leadT1ad

শেখ মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

যা ছিল ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এর যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথিতে

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
স্ট্রিম গ্রাফিক

১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়। সেই দিনের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো গোপন টেলিগ্রামে ১৬ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ প্রেরণ করা হয়। সেই টেলিগ্রামে বিশ্লেষণ করা হয় শেখ মুজিব-পরবর্তী নতুন সরকারের সম্ভাব্য কার্যক্রম এবং সেনা-নাগরিক সম্পর্ক।

প্রথম ২৪ ঘণ্টার পরিস্থিতি: অভ্যুত্থান চ্যালেঞ্জহীন

প্রথম ২৪ ঘণ্টার ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ১৫ আগস্ট স্থানীয় সময় সকাল ৫টা ১৫ মিনিটে শুরু হওয়া অভ্যুত্থান (ক্যু) চ্যালেঞ্জ করা হবে না। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানেরা, আধাসামরিক বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলস ও রক্ষী বাহিনীর প্রধান এবং পুলিশ প্রধানের নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। জনগণ মুজিবের পতনে কোনো বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করেনি, বরং শান্তিপূর্ণভাবে তা মেনে নিয়েছে এবং সম্ভবত কিছুটা স্বস্তিও অনুভব করেছে। ক্ষমতা বিনিময়ের এই সহজতর প্রক্রিয়া সর্বাধিকভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে মুজিব এবং বাঙালিদের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বাঙালিরা মুজিবের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে। কারণ, তিনি তাঁদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি মূলত ব্যক্তিগত ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বংশপরম্পরাগত সুবিধার জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। মুজিব বাঙালিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কারণ, তিনি যুক্তিসঙ্গত পরামর্শ থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন এবং স্বৈরশাসকের সাধারণ মানসিকতা অনুযায়ী সন্দেহপ্রবণতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন।

জুন মাসের শুরু থেকে শেখ মুজিবের এবং তাঁর ভাগনে শেখ মনির ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখার তীব্র প্রচেষ্টা ক্যু-পরিকল্পনাকারীদের ধারণা দিয়েছিল যে এখন আর দেরি করা সম্ভব নয়। ভারতের স্বাধীনতা দিবস বেছে নেওয়া হয়তো কেবলই কাকতালীয় ছিল, তবে এ মিল আমরা লক্ষ করছি।

নতুন সরকার: ধারাবাহিকতা কিন্তু উদ্দীপনার অভাব

ওই টেলিগ্রামে বলা হয়, ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে যাবে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত মতামত দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বাধীন নতুন বেসামরিক সরকার জনমনে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। শেখ মুজিবের নিকটজনদের হয় মৃত্যুর মাধ্যমে অথবা ক্ষমতার বাইরে রেখে সরকারকে ‘উৎখাত’ করা হয়েছে। তবুও এ সরকার মূলত মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের ব্যর্থ প্রশাসনের সঙ্গে চিহ্নিত অতিপরিচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত। স্পষ্টতই, এর গঠন দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে মোশতাকের অধীনে বাংলাদেশে ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে, তবে একই সঙ্গে কিছুটা সংযমও থাকবে।

জুন মাসের শুরু থেকে শেখ মুজিবের এবং তাঁর ভাগনে শেখ মনির ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখার তীব্র প্রচেষ্টা ক্যু-পরিকল্পনাকারীদের ধারণা দিয়েছিল যে এখন আর দেরি করা সম্ভব নয়।

১৫ আগস্ট রাতের দিকে মোশতাকের রেডিও ভাষণ এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেছে। সেখানে তিনি শেখ মুজিবের শাসনের অভ্যন্তরীণ পরিণতির সমালোচনা করেছেন, তবে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আগের মতোই কার্যক্রম চলবে। ইতিমধ্যে প্রমাণ মিলছে যে নতুন সরকার মুসলিম বিশ্ব, এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করতে চায়। ভারতের প্রতি মোশতাকের বিরূপ মনোভাব সবাই জানেন। তা সত্ত্বেও নতুন সরকার ভারতের মনে অযথা সন্দেহ সৃষ্টি করতে চাইবে না। কারণ তারা ভালোভাবেই জানে—শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে ন্যূনতম সদিচ্ছা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। (সম্ভবত এ জন্যই মন্ত্রিসভা পুরোপুরি পুরোনো মুখের ওপর নির্ভর করে গঠিত হয়েছে, যাতে ভারতের কাছে আগের মন্ত্রীসভার ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখানো যায়।)

বড় শক্তিধর দেশগুলোর প্রসঙ্গে মোশতাক ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন যে তাঁর সরকার যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মতো বড় শক্তির সঙ্গে ‘আরও ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ স্থাপন করতে চায়। এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও ভারসাম্য আনতে চেষ্টা করা হবে এবং এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সম্পর্ক

টেলিগ্রামে আরও বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে নতুন সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মুজিব আমলের চেয়েও আরও সৌহার্দ্যপূর্ণ হতে পারে।

