রশীদ করীম: জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা
আজ রশীদ করিমের জন্মদিন। এ বছর বাংলাদেশের এই ঔপন্যাসিকের জন্মশতবর্ষও। বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও আধুনিকতার এক উজ্জ্বল ভাষ্যকার তিনি। উপন্যাসের আখ্যানে কেমন করে তিনি ধারণ করেছেন বাংলা অঞ্চলের মানুষের নৈমিত্তিক ছবি-ব্যক্তিক ও সামষ্টিক বাসনার রূপকল্প?
হামীম কামরুল হক
বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও আধুনিকতার এক উজ্জ্বল ভাষ্যকার রশীদ করীম। উপন্যাসের আখ্যানে তিনি ধারণ করেছেন বাংলা অঞ্চলের মানুষের নৈমিত্তিক ছবি, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক বাসনার রূপকল্প। বাংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর রয়েছে বিশিষ্ট একটি অবস্থান। এ অঞ্চলের মানুষ ও সমাজ তথা নাগরিক জীবনের নির্ভজোল চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর কথাসাহিত্যে।
রশীদ করীম জন্মেছেন কলকাতায়, ১৪ আগস্ট ১৯২৫, শুক্রবার। পুরো নাম রশীদ করীম গোলাম মুরশেদ। বাবা মৌলবী আবদুল করীম ছিলেন সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা আমাতুজ জোহরা। দাদা ছিলেন ক্যালকাটা পুলিশের চিফ ইন্সপেক্টর। নানা সৈয়দ আবদুল মালেক ছিলেন এডিশনাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। রশীদ করীম ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৯ সালে আন্তজার্তিক তেল কোম্পানি ক্যালটেক্স-এ যোগদান করেন। ১৫ মার্চ ১৯৫০ সালে কলকাতা ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। বিয়ে করেন ২০ জুলাই ১৯৫৬ সালে, স্ত্রীর নাম সালিমা আহমেদ ফুল। ১৯৬৩ সালে ৩০ জানুয়ারি একমাত্র কন্যা নাবিলা মুরশেদের জন্ম। ১৯৬৫ সালে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে পেশাগত জীবনের ইতি টেনে অবসরে যান। রশীদ করীম প্রয়াত হন ২০১১ সালের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ছিয়াশি বছর।
লেখক-জীবনে রশীদ করিম লিখেছিলেন বারোটি উপন্যাস- ‘উত্তমপুরুষ’ (১৯৬১), ‘প্রষণ্ন পাষাণ’ (১৯৬৩), ‘আমার যত গ্লানি’ (১৯৭৩), ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’ (১৯৭৮), ‘সাধারণ লোকের কাহিনী’ (১৯৮১), ‘একালের রূপকথা’ (১৯৮১), ‘শ্যামা’ (১৯৮৪), ‘বড়ই নিঃসঙ্গ’ (১৯৮৫), ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’ (১৯৮৯), ‘চিনি না’ (১৯৯০), ‘পদতলে রক্ত’ (১৯৯০) ‘লাঞ্চবক্স’ (১৯৯৩)। মাত্র ৮টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল একটি ছোটগল্পের বই- ‘প্রথম প্রেম’ (১৯৮৪)। রশীদ করীমের প্রবন্ধের বই তিনটি- ‘আর এক দৃষ্টিকোণ’ (১৯৮৯), ‘অতীত হয় নূতন পুনরায়’ (১৯৯২), ‘মনের গহনে মুরতিখানি’ (১৯৯২)। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘জীবন-মরণ’।
২০০২ সালে তাঁর ‘উপন্যাস সমগ্র’ এবং ২০০৩ সালে তাঁর ‘প্রবন্ধ সমগ্র’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনাবলি। এবছর ২৫ জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় জন্মশতবার্ষিকী প্রকাশনা ‘রশীদ করিম অমনিবাস’।
জীবদ্দশায় রশীদ করীমের মোট বইয়ের সংখ্যা ১৭টি। দেখা যাচ্ছে, এর ভেতরে উপন্যাসের সংখ্যাই বেশি—সে অর্থে তিনি প্রথমত ও প্রধানত ঔপন্যাসিক। যদিও কারো কোনো একটি দিকে রচনার সংখ্যা বেশি থাকলেই তিনি তা হয়ে যান না। যেমন রবীন্দ্রনাথ সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন নাটক, ৪৬টি। এখানে নির্মাণ প্রয়াসের জায়গা থেকে রবীন্দ্রনাথকে নাট্যকার বলা হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রধান পরিচয় তিনি কবি। শিল্পসিদ্ধির জায়গা থেকেও তিনি মূলত কবি। ঠিক তেমনি শিল্পসিদ্ধির জায়গা থেকে রশীদ করীম মূলত ঔপন্যাসিক।
রশীদ করীম তাঁর নিজের গল্পলেখার ইতিটানার কথা জানিয়েছেন তাঁর একমাত্র ছোটগল্পের বই ‘প্রথম প্রেম’-এর ভূমিকায়। তার আগে নিজের লেখক হয়ে ওঠার কথা লিখেছেন এভাবে:
‘‘তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। অর্থাৎ তখন ১৯৩৯ সাল। হঠাৎ একদিন একটি হাতে লেখা পত্রিকা দেখলাম আমাদের ক্লাসের ছেলেদের হাতে হাতে ঘুরছে। এই পত্রিকা কোথা থেকে এলো? সে সব কথার উত্তর না দিয়ে আমাদের ফার্স্ট বয় অরুণ খুব গম্ভীরভাবে সকলকে সম্বোধন করে বললো, ‘আমরাও একটা হাতে লেখা পত্রিকা বার করবো। রশীদ করীম, তুই গল্প লিখবি।’ আমি তো অবাক। অরুণকে বললাম, ‘আমি কি কখনো গল্প লিখেছি?’ অরুণ তেমনি গম্ভীর হয়ে বললো,‘সব কিছুরই একটা শুরু আছে।’ বলেই ফার্স্ট বয়ের উপযোগী গাম্ভীর্য নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। যাই হোক ফার্স্ট বয়ের অনুশাসন, সুতরাং আমাকে লিখতেই হয়। দু’দিনে একটা গল্প লিখলাম। লিখলাম তো কিন্তু গল্পের শেষ কীভাবে করবো? সেখানেই আটকে গেলাম। কিছুতেই গল্পের শেষে একটা বিস্ময় জাতীয় কিছু মাথায় ঢুকছিল না। লেখাটি আমার টেবিলে পড়ে থাকলো। আমার এক বাল্যসখী ছিল। সে আমার চাইতে মাত্র দু’বছরের ছোট। সে ছিল যেমন বুদ্ধিমতী তেমনি রূপবতী। সে আমাকে বললো,‘ তুমি বলছো তোমার গল্প শেষ হচ্ছে না। তোমার গল্প তো শেষ হয়েই গেছে।’ আমি গল্পটা আবার পড়লাম। পড়ে দেখি, তাই তো, গল্প তো শেষ হয়েই গেছে। তখন ফার্স্ট বয়কে লেখাটি দিলাম এবং সে হাতে লেখা পত্রিকার জন্য গল্পটি গ্রহণ করলো। সেই হাতে লেখা পত্রিকার ‘হেড পিস’ ছিল, ‘টেইল পিস’ ছিল এবং এতে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং ভ্রমণকাহিনী ছিল। বাল্যসখীর কথা যখন বললাম তখন আজ জীবন সায়াহ্নে এসে বলতে পারি যে, এই মেয়েটি আমার জীবনে না এলে হয়তো আমি জীবনে কোনো দিন লেখক হতে পারতাম না।
আমার লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে বা তার কাছাকাছি সময়ে। তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র অথবা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। ‘সওগাত’ পত্রিকার। গল্পটির নাম ‘আয়েশা’। বলা বাহুল্য, এই গল্পের নায়িকা বানিয়েছিলাম আমার সেই বাল্যসখীকে। সেই সময়ে ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজ দেখাশোনা করতেন আহসান হাবীব। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন পাশে বসে হিসেবনিকেশ, প্রেস ইত্যাদি অন্য কাজ করতেন। তখন এবং তারপর ‘সওগাত’ পত্রিকায় আমার অন্যান্য গল্প ও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ততোদিনে ‘সওগাত’, ‘ মোহাম্মদী’ ‘নবযুগ’, ‘পূর্বাশা’ প্রভৃতি পত্রিকায়ও আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এই সব লিখবার আসল প্রেরণা দিতেন আহসান হাবীব। তাঁর কাছে আমি যে উৎসাহ আজীবন পেয়েছি তা ভুলবার নয়।’’
‘প্রথম প্রেম’ বইয়ের ভূমিকাতেও ওই বাল্যসখির প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে রশীদ করীম লিখেছেন, ‘মেয়েটির যে হৃদয় আছে, ক্রমে তার আরো কিছু পরিচয় লাভ করলাম। আমার দ্বারাও যে কোনো কঠিন ও অসামান্য কাজ সম্ভব, শুধু সেটাই প্রমাণ করবার জন্য আমি একটির পর একটি গল্প লিখতে লাগলাম।’ ঘটনাচক্রে সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই রশীদ করীমের জীবনে গল্প লেখার প্রয়োজনটিই ফুরিয়ে যায়। বিষয়টি তিনি এভাবে হাজির করেছেন, ‘‘সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। আমার গল্প লেখার প্রয়োজনও ফুরালো। ১৯৬১ সালে ‘উত্তম পুরুষ’ লিখে সাহিত্য জগতে আমার পুনঃপ্রবেশ।’’
বারোটি উপন্যাসের ভেতরে আয়তনে তিনটি উপন্যাস বেশ দীর্ঘ- ‘উত্তম পুরুষ’, ‘আমার যত গ্লানি’ ও ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’। জীবদ্দশায় রশীদ করীমের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়েছে, নিন্দা-প্রশংসাও যথারীতি বিপুল ছিল। ‘উত্তমপুরুষ’ সম্পর্কে বিখ্যাত ‘সমকাল’ সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের মন্তব্য ছিল, ‘লেখাটা বড্ড কমুনাল।’
চল্লিশ দশকের কলকাতার প্রতিবেশ যা ছিল, সেটির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই রশীদ করীম ‘উত্তম পুরুষ’ রচনা করেছেন। ফলে এর ভেতরের সাম্প্রদায়িকতার দোষটি লেখকের নয়, তৎকালীন পরিস্থিতির। রফিকউল্লাহ খান লিখেছেন, ‘রশীদ করীমের উপন্যাস বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অপুষ্ট মুসলমান মধ্যবিত্তের হৃদয়শক্তির অপূর্ণতাজনিত সীমাবদ্ধতার রূপায়ণে বিশিষ্ট।’ ‘প্রষণ্ন পাষাণ’ উপন্যাসের ঘটনা, চরিত্র ও এর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াগুলি বাস্তবসম্মত ও সমগ্র হয়ে ওঠেনি বলে মনে করেছেন তিনি।
রফিকউল্লাহ মনে করে, ‘‘অথচ জীবনের খণ্ডিত, বিচূর্ণিত মুহূর্তকেও সমগ্র করে তোলা উপন্যাসের স্বধর্ম। রশীদ করীমের জীবনবোধের দ্বিধাই সম্ভবত এর অন্যতম কারণ। তাঁর ‘উত্তম পুরুষ’ উপন্যাসে এই দ্বিধার পরিচয় অধিকতর সুস্পষ্ট, যেখানে সমাজবোধ ও ইতিহাসচেতনার ক্ষেত্রে লেখকের সীমাহীন ভ্রান্তি আমাদের বিব্রত করে। একটি মহৎ উপন্যাসও জীবনবোধশূন্য হতে পারে। কিন্তু ঔপন্যাসিকের জীবনার্থহীনতা সেই শূন্যতাকে যথার্থ ও অনিবার্য করে তুলতে ব্যর্থ হয়।’’ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট গল্পকার ও প্রাবন্ধিক অতীন্দ্রিয় পাঠক ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’ উপন্যাস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘চরিত্রগুলি, বিভিন্ন ঘটনা, নানা তথ্যাদির এই বিশ্লেষণের পর মনে হতে পারে এটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। মানবিকও হতে পারে। অথবা যৌথভাবে, রাজনৈতিক চাপে মানবিকতার সংকট এই উপন্যাসের প্রতিপাদ্য বিষয়।’
‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’ উপন্যাাসের আলোচনা প্রসঙ্গে রফিকুল্লাহ খান লিখেছেন, ‘মানবমনের অন্তস্তলবাসী সংকটের রূপায়ণে রশীদ করীমের শিল্পদক্ষতা এ-উপন্যাসে প্রাগ্রসরতার স্বাক্ষরবাহী।’ এছাড়াও তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘রশীদ করীমের উপন্যাসবিধৃত চরিত্র-পাত্ররা যেন অনেকটা ইউরোপীয় ধাঁচে গড়া। একই চরিত্রের মধ্যে অনেকগুলো পারম্পর্যহীন কার্যকারণহীন অনুভূতি ও বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস সম্ভবত ঔপন্যাসিকের বিচিত্র শিল্প-অভিজ্ঞতার ফল।’
‘আমার যত গ্লানি’ উপন্যাস নিয়ে রফিকুল্লাহ খান লেখেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে মধ্যবিত্তমানসের দ্বিধান্বিত ও অন্তর্দ্বন্দ্বময় আত্মস্বরূপের উন্মোচন ঘটেছে রশীদ করীমের আমার যত গ্লানি উপন্যাসে।’ মুক্তিযদ্ধের সময়কার গণহত্যার চিত্র এই উপন্যাসে ভয়াবহভাবে বর্ণিত। তদুপরি সমালোচকের মনে হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ-উৎসারিত চেতনার পরিবর্তে রশীদ করীম সন্ধান করেছেন মধ্যবিত্তের আত্মরতি, আত্মধিক্কার, বিচ্ছিন্নতাবোধ ও কৌতুকপ্রবণতা।’
দেশভাগ, পাকিস্তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের উত্থান-এই সময়পর্বের আত্মবিবরণ হয়ে উঠেছে রশীদ করীমের সাহিত্য। তিনি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন ইতিহাস-জিজ্ঞাসার সামনে। তাঁর জীবন ও সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে বাঙালি মধ্যবিত্তের আত্মসত্তা অন্বেষণের নিবিড় আখ্যান।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক; কথাসাহিত্যিক।
বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও আধুনিকতার এক উজ্জ্বল ভাষ্যকার রশীদ করীম। উপন্যাসের আখ্যানে তিনি ধারণ করেছেন বাংলা অঞ্চলের মানুষের নৈমিত্তিক ছবি, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক বাসনার রূপকল্প। বাংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর রয়েছে বিশিষ্ট একটি অবস্থান। এ অঞ্চলের মানুষ ও সমাজ তথা নাগরিক জীবনের নির্ভজোল চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর কথাসাহিত্যে।
রশীদ করীম জন্মেছেন কলকাতায়, ১৪ আগস্ট ১৯২৫, শুক্রবার। পুরো নাম রশীদ করীম গোলাম মুরশেদ। বাবা মৌলবী আবদুল করীম ছিলেন সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা আমাতুজ জোহরা। দাদা ছিলেন ক্যালকাটা পুলিশের চিফ ইন্সপেক্টর। নানা সৈয়দ আবদুল মালেক ছিলেন এডিশনাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। রশীদ করীম ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৯ সালে আন্তজার্তিক তেল কোম্পানি ক্যালটেক্স-এ যোগদান করেন। ১৫ মার্চ ১৯৫০ সালে কলকাতা ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। বিয়ে করেন ২০ জুলাই ১৯৫৬ সালে, স্ত্রীর নাম সালিমা আহমেদ ফুল। ১৯৬৩ সালে ৩০ জানুয়ারি একমাত্র কন্যা নাবিলা মুরশেদের জন্ম। ১৯৬৫ সালে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে পেশাগত জীবনের ইতি টেনে অবসরে যান। রশীদ করীম প্রয়াত হন ২০১১ সালের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ছিয়াশি বছর।
লেখক-জীবনে রশীদ করিম লিখেছিলেন বারোটি উপন্যাস- ‘উত্তমপুরুষ’ (১৯৬১), ‘প্রষণ্ন পাষাণ’ (১৯৬৩), ‘আমার যত গ্লানি’ (১৯৭৩), ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’ (১৯৭৮), ‘সাধারণ লোকের কাহিনী’ (১৯৮১), ‘একালের রূপকথা’ (১৯৮১), ‘শ্যামা’ (১৯৮৪), ‘বড়ই নিঃসঙ্গ’ (১৯৮৫), ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’ (১৯৮৯), ‘চিনি না’ (১৯৯০), ‘পদতলে রক্ত’ (১৯৯০) ‘লাঞ্চবক্স’ (১৯৯৩)। মাত্র ৮টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল একটি ছোটগল্পের বই- ‘প্রথম প্রেম’ (১৯৮৪)। রশীদ করীমের প্রবন্ধের বই তিনটি- ‘আর এক দৃষ্টিকোণ’ (১৯৮৯), ‘অতীত হয় নূতন পুনরায়’ (১৯৯২), ‘মনের গহনে মুরতিখানি’ (১৯৯২)। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘জীবন-মরণ’।
২০০২ সালে তাঁর ‘উপন্যাস সমগ্র’ এবং ২০০৩ সালে তাঁর ‘প্রবন্ধ সমগ্র’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনাবলি। এবছর ২৫ জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় জন্মশতবার্ষিকী প্রকাশনা ‘রশীদ করিম অমনিবাস’।
