ওই বৈঠকে তিনি মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়, শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভারতের প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান এবং বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে—এসব নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের সেই কথপোকথনে উঠে এসেছে কৌতুহলোদ্দীপক এক তথ্য, শেখ মুজিবুর রহমানকে কয়েক মাস আগেই তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন সরকারের অবমুক্ত করা গোপন নথি থেকে এসব জানা গেছে।

১৫ আগস্টের সেই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথোপকথনের অংশটুকু এখানে তুলে ধরা হলো

কিসিঞ্জার: আসুন, এবার আমরা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলি।

অ্যাথারটন (পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা): এটি ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত এক অভ্যুত্থান।

কিসিঞ্জার: এর মানে কী? মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন?

‘বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের আগে আমরা ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই করব না। যোগাযোগ স্থাপনের পর আমরা তাদের মতামত শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করব।’

অ্যাথারটন: মুজিবুর রহমান মারা গেছেন। তাঁর পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের অনেককেও হত্যা করা হয়েছে। যেমন তাঁর ভাই-ভাতিজাকেও হত্যা করা হয়েছে।

কিসিঞ্জার: আমি তো ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ ব্যুরো (আইএনআর) থেকে ভালো তথ্য পাই।

হাইল্যান্ড (আইএনআর): আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তখনও তিনি মারা যাননি।

কিসিঞ্জার: সত্যি? তাহলে কি কিছু সময় পর তাঁকে হত্যা করা হয়?

অ্যাথারটন: যতদূর আমরা জানি—সব তথ্য এখনো আমাদের হাতে আসেনি। কিন্তু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে পরিকল্পনাই ছিল তাঁকে হত্যা করার। তারা তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে ভেতরে গিয়ে হত্যা করেছে। আপাতত এটুকুই জানা গেছে।

কিসিঞ্জার: আমরা কি তাঁকে এটা গত বছর বলিনি?

অ্যাথারটন: মার্চ মাসে (১৯৭৫) আমাদের কাছে অনেক ইঙ্গিত ছিল।

কিসিঞ্জার: আমরা কি তাঁকে তা জানাইনি?

অ্যাথারটন: তখন আমরা তাঁকে জানিয়েছিলাম।

কিসিঞ্জার: আমরা কি মোটামুটি কারা এর সঙ্গে জড়িত, তাঁদের নামও বলিনি?

অ্যাথারটন: আমি নথিপত্র দেখে বলতে পারব, আমরা তাঁকে নামগুলো দিয়েছিলাম কি না।

হাইল্যান্ড: আমরা সে বিষয়ে কিছুটা অস্পষ্ট ছিলাম।

অ্যাথারটন: তিনি সেটাকে তুচ্ছ করে উড়িয়ে দেন। বলেন, কেউ তাঁর সঙ্গে এমন কিছু করতে পারবে না।

কিসিঞ্জার: তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বোকাদের একজন।

অ্যাথারটন: তবে মনে হচ্ছে, অভ্যুত্থানকারীরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

কিসিঞ্জার: তাঁরা কারা?

অ্যাথারটন: তাঁরা সামরিক কর্মকর্তা—মধ্য ও জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের—যাঁরা আগের নেতৃত্বের তুলনায় কম ভারতপন্থী। যাঁরা অনেকটা মার্কিনপন্থী এবং সোভিয়েতবিরোধীও।

কিসিঞ্জার: এটা সম্পূর্ণ অনিবার্য ছিল।

অ্যাথারটন: ইসলামপন্থীও বটে। তাঁরা দেশের নাম বদলে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ রেখেছে।

কিসিঞ্জার: তাঁরা যে মার্কিনপন্থী হবে, তা অনিবার্য ছিল না; বরং আমি ভেবেছিলাম, কোনো এক পর্যায়ে তারা চীনপন্থী হয়ে যাবে। তবে ভারতবিরোধী যে হবে, তা আমি নিশ্চিতভাবেই আশা করেছিলাম।

অ্যাথারটন: আমার মনে হয়, আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এড়িয়ে চলা।

কিসিঞ্জার: কেন? তারা আমাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ বলে কি?

অ্যাথারটন: আমার মনে হয়, তারা আমাদের কাছে প্রতিশ্রুতি চাইবে।

‘আমার মনে হয়, আমাদের নীতি হওয়া উচিত যে আমরা যতটা সাহায্য দিতে পারি বা বাংলাদেশ যতটা সাহায্য গ্রহণ করতে পারে, ততটাই দেওয়া।’

কিসিঞ্জার: তাহলে কি আমাদের নীতি এই যে, উপমহাদেশে আমরা শুধু সেই শক্তির সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ হই, যারা আমাদের বিরোধিতা করে? আসল নীতি তাহলে কী?