নতুন প্রেসিডেন্ট (মোশতাক) অতীতে প্রকাশ্যভাবেই তাঁর ‘প্রো-আমেরিকান’ মনোভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া পুরনো সরকারের যেসব ব্যক্তি বামপন্থী ও মার্কিনবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত ছিলেন (যেমন শেখ মণি ও সামাদ), তাঁরা এখন আর নেই। একই সঙ্গে এ সম্ভাবনাও প্রবল যে নতুন সরকার আমাদের কাছ থেকে আরও বেশি পরিমাণ সাহায্য চাইবে। মোশতাক অতীতেও আমাদের কাছে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে একমাত্র আমরাই সত্যিকারের বাংলাদেশের সহায়ক হতে পারি। তাই আমাদের জন্য মূল সমস্যা হতে পারে নতুন সরকারের প্রত্যাশাকে সংযত রাখা।

সেনা ও নাগরিক সরকারের সম্পর্ক: অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

টেলিগ্রামে উল্লেখ আছে, বর্তমানে আমরা মোশতাক সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক নির্দিষ্টভাবে বিচার করতে পারছি না। তবে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, প্রতিটি সরকারি বিবৃতিতেই ক্ষমতা দখলে সেনাবাহিনীর ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। আমাদের জানানো হয়েছে যে সেনাবাহিনী বর্তমানে সামরিক আইনসংক্রান্ত আদেশ প্রস্তুত করছে, তা যদি পাকিস্তানি ধারা অনুসরণ করে, তবে দেশের মূল আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াবে কিনা, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে আমাদের ধারণা ছিল, মোশতাকের প্রথম দিককার বিবৃতিগুলোর একটি হবে গত জানুয়ারিতে মুজিব কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া সংবিধানের পরিবর্তে একটি নতুন, আরও উদার সংবিধানের প্রতিশ্রুতি।

বড় শক্তিধর দেশগুলোর প্রসঙ্গে মোশতাক ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন যে তাঁর সরকার যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মতো বড় শক্তির সঙ্গে ‘আরও ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ স্থাপন করতে চায়।

অভিজ্ঞতার কারণে আপাতত বেসামরিক নেতৃত্ব কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তা ছাড়া মুজিবকে অপসারণে সেনাবাহিনীর সফলতার পর আমরা এমন ধারণা পাচ্ছি যে অভ্যুত্থানকারীরা ঘটনাটির পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে খুব বেশি প্রস্তুতি নেননি। তবে সেনাবাহিনী—বিশেষ করে তরুণ অফিসাররা, যারা অভ্যুত্থান পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারাই প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবকে উৎখাত করেছে। তাই আমরা সন্দেহ করি, একবার ‘রক্তের স্বাদ’ পাওয়ার পর তাঁরা অন্তত কিছু মাত্রায় হলেও ঘটনাপ্রবাহের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইবে।

আমাদের মনে করার কারণ নেই যে অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে কোনো ‘বাঙালি গাদ্দাফি’ লুকিয়ে আছে। বরং, তারা পুরোনো, সেবামুখী মধ্যবিত্ত শ্রেণির সদস্য, যাঁদের স্বার্থ শেখ মুজিবের সময় হুমকির মুখে পড়েছিল। ফলে তাঁরা হয়তো পূর্ব পাকিস্তানি আমলের পর থেকে দেখা যেকোনো শক্তির তুলনায় অপেক্ষাকৃত সংযমী ভূমিকা রাখতে পারে।

নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ: স্থায়িত্ব ও অস্থিরতা

একটি বিষয়কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে যদিও শেখ মুজিবকে উৎখাত করা সফল হয়েছে—যদিও রক্তক্ষয়ী—তবু এখনো অনেক কিছু করা বাকি আছে। মোশতাকের ভাষণ মূলত সাধারণ বক্তব্য ও পূর্বের আওয়ামী লীগকে মনে করিয়ে দেওয়া রীতিনীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ এখনো খুব কম দেখা গেছে। আমরা অবাক হইনি যে এ পর্যন্ত প্রদর্শিত দিকনির্দেশনার মাত্রা সীমিত। কারণ, আমাদের কাছে যথেষ্ট কারণ রয়েছে ধরে নেওয়ার যে অভ্যুত্থান পরিকল্পনার সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা খুব কম ছিল এবং তাই বাংলাদেশের শাসন পরিচালনার জন্য বিস্তৃত পরিকল্পনা তৈরির সুযোগও সীমিত ছিল।

তবে, যদি প্রাথমিকভাবে শক্তিশালী পদক্ষেপ এবং দৃঢ় ইচ্ছা প্রদর্শন না করা হয়, তবে নতুন সরকারের বর্তমান সুবিধা ক্রমেই কমতে শুরু করবে এবং আমরা এমন এক অস্থির এবং অস্থিরতা উৎপাদনকারী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি, যেখানে ক্ষমতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জগুলো উঠে আসবে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কোনো ব্যক্তিত্ব নেই, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে মুজিবের মতো নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।

বেসামরিক সরকার যদি হোঁচট খায়, সেনাবাহিনী হয়তো আবার দেশের ‘উদ্ধারকর্তা’ হিসেবে ভূমিকা নিতে বাধ্য হবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত