leadT1ad

‘কৃত্রিম সুপারইন্টেলিজেন্স’ থেকে বাঁচার পথ জানালেন এআই গডফাদারেরা

এআই কি মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী? ধ্বংস করবে মানবসভ্যতাকে? বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে এই প্রশ্ন। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন খোদ এআই বিশেষজ্ঞরা। এআই জগতের গডফাদারেরা খুঁজে ফিরছেন মানুষের বেঁচে থাকার উপায়। কী সেই উপায়?

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ২৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গডফাদার’ নামে পরিচিত জিওফ্রে হিন্টন। তাঁর আশঙ্কা, যে প্রযুক্তি তৈরিতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন, সেটিই একদিন মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন হওয়া ঠেকাতে ভুল পদ্ধতি বেছে নিচ্ছে ‘টেক ব্রো’রা।

২০২৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান জিওফ্রে হিন্টন। তিনি একজন কম্পিউটার-বিজ্ঞানী এবং গুগলের সাবেক নির্বাহী। আগেও তিনি সতর্ক করেছিলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মানবজাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার শঙ্কা ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ। ১২ আগস্ট মঙ্গলবার লাস ভেগাসে আয়োজিত ‘শিল্প সম্মেলন এআই-৪’-এ তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যেভাবে মানুষকে ‘প্রাধান্যবিস্তারকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং এআইকে ‘অনুগত’ রাখার চেষ্টা করছে, তা কার্যকর হবে না।

মানুষকে জোর করে এআই-এর অধীন রাখার বদলে হিন্টন একটি আকর্ষণীয় প্রস্তাব করেছেন, যখন প্রযুক্তি মানুষের তুলনায় বেশি শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে। তখন এআই মডেলে ‘মাতৃত্ববোধ’ তৈরি করা, যাতে ‘তারা সত্যিই মানুষের প্রতি যত্নশীল হয়’।

জিওফ্রে হিন্টন বলেন, ‘এ প্রক্রিয়া কাজ করবে না। তারা (এআই) আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে। আমাদের ফাঁকি দেওয়ার অসংখ্য উপায় তাদের হাতে থাকবে।’

হিন্টন সতর্ক করেছেন, ভবিষ্যতে এআই সিস্টেমগুলো হয়ত মানুষকে ততটা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, যেভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ক্যান্ডি দিয়ে তিন বছরের শিশুকে প্রলুব্ধ করে। এ বছর এমন কিছু উদাহরণ দেখা গেছে, যেখানে এআই সিস্টেমগুলো তাদের লক্ষ্য পূরণে প্রতারণা, ধোঁকাবাজি ও চুরির মতো কৌশল ব্যবহার করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি এআই মডেল এক ইঞ্জিনিয়ারের ই-মেইল থেকে তাঁর পরকীয়ার খবর জেনে তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছিল।

মানুষকে জোর করে এআইয়ের অধীন রাখার বদলে হিন্টন একটি আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিয়েছেন। যখন প্রযুক্তি মানুষের তুলনায় বেশি শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে, তখন এআই মডেলে ‘মাতৃত্বের বোধ’ তৈরি করা, যাতে ‘তারা সত্যিই মানুষের প্রতি যত্নশীল হয়’।

হিন্টন বলেন, ‘যদি তারা (এআই সিস্টেম) বুদ্ধিমান হয়, তাহলে তাদের দুটি লক্ষ্য থাকা উচিত। একটি হলো বেঁচে থাকা, অন্যটি হলো আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো ধরনের স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এআই টিকে থাকার চেষ্টা করবে—এমনটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।’ তাই মানুষের প্রতি সহানুভূতির বোধ তৈরি করাটা জরুরি বলে মত দেন হিন্টন। সম্মেলনে তিনি উল্লেখ করেন, মায়েদের মধ্যে তাঁদের সন্তানদের যত্ন নেওয়ার প্রবল প্রবৃত্তি থাকে। সমাজও তাঁদের ওপর এই দায়িত্ব পালনের চাপ সৃষ্টি করে।

ভবিষ্যতে এআই সিস্টেমগুলো হয়ত মানুষকে ততটা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, যেভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ক্যান্ডি দিয়ে তিন বছরের শিশুকে প্রলুব্ধ করে। সংগৃহীত ছবি
ভবিষ্যতে এআই সিস্টেমগুলো হয়ত মানুষকে ততটা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, যেভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ক্যান্ডি দিয়ে তিন বছরের শিশুকে প্রলুব্ধ করে। সংগৃহীত ছবি

হিন্টন আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে যে উদাহরণ আছে, সেটিই হলো একমাত্র সঠিক উদাহরণ। যেখানে কম বুদ্ধিমান বেশি বুদ্ধিমানকে নিয়ন্ত্রণ করে—আর সেটা হলো মা, যিনি নিজের শিশুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন।’

‘এটাই একমাত্র ভালো পরিণতি’

হিন্টন বলেন, প্রযুক্তিগতভাবে এটি ঠিক কীভাবে করা সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়, তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে গবেষকদের অবশ্যই এ বিষয়ে কাজ করতে হবে।

হিন্টন বলেন, ‘এটাই একমাত্র ভালো পরিণতি। যদি এটা আমাকে লালন-পালন না করে, তাহলে এটা আমার জায়গা নিয়ে নেবে। এই সুপার-বুদ্ধিমান, যত্নশীল এআই মায়েদের অধিকাংশই মাতৃত্ববোধ ত্যাগ করতে চাইবে না। কারণ, তারা চায় না আমরা মারা যাই।’

হিন্টন ‘নিউরাল নেটওয়ার্কে’ তাঁর গবেষণা কাজের জন্য পরিচিত। যা আজকের এআই বিপ্লবের পথ সুগম করেছে। ২০২৩ সালে তিনি গুগল থেকে পদত্যাগ করেন। এআইয়ের ঝুঁকি সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলা শুরু করেন।

তবে হিন্টনের ‘মা-সুলভ এআই’ ধারণার সঙ্গে সবাই একমত নন।

‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গডমাদার’ নামে পরিচিত ফেই-ফেই লি। বুধবার সিএনএনকে জানান, তিনি হিন্টনের এই ধারণার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই দ্বিমত পোষণ করেন। দীর্ঘদিনের বন্ধু হিন্টন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, বিষয়টিকে এভাবে উপস্থাপন করা ঠিক নয়।’

বরং, লি আহ্বান জানাচ্ছেন ‘মানবকেন্দ্রিক এআই’ তৈরির জন্য। যা মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে।

লি বলেন, ‘প্রযুক্তি তৈরি ও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিটি স্তরে আমাদের দায়িত্ব হলো সবচেয়ে দায়িত্বশীল উপায়ে তা করা। আর কোনো অবস্থাতেই, এক মুহূর্তের জন্যও কোনো মানুষকে তাঁর মর্যাদা ত্যাগ করতে বলা উচিত নয় বা তা বেছে নেওয়া উচিত নয়। কেবল কোনো ‘টুল’ শক্তিশালী বলে একজন মা, একজন শিক্ষিকা এবং একজন উদ্ভাবক হিসেবে আমি সত্যিই বিশ্বাস করি যে এটাই এআইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।’

শিয়ার বলেছেন, এআই সিস্টেমে মানুষের মূল্যবোধ ঢোকানোর চেষ্টা করার বদলে আরও বুদ্ধিমান পদ্ধতি হলো মানুষের সঙ্গে এআই-এর সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা।

চ্যাটজিপিটি’র মালিক ওপেনএআইয়ের অন্তর্বর্তীকালীন সিইও হিসেবে অল্প সময় দায়িত্ব পালন করা এমেট শিয়ার বলেছেন, কিছু এআই সিস্টেম মানুষের ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে বা শাটডাউন আদেশ এড়িয়ে যাচ্ছে—এতে তিনি অবাক নন।

এআই অ্যালাইনমেন্ট স্টার্টআপ সফটম্যাক্সের প্রধান নির্বাহী শিয়ার বলেন, ‘এটি বারবার ঘটছে। এবং এটি থামবে না। আজকের এআই তুলনামূলকভাবে দুর্বল। কিন্তু তারা খুব দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠছে।’

শিয়ার বলেছেন, এআই সিস্টেমে মানুষের মূল্যবোধ ঢোকানোর চেষ্টা করার বদলে আরও বুদ্ধিমান পদ্ধতি হলো মানুষের সঙ্গে এআইয়ের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা।

এআই প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত এগোচ্ছে

অনেক বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এআই সুপারইন্টেলিজেন্সে পৌঁছাবে। যা কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিসিয়াল জেনারেল ইন্টিলিজেন্স বা এজিআই) নামেও পরিচিত।

হিন্টন জানান, আগে তিনি ভাবতেন এজিআই পেতে ৩০ থেকে ৫০ বছর লাগবে। কিন্তু এখন তিনি মনে করছেন, সেই সময়টা আরও আগে চলে এসেছে। যৌক্তিক অনুমান হলো আগামী ৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।

যদিও হিন্টন এখনো এআইয়ের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন, তবুও তিনি আশা করছেন এই প্রযুক্তি চিকিৎসা ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি আনবে।

হিন্টন বলেন, ‘আমরা একেবারে নতুন ধরনের ওষুধ দেখতে পাব। ক্যানসারের চিকিৎসা বর্তমানের তুলনায় অনেক ভালো হবে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, এআই ডাক্তারদের এমআরআই এবং সিটিস্ক্যান থেকে পাওয়া বিপুল তথ্য বিশ্লেষণ ও মিল খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।

তবে হিন্টন বিশ্বাস করেন না যে এআই মানুষের অমরত্ব এনে দেবে। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে আমরা চিরদিন বেঁচে থাকব। আমি মনে করি, চিরজীবন বেঁচে থাকা একটি বড় ভুল হবে। আপনি কি চান, ২০০ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ পুরুষরা দুনিয়া চালাবে?’

যখন হিন্টন জিজ্ঞাসা করা হয়, যদি তিনি জানতেন এআই এত দ্রুত এগোবে, তাহলে কি তিনি তাঁর ক্যারিয়ারে কিছু ভিন্নভাবে করতেন। জবাবে তিনি বলেন, তিনি অনুতপ্ত যে তিনি শুধু এআই কার্যকর করার দিকেই মনোযোগ দিয়েছেন। ইচ্ছা ছিল নিরাপত্তা বিষয়গুলো নিয়েও ভাবার।

(সিএনএন’র ম্যাট ইগানের লেখা অবলম্বনে হুমায়ূন শফিক)

Ad 300x250

সম্পর্কিত