অ্যাথারটন: আমার মনে হয় আমাদের নীতি হওয়া উচিত যে, আমরা যতটা সাহায্য দিতে পারি বা বাংলাদেশ যতটা সাহায্য গ্রহণ করতে পারে, ততটাই দেওয়া।

কিসিঞ্জার: এই নীতি বাস্তবায়নের আগে আরেকটু ভাবা দরকার। আমি জানি, আমরা বড় ধরনের সাহায্য বৃদ্ধি করতে পারব না। কিন্তু যদি নিজেদের মার্কিনপন্থী ভাবা লোকেরা আমাদের কাছে এসে শুধুই টেকনিক্যাল ব্যাখ্যা শোনে যে, আমরা আর কিছু দিতে পারব না—তাহলে অন্তত খাদ্য সহায়তায় কিছুটা সুযোগ বের করা উচিৎ এবং প্রতীকীভাবে হলেও সাহায্য বাড়ানো উচিত।

এন্ডারস (পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা): খাদ্য সহায়তা কিছুটা বাড়ানো সম্ভব।

কিসিঞ্জার: আমি চাই তারা এই সহায়তা পাক। যদিও আমি এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নই।

অ্যাথারটন: এগুলো সব প্রাথমিক ইঙ্গিত মাত্র।

কিসিঞ্জার: তাহলে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ অভ্যর্থনা পাওয়া উচিত।

অ্যাথারটন: আমার মনে হয়, তাৎক্ষণিক প্রশ্ন হলো, আমরা নতুন সরকারের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করব। আমার মতে, আজ সকালে আপনাকে পাঠানো মেমোতে যা লেখা হয়েছে—যেটি আমি ভালোভাবে পড়ার সময় পাইনি—আমাদের উচিত হবে তাদের যেকোনো উদ্যোগের জবাব দেওয়া।

কিসিঞ্জার: মেমোতে কী লেখা ছিল?

অ্যাথারটন: সেখানে বলা হয়েছে, স্বীকৃতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া আপাতত স্থগিত রাখা উচিত। তবে আমার মনে হয়, বিষয়টিকে এত তীব্রভাবে তোলার দরকার নেই।

কিসিঞ্জার: আমাদের তাদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

অ্যাথারটন: এই ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেওয়ার মানেটা কী হবে, সেটা আমি নিশ্চিত নই। আমার মনে হয়, আমরা কেবল…

সিসকো (পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা): শুধু চালিয়ে যাওয়া। মেমোতে আরও বলা হয়েছিল যে এ বিষয়ে ভারতকে জানাতে হবে, যেন ভারতকে এক ধরনের ভেটো ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। আমি একদমই এর সঙ্গে একমত নই।

অ্যাথারটন: আমার মনে হয়, কিছু মতবিনিময় করা উপকারী হতে পারে…

কিসিঞ্জার: আমরা একেবারেই ভারতকে এ ব্যাপারে আগে জানাব না।

অ্যাথারটন: আমি মনে করি, তাদের সঙ্গে কিছুটা আলোচনায় হয়তো আমাদের উপকার হতে পারে।

কিসিঞ্জার: বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের আগে আমরা ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই করব না। যোগাযোগ স্থাপনের পর আমরা তাদের মতামত শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করব। তবে শর্ত এই যে, তারা যেন স্পষ্টভাবে বোঝে—আমাদের কী করতে হবে, তা তারা বলে দিতে পারবে না। আর তারা বাংলাদেশের কাছে গিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাদের কোনও মতামতও চাইতে পারবে না।

অ্যাথারটন: আমি পুরোপুরি একমত।

কিসিঞ্জার: কিন্তু ভারত খুব করে সেটাই করতে চাইবে। তুমি বরং যে কোনো প্রস্তাব আগে আমাকে দেখিয়ে নিও।

অ্যাথারটন: আজই আমাদের একটি টেলিগ্রামের খসড়া তৈরি করতে হবে এবং আমরা তা আপনার অনুমোদনের জন্য দেব, যেটি ভারতের কাছে পাঠানো হবে। আর পাকিস্তানও গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের দিকেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

কিসিঞ্জার: আমি তোমার সঙ্গে ভুট্টোকে দেওয়ার জন্য একটি গুরুতর নির্দেশনা এবং তার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কিছু বিষয় নিয়ে আরও কয়েক মিনিট কথা বলতে চাই। ঠিক আছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত