নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন
স্ট্রিম ডেস্ক
মাত্র এক বছর আগে, বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নির্মম দমন-পীড়ন চালান। তখন রংপুরে পুলিশের সামনে আবু সাঈদ নামে একজন নিরস্ত্র শিক্ষার্থী দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ান।
তার পরিবার বলেছে, ওই ভাবে দাঁড়ানোর কিছু সময়ের মধ্যে পুলিশ তাঁকে গুলি করে। এতে গুরুতর আহত এবং পরবর্তী তিনি মারা যান। সেই সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। আবু সাঈদ তাদেরই একজন। তাঁর মৃত্যু আন্দোলনে গতি এনে দেয়। এক পর্যায়ে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়।
ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। দেশকে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে রেখে তিনি পালিয়ে গেলেও, তখন জনসাধারণের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল।
শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ পুনর্গঠন করতে চেয়েছিল। তারা ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক দেশ গড়তে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করেন, যাঁর দায়িত্ব ছিল জাতিকে বিশৃঙ্খলা থেকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু পরিবর্তনের মন্থর গতি অনেক বাংলাদেশিকে হতাশ করেছে। তারা এখন ভাবছেন, আবু সাঈদের মতো প্রতিবাদকারীরা কী বৃথাই জীবন উৎসর্গ করলেন?
ড. ইউনূসের সরকার বাংলাদেশে দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অভাব এবং বিদ্যমান আমলাতন্ত্রের মতো পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো দূর করতে সংগ্রাম করছে। এসব সমস্যাই হাসিনার বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ উসকে দিয়েছিলো।
গণতান্ত্রিক সংস্কার দ্রুত শুরুর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তারা গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার জন্য শেখ হাসিনা, তাঁর রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্রুত শাস্তির দাবি করেছেন।
আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, এটি আমাকে পীড়া দেয়। আমরা ভেবেছি দেশ নৈতিকভাবে আরও ভালো হবে। বৈষম্যের অবসান হবে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, খুনিদের শাস্তি হবে এবং সেই শাস্তি অপরাধীদের মধ্যে ভয় জাগাবে। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটছে না।
নতুন শুরু
বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আর এই দেশের সংস্কারের ভার এখন ড. ইউনূসের কাঁধে। বাংলাদেশে এখনো বিভাজন রয়ে গেছে এবং দেশটিতে প্রায় ৬০টি রাজনৈতিক দল রয়েছে।
ড. ইউনূসের প্রথম কাজ ছিল আইন-শৃঙ্খলা ফেরানো। গণ-অভ্যুত্থানের পর লুটপাট, দাঙা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। যদিও বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন বেশ স্থিতিশীল। তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু সংখ্যালঘু এবং শেখ হাসিনার সমর্থকদের ওপর সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে। অন্যদিকে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা তাদের অবস্থান নিশ্চিতে চেষ্টা চালাচ্ছে।
ড. ইউনূসের দ্বিতীয় কাজ ছিল ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ এবং পুলিশ সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করেন। এসবের প্রধান লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। কিন্তু পরিবর্তন খুব কমই হয়েছে। আর এসবই আশাকে নিরাশায় পরিণত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ সালেহীন অয়ন বলেন, এখন সবকিছুই এলোমেলো মনে হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালীন তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।
তিনি বলেন, আমাদের স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে। ছাত্রনেতারা তাড়াহুড়ো করে তাদের যে পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন, তার গতি ক্রমশ কমে আসছে।
এরইমধ্যে ড. ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধের কারণে নির্বাচনের আগে অনেক কিছুর সমাধান করা প্রয়োজন। শেখ হাসিনার পতনের প্রথমবার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, তার সরকার একটি ‘সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়া’ দেশের দায়িত্ব নিয়েছিল। তবে সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেন, তিনি নির্বাচিত সরকারের কাছে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ড. ইউনূসের শাসনকালের অর্ধেকেরও বেশি সময় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনের সময় নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। দলটি জোর দিয়ে বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কেবল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে। আর বাকি পরিবর্তন নির্বাচিত সরকার এসে করবে। তবে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য ড. ইউনূসকে সমর্থন দিচ্ছেন।
কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো দেখভালে গঠিত জাতীয় ঐক্য কমিশনের ভাইস-চেয়ারম্যান ড. আলী রিয়াজ বলেছেন, প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল দুই মাস ধরে সাংবিধানিক ও শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করছে। তারা ‘বড় কোনো বিতর্ক ছাড়াই’ তা করেছেন। এটি অগ্রগতির আশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দল স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ নির্ধারণের মতো বিষয়গুলোতে একমত হয়েছে।
রাজনৈতিক ভাঙন
