leadT1ad

স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে ভবিষ্যৎ ভারতের যে ছবি তুলে ধরলেন মোদি

ভাষণে তিনি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, কৌশলগত নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, গ্রামীণ উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন। তার সরকারের সব উদ্যোগকে তিনি ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’ গড়ার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত বলে উল্লেখ করেন। ভাষণে ভারতের জাতীয় শক্তি, সমৃদ্ধি ও ঐক্যের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার প্রকাশ করেন।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ২২: ৪১
নরেন্দ্র মোদি। সংগৃহীত ছবি

গত ১৪ আগস্ট ভারতের ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লির ঐতিহাসিক লালকেল্লায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ওই ভাষণে তিনি সরকারের ভিশন-মিশন এবং ভবিষ্যতে কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে তা তুলে ধরেন।

ভাষণে তিনি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, কৌশলগত নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, গ্রামীণ উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন। তার সরকারের সব উদ্যোগকে তিনি ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’ গড়ার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন। অতীতের সাফল্যের কথা স্মরণ করিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নতুন ঘোষণা দেন। প্রকাশ করেন ভারতের জাতীয় শক্তি, সমৃদ্ধি ও ঐক্যের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার।

মোদির বক্তব্যে ছিল নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা। এর মধ্যে পারমাণবিক হুমকি নিয়ে পাকিস্তানের প্রতি কঠোর সতর্কবার্তা, দেশীয়ভাবে সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির উদ্যোগ এবং দীপাবলিকে সামনে রেখে জিএসটি সংস্কারের ঘোষণা উল্লেখযোগ্য।

তার এই ভাষণ ছিল দীর্ঘ ১০৩ মিনিটের। যা স্বাধীনতা দিবসের সবচেয়ে লম্বা ভাষণ। এর আগে গত বছর তিনি ৯৮ মিনিট ভাষণ দিয়েছিলেন। আর লালকেল্লায় এটি তাঁর টানা ১২তম বারের মতো ভাষণ। এর মধ্য দিয়ে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর রেকর্ড ভেঙেছেন। টানা ১৭বার স্বাধীনতা দিবসে ভাষণ দিয়ে এখন কেবল জওহরলাল নেহরু তার সামনে আছেন।

অর্থনীতি ও স্বনির্ভরতা

নরেন্দ্র মোদি ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’ গড়ার তাঁর প্রতিশ্রুতি অটল থাকবে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক সংস্কারের ধারা অব্যাহত থাকবে। দীপাবলির আগে নতুন জিএসটি সংস্কার ঘোষণা হবে। শাসনব্যবস্থা আধুনিক করতে আরও আইন সংস্কারও আসছে।

মোদি সব খাতে আত্মনির্ভরতা (আত্মনির্ভর ভারত) জোরদার করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, `বাধ্য হয়ে নয়, নাগরিকরা ভেতরের শক্তি থেকে দেশি পণ্য বেছে নেবে‘। তাঁর দৃষ্টির লক্ষ্য একটি সমৃদ্ধ ভারত (সমৃদ্ধা ভারত) গড়ে তোলা।

মূল উদ্যোগগুলো হলো

প্রধানমন্ত্রী বিকশিত ভারত রোজগার যোজনা। এটি তরুণদের কর্মসংস্থান বাড়াতে একটি নতুন উদ্যোগ। এক লাখ কোটি রুপির এই কর্মসূচির আওতায় বেসরকারি খাতে প্রথমবার চাকরি পাওয়া তরুণদের এককালীন ১৫ হাজার রুপি প্রণোদনা দেওয়া হবে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় ৩.৫ কোটি তরুণ উপকৃত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

কৌশলগত পণ্য যেমন সার, যুদ্ধবিমান ইঞ্জিন, সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদন (বছরের শেষে শুরু হবে) এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ প্রক্রিয়াকরণকে উৎসাহিত করা। এগুলো বাস্তবায়িত হবে `ন্যাশনাল ক্রিটিক্যাল মিনারেলস মিশন‘— এর আওতায়।

২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রার পাঁচ বছর আগেই, অর্থাৎ চলতি ২০২৫ সালের মধ্যেই সবুজ জ্বালানির সক্ষমতা ৫০ শতাংশে উন্নীত করা। পাশাপাশি ন্যাশনাল ডিপওয়াটার অ্যাসপিরেশন মিশন চালু হবে, যা জ্বালানি খাতে আত্মনির্ভরতা নিশ্চিত করবে।

ভারত দ্রুতগতিতে ১০টি নতুন পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণে কাজ করছে জানিয়ে মোদী আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশের পারমাণবিক জ্বালানি সক্ষমতা দশগুণ বাড়ানো হবে।

সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) অব্যাহত রাখা, বীমা খাত আরও উন্মুক্ত করা এবং বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভারতে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেওয়া।

অক্টোবর ২০২৫-এর মধ্যে জিএসটি সংস্কার বাস্তবায়ন করা হবে। এর আওতায় পণ্য ও সেবার কর কাঠামো পুনঃনির্ধারণ করা হবে। মূল পণ্যের উপর করের হার কমানো হবে এবং কর স্তরগুলো সহজ করা হবে। এর লক্ষ্য হলো গৃহস্থালি ও ছোট ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া।

প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত নিরাপত্তা

ভাষণে মোদি ভারতের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এজন্য তিনি ‘মিশন সুদর্শন চক্র’ ঘোষণা করেন। এর লক্ষ্য হলো শত্রুপক্ষের অনুপ্রবেশ ঠেকানো এবং আক্রমণাত্মক সক্ষমতা বাড়ানো।

প্রধান দিকগুলো হলো

প্রতিরক্ষা উৎপাদনে আত্মনির্ভরতার ওপর জোর দেওয়া। এর অংশ হিসেবে তিনি ‘অপারেশন সিঁদুর’ এর উল্লেখ করেন। মোদি দেশীয়ভাবে যুদ্ধবিমান ইঞ্জিন তৈরিরও আহ্বান জানান।

দেশের কৌশলগত, বেসামরিক ও ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর সুরক্ষায় দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ১০ বছর মেয়াদি কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এ কর্মসূচি ২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

কৌশলগত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সশস্ত্র বাহিনীর জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার।

পাকিস্তানের দিক থেকে পারমাণবিক হুমকি নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানিয়েছেন মোদি। তিনি জানান, ভারত যেকোনো ধরনের ‘নিউক্লিয়ার ব্ল্যাকমেইল’–এর জবাব দৃঢ়ভাবে দেবে।

সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকদের সমানভাবে বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতিও দেন। বলেন, ‘কোনো ধরনের পার্থক্য করা হবে না।’

পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জলচুক্তি প্রত্যাখ্যান করে মোদি ঘোষণা করেন, ‘ভারতের পানি কেবল ভারতীয়দেরই প্রাপ্য’।

এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায় জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ডেমোগ্রাফিক মিশন বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন।

তারুণ্য, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি

মোদি যুবসমাজকে ভারতের উন্নতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি আহ্বান জানান, যাতে তাঁরা দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে নতুন ধারণা ও উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।

প্রধান দিকগুলো হলো

দেশীয় উদ্ভাবন ও তরুণদের নেতৃত্বাধীন সাফল্যকে স্বীকৃতি দেওয়া। এ প্রসঙ্গে দেশীয় কোভিড-১৯ টিকার উদ্ভাবনের কথা উল্লেখ করেন মোদী। এসব ভারতের দ্রুত ও বৃহত্তর পরিসরে উদ্ভাবন ক্ষমতা প্রদর্শন করে উল্লেখ করেন তিনি।

মোদি ঘোষণা করেন, ২০২৫ সালের শেষদিকে বাজারে আসবে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ সেমিকন্ডাক্টর চিপ, যা প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে শক্তিশালী করবে।

ভারতের নিজস্ব স্পেস স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি বড় দিগন্ত উন্মোচন করবে বলেও জানান তিনি।

উদীয়মান খাতে প্রযুক্তি-ভিত্তিক প্রবৃদ্ধি এবং উদ্ভাবন প্ল্যাটফর্মে মনোযোগ অব্যাহত রাখা হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।

কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষমতায়ন

নরেন্দ্র মোদি আবারও ভারতের কৃষক ও জেলেদের প্রতি তার সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি নিজেকে তাদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে ‘দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

মূল গ্রামীণ ও কৃষি উদ্যোগগুলো হলো

দেশীয় সার উৎপাদনকে উৎসাহ দেওয়া, যাতে আমদানি নির্ভরতা কমানো যায়।

কৃষকদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়া, যারা বিভিন্ন পণ্যে ভারতকে বিশ্বের শীর্ষ উৎপাদক হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

বিদেশি চাপের জলবণ্টন চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় কৃষকদের জলের অধিকার নিশ্চিত করা।

গ্রামীণ সম্প্রদায়কে দেশের স্বনির্ভরতা ও সমৃদ্ধি উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ।

সামাজিক কল্যাণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন

সামাজিক কল্যাণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বও পুনর্ব্যক্ত করেন মোদি। তিনি বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন স্বাস্থ্য, জনকল্যাণ ও সামাজিক সহনশীলতার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।’

মূল বিষয়গুলো হলো

স্থূলতাকে একটি বড় জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মোদি সমগ্র সমাজকে এ বিষয়ে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান।

সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দুর্যোগ ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার।

ভারতের ইতিহাসে জাতি গঠনে অবদান রাখা ব্যক্তিদের স্বীকৃতি। এর মধ্যে রয়েছেন জওহরলাল নেহরু, ড. ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, নারী মুক্তিসেনানী ও আরএসএস-এর শতবর্ষী জাতীয় ঐক্য সেবা।

২০৪৭ সালের ভিশন অর্জনে সামাজিক সম্প্রীতি ও জাতীয় উদ্দেশ্য নিশ্চিত করার আহ্বান, যাতে দেশের উন্নয়নে সব স্তরের মানুষ উপকৃত হয়।

অভিবাসীবিরোধী বক্তব্য

দেশ গড়ার ভবিষ্যত পরিকল্পনার পাশাপাশি ভাষণে নরেন্দ্র মোদি অভিবাসীবিরোধী কথাও বলেন। দেশটিতে সম্প্রতি ‘অবৈধ’ অভিবাসী ধরপাকড় অভিযানে হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, একটি বিশেষ ধর্ম ও ভাষার মানুষকে লক্ষ্য করে এই অভিযান চালানো হচ্ছে। আটককৃতদের বেশিরভাগই মুসলিম ও বাংলাভাষী।

এই পরিপ্রেক্ষিতে নরেন্দ্র মোদি তার ভাষণে বলেন, ‘আজ আমি জাতিকে একটি গুরুতর বিষয় নিয়ে সতর্ক করতে চাই। “ষড়যন্ত্রের” মাধ্যমে দেশের জনসংখ্যার কাঠামো পরিবর্তিত হচ্ছে, যা নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীরা দেশের তরুণদের জীবিকা ছিনিয়ে নিচ্ছে এবং দেশের বোন ও কন্যাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে; এটা সহ্য করা হবে না। এই অনুপ্রবেশকারীরা নিরপরাধ উপজাতিদের প্রতারিত করছে এবং তাদের জমি দখল করছে; জাতি এটা সহ্য করবে না।’

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মোদি আরও জোরদার প্রতিরক্ষা ও নীতিগত উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়া ন্যারেটিভ ডটকম, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য হিন্দু, টাইমস অব ইন্ডিয়া

Ad 300x250

সম্পর্কিত