১৭ কোটি ১০ লাখ মানুষের বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতা নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। প্রধানত দুটি রাজনৈতিক দল দেশটির রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল। এর একটি আওয়ামী লীগ। দলটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, তিনি শেখ হাসিনার বাবা। অন্যদিকে, স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন জিয়াউর রহমান। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন লন্ডন থেকে দলটি তাঁর ছেলে পরিচালনা করছেন।
একটা সময় পর্যন্ত এই দুই প্রধান দলই দেশের ক্ষমতায় পালাক্রমে যেত। কারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচন বয়কট করেছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হয়তো থাকবে না। কারণ দেশে তাদের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ।
দেশটির নতুন রাজনৈতিক দলগুলো গ্রাম এবং মফস্বল শহর এলাকার জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে তাদের কর্মকাণ্ড বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম ড. ইউনূস সরকার থেকে পদত্যাগ করে গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেন। সমর্থন বাড়াতে দলটি গত জুলাইয়ে ‘দেশ গড়তে’ সারাদেশে জুলাই পদযাত্রা নামে কর্মসূচি পালন করে।
সব দলের জন্যই তরুণ ভোটাররা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অর্ধেক নাগরিকের বয়স প্রায় ২৬ বছরের কাছাকাছি। আর দেশের অনেক তরুণ কেবল হাসিনার শাসনকাল দেখেই বড় হয়েছেন।
গত বছর আন্দোলনে অংশ নেওয়া চলচ্চিত্র নির্মাতা সাঈদ খান সাগর বলেন, একটি প্রজন্ম হিসেবে গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের ভালো ধারণা নেই, কারণ আমরা তা দেখিনি। তাই রাষ্ট্রের উচিত সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা— যেখানে ভয় ছাড়াই নাগরিকরা শান্তিতে বসবাস করবেন।
ঢাকায় কমিউনিটি গ্রুপগুলোর সঙ্গে কাজ করেন বাংলাদেশি আমেরিকান থাহিতুন মরিয়ম। তিনি ঐতিহ্যবাহী সমাজে নারীদের প্রান্তিকীকরণের দিকটি নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। তিনি বলেন, উল্লেখ করার মতো সামাজিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন এবং সংস্কার কেবল ‘পুরুষ-কেন্দ্রিক, পুরুষ-শাসিত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে’ পুনরুজ্জীবিত করবে।
২০২৪ সালের বিক্ষোভে অনেক নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ চোখে পড়েছিল। তারা এখন সেই ভূমিকা থেকে সরে গেছেন। তবে মরিয়ম বলছেন, তিনি এখনও আশাবাদী বাংলাদেশের নতুন গণতন্ত্র আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।
দ্বন্দ্বময় আবেগ
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের বর্ষপূর্তির দিন ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে নিহতরা জাতীয় বীর। ‘শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং ছাত্র বিক্ষোভকারীদের আইনি সুরক্ষা প্রদানের’ ঘোষণাও দেন তিনি। প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার ক্ষোভকে আড়ালে রেখেছিল সরকারের এই আশ্বাস। শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি ২০২৪ সালের জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু সে ব্যাপারে অগ্রগতি এখনও খুব একটা হয়নি।
আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী বলেন, তিনি তার ভাইকে গুলি করার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। এই আদালত ২০০৯ সালে শেখ হাসিনাই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু বিচারের অগ্রগতি খুব কম।
তিনি বলেন, আবু সাঈদ এই আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য শহীদ। যদি তার মামলাটিই সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তাহলে বাংলাদেশে কীভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে?
এদিকে, গণঅভ্যুত্থানে হত্যার ঘটনাগুলোর মামলায় শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার চলছে। তিনি গত সপ্তাহে ভারত থেকে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, যেখানে তিনি ছাত্র অভ্যুত্থানকে ‘গণতন্ত্রে সহিংস ব্যাঘাত’ বলে অভিহিত করেন।
অধিকারকর্মীরা বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, নতুন বাংলাদেশে সঠিক কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
মাত্র এক বছর আগে, বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নির্মম দমন-পীড়ন চালান। তখন রংপুরে পুলিশের সামনে আবু সাঈদ নামে একজন নিরস্ত্র শিক্ষার্থী দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ান।
তার পরিবার বলেছে, ওই ভাবে দাঁড়ানোর কিছু সময়ের মধ্যে পুলিশ তাঁকে গুলি করে। এতে গুরুতর আহত এবং পরবর্তী তিনি মারা যান। সেই সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। আবু সাঈদ তাদেরই একজন। তাঁর মৃত্যু আন্দোলনে গতি এনে দেয়। এক পর্যায়ে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়।
ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। দেশকে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে রেখে তিনি পালিয়ে গেলেও, তখন জনসাধারণের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল।
শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ পুনর্গঠন করতে চেয়েছিল। তারা ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক দেশ গড়তে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করেন, যাঁর দায়িত্ব ছিল জাতিকে বিশৃঙ্খলা থেকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু পরিবর্তনের মন্থর গতি অনেক বাংলাদেশিকে হতাশ করেছে। তারা এখন ভাবছেন, আবু সাঈদের মতো প্রতিবাদকারীরা কী বৃথাই জীবন উৎসর্গ করলেন?
ড. ইউনূসের সরকার বাংলাদেশে দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অভাব এবং বিদ্যমান আমলাতন্ত্রের মতো পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো দূর করতে সংগ্রাম করছে। এসব সমস্যাই হাসিনার বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ উসকে দিয়েছিলো।
গণতান্ত্রিক সংস্কার দ্রুত শুরুর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তারা গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার জন্য শেখ হাসিনা, তাঁর রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্রুত শাস্তির দাবি করেছেন।
আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, এটি আমাকে পীড়া দেয়। আমরা ভেবেছি দেশ নৈতিকভাবে আরও ভালো হবে। বৈষম্যের অবসান হবে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, খুনিদের শাস্তি হবে এবং সেই শাস্তি অপরাধীদের মধ্যে ভয় জাগাবে। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটছে না।
নতুন শুরু
বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আর এই দেশের সংস্কারের ভার এখন ড. ইউনূসের কাঁধে। বাংলাদেশে এখনো বিভাজন রয়ে গেছে এবং দেশটিতে প্রায় ৬০টি রাজনৈতিক দল রয়েছে।
ড. ইউনূসের প্রথম কাজ ছিল আইন-শৃঙ্খলা ফেরানো। গণ-অভ্যুত্থানের পর লুটপাট, দাঙা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। যদিও বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন বেশ স্থিতিশীল। তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু সংখ্যালঘু এবং শেখ হাসিনার সমর্থকদের ওপর সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে। অন্যদিকে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা তাদের অবস্থান নিশ্চিতে চেষ্টা চালাচ্ছে।
ড. ইউনূসের দ্বিতীয় কাজ ছিল ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ এবং পুলিশ সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করেন। এসবের প্রধান লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। কিন্তু পরিবর্তন খুব কমই হয়েছে। আর এসবই আশাকে নিরাশায় পরিণত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ সালেহীন অয়ন বলেন, এখন সবকিছুই এলোমেলো মনে হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালীন তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।
তিনি বলেন, আমাদের স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে। ছাত্রনেতারা তাড়াহুড়ো করে তাদের যে পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন, তার গতি ক্রমশ কমে আসছে।
এরইমধ্যে ড. ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধের কারণে নির্বাচনের আগে অনেক কিছুর সমাধান করা প্রয়োজন। শেখ হাসিনার পতনের প্রথমবার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, তার সরকার একটি ‘সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়া’ দেশের দায়িত্ব নিয়েছিল। তবে সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেন, তিনি নির্বাচিত সরকারের কাছে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ড. ইউনূসের শাসনকালের অর্ধেকেরও বেশি সময় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনের সময় নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। দলটি জোর দিয়ে বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কেবল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে। আর বাকি পরিবর্তন নির্বাচিত সরকার এসে করবে। তবে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য ড. ইউনূসকে সমর্থন দিচ্ছেন।
কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো দেখভালে গঠিত জাতীয় ঐক্য কমিশনের ভাইস-চেয়ারম্যান ড. আলী রিয়াজ বলেছেন, প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল দুই মাস ধরে সাংবিধানিক ও শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করছে। তারা ‘বড় কোনো বিতর্ক ছাড়াই’ তা করেছেন। এটি অগ্রগতির আশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দল স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ নির্ধারণের মতো বিষয়গুলোতে একমত হয়েছে।
রাজনৈতিক ভাঙন
১৭ কোটি ১০ লাখ মানুষের বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতা নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। প্রধানত দুটি রাজনৈতিক দল দেশটির রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল। এর একটি আওয়ামী লীগ। দলটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, তিনি শেখ হাসিনার বাবা। অন্যদিকে, স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন জিয়াউর রহমান। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন লন্ডন থেকে দলটি তাঁর ছেলে পরিচালনা করছেন।
একটা সময় পর্যন্ত এই দুই প্রধান দলই দেশের ক্ষমতায় পালাক্রমে যেত। কারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচন বয়কট করেছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হয়তো থাকবে না। কারণ দেশে তাদের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ।
দেশটির নতুন রাজনৈতিক দলগুলো গ্রাম এবং মফস্বল শহর এলাকার জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে তাদের কর্মকাণ্ড বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম ড. ইউনূস সরকার থেকে পদত্যাগ করে গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেন। সমর্থন বাড়াতে দলটি গত জুলাইয়ে ‘দেশ গড়তে’ সারাদেশে জুলাই পদযাত্রা নামে কর্মসূচি পালন করে।
সব দলের জন্যই তরুণ ভোটাররা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অর্ধেক নাগরিকের বয়স প্রায় ২৬ বছরের কাছাকাছি। আর দেশের অনেক তরুণ কেবল হাসিনার শাসনকাল দেখেই বড় হয়েছেন।
গত বছর আন্দোলনে অংশ নেওয়া চলচ্চিত্র নির্মাতা সাঈদ খান সাগর বলেন, একটি প্রজন্ম হিসেবে গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের ভালো ধারণা নেই, কারণ আমরা তা দেখিনি। তাই রাষ্ট্রের উচিত সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা— যেখানে ভয় ছাড়াই নাগরিকরা শান্তিতে বসবাস করবেন।
ঢাকায় কমিউনিটি গ্রুপগুলোর সঙ্গে কাজ করেন বাংলাদেশি আমেরিকান থাহিতুন মরিয়ম। তিনি ঐতিহ্যবাহী সমাজে নারীদের প্রান্তিকীকরণের দিকটি নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। তিনি বলেন, উল্লেখ করার মতো সামাজিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন এবং সংস্কার কেবল ‘পুরুষ-কেন্দ্রিক, পুরুষ-শাসিত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে’ পুনরুজ্জীবিত করবে।
২০২৪ সালের বিক্ষোভে অনেক নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ চোখে পড়েছিল। তারা এখন সেই ভূমিকা থেকে সরে গেছেন। তবে মরিয়ম বলছেন, তিনি এখনও আশাবাদী বাংলাদেশের নতুন গণতন্ত্র আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।
দ্বন্দ্বময় আবেগ
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের বর্ষপূর্তির দিন ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে নিহতরা জাতীয় বীর। ‘শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং ছাত্র বিক্ষোভকারীদের আইনি সুরক্ষা প্রদানের’ ঘোষণাও দেন তিনি। প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার ক্ষোভকে আড়ালে রেখেছিল সরকারের এই আশ্বাস। শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি ২০২৪ সালের জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু সে ব্যাপারে অগ্রগতি এখনও খুব একটা হয়নি।
আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী বলেন, তিনি তার ভাইকে গুলি করার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। এই আদালত ২০০৯ সালে শেখ হাসিনাই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু বিচারের অগ্রগতি খুব কম।
তিনি বলেন, আবু সাঈদ এই আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য শহীদ। যদি তার মামলাটিই সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তাহলে বাংলাদেশে কীভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে?
এদিকে, গণঅভ্যুত্থানে হত্যার ঘটনাগুলোর মামলায় শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার চলছে। তিনি গত সপ্তাহে ভারত থেকে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, যেখানে তিনি ছাত্র অভ্যুত্থানকে ‘গণতন্ত্রে সহিংস ব্যাঘাত’ বলে অভিহিত করেন।
অধিকারকর্মীরা বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, নতুন বাংলাদেশে সঠিক কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দাবি করেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জনক নন। আজ শুক্রবার (১৫ আগস্ট) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এ মন্তব্য করেন।
৩৬ মিনিট আগেরাস্তার দুই পাশে বেশ কিছু ক্র্যাশার মিল (পাথর ভাঙার কারখানা)। এর সামনে উন্মুক্ত স্তূপ আকারে রাখা আমদানি করা পাথর। তবে মিলের পেছনে থাকা পাথরগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে বালু ও মাটি দিয়ে। একটু মাটি আলগা করলেই বেরিয়ে আসছে পাথরের মজুদ।
১ ঘণ্টা আগে১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করে একদল সেনা সদস্য। ওই দিন সকাল ৮টায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন।
৩ ঘণ্টা আগেঅনেক ঘরবাড়ি প্লাবিত না হলেও সবাই পানিবন্দি রয়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। গোখাদ্যে দেখা দিয়েছে চরম সঙ্কট।
৩ ঘণ্টা আগে