জীবদ্দশায় রশীদ করীমের মোট বইয়ের সংখ্যা ১৭টি। দেখা যাচ্ছে, এর ভেতরে উপন্যাসের সংখ্যাই বেশি—সে অর্থে তিনি প্রথমত ও প্রধানত ঔপন্যাসিক। যদিও কারো কোনো একটি দিকে রচনার সংখ্যা বেশি থাকলেই তিনি তা হয়ে যান না। যেমন রবীন্দ্রনাথ সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন নাটক, ৪৬টি। এখানে নির্মাণ প্রয়াসের জায়গা থেকে রবীন্দ্রনাথকে নাট্যকার বলা হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রধান পরিচয় তিনি কবি। শিল্পসিদ্ধির জায়গা থেকেও তিনি মূলত কবি। ঠিক তেমনি শিল্পসিদ্ধির জায়গা থেকে রশীদ করীম মূলত ঔপন্যাসিক।
রশীদ করীম তাঁর নিজের গল্পলেখার ইতিটানার কথা জানিয়েছেন তাঁর একমাত্র ছোটগল্পের বই ‘প্রথম প্রেম’-এর ভূমিকায়। তার আগে নিজের লেখক হয়ে ওঠার কথা লিখেছেন এভাবে:
‘‘তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। অর্থাৎ তখন ১৯৩৯ সাল। হঠাৎ একদিন একটি হাতে লেখা পত্রিকা দেখলাম আমাদের ক্লাসের ছেলেদের হাতে হাতে ঘুরছে। এই পত্রিকা কোথা থেকে এলো? সে সব কথার উত্তর না দিয়ে আমাদের ফার্স্ট বয় অরুণ খুব গম্ভীরভাবে সকলকে সম্বোধন করে বললো, ‘আমরাও একটা হাতে লেখা পত্রিকা বার করবো। রশীদ করীম, তুই গল্প লিখবি।’ আমি তো অবাক। অরুণকে বললাম, ‘আমি কি কখনো গল্প লিখেছি?’ অরুণ তেমনি গম্ভীর হয়ে বললো,‘সব কিছুরই একটা শুরু আছে।’ বলেই ফার্স্ট বয়ের উপযোগী গাম্ভীর্য নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। যাই হোক ফার্স্ট বয়ের অনুশাসন, সুতরাং আমাকে লিখতেই হয়। দু’দিনে একটা গল্প লিখলাম। লিখলাম তো কিন্তু গল্পের শেষ কীভাবে করবো? সেখানেই আটকে গেলাম। কিছুতেই গল্পের শেষে একটা বিস্ময় জাতীয় কিছু মাথায় ঢুকছিল না। লেখাটি আমার টেবিলে পড়ে থাকলো। আমার এক বাল্যসখী ছিল। সে আমার চাইতে মাত্র দু’বছরের ছোট। সে ছিল যেমন বুদ্ধিমতী তেমনি রূপবতী। সে আমাকে বললো,‘ তুমি বলছো তোমার গল্প শেষ হচ্ছে না। তোমার গল্প তো শেষ হয়েই গেছে।’ আমি গল্পটা আবার পড়লাম। পড়ে দেখি, তাই তো, গল্প তো শেষ হয়েই গেছে। তখন ফার্স্ট বয়কে লেখাটি দিলাম এবং সে হাতে লেখা পত্রিকার জন্য গল্পটি গ্রহণ করলো। সেই হাতে লেখা পত্রিকার ‘হেড পিস’ ছিল, ‘টেইল পিস’ ছিল এবং এতে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং ভ্রমণকাহিনী ছিল। বাল্যসখীর কথা যখন বললাম তখন আজ জীবন সায়াহ্নে এসে বলতে পারি যে, এই মেয়েটি আমার জীবনে না এলে হয়তো আমি জীবনে কোনো দিন লেখক হতে পারতাম না।
আমার লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে বা তার কাছাকাছি সময়ে। তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র অথবা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। ‘সওগাত’ পত্রিকার। গল্পটির নাম ‘আয়েশা’। বলা বাহুল্য, এই গল্পের নায়িকা বানিয়েছিলাম আমার সেই বাল্যসখীকে। সেই সময়ে ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজ দেখাশোনা করতেন আহসান হাবীব। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন পাশে বসে হিসেবনিকেশ, প্রেস ইত্যাদি অন্য কাজ করতেন। তখন এবং তারপর ‘সওগাত’ পত্রিকায় আমার অন্যান্য গল্প ও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ততোদিনে ‘সওগাত’, ‘ মোহাম্মদী’ ‘নবযুগ’, ‘পূর্বাশা’ প্রভৃতি পত্রিকায়ও আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এই সব লিখবার আসল প্রেরণা দিতেন আহসান হাবীব। তাঁর কাছে আমি যে উৎসাহ আজীবন পেয়েছি তা ভুলবার নয়।’’
‘প্রথম প্রেম’ বইয়ের ভূমিকাতেও ওই বাল্যসখির প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে রশীদ করীম লিখেছেন, ‘মেয়েটির যে হৃদয় আছে, ক্রমে তার আরো কিছু পরিচয় লাভ করলাম। আমার দ্বারাও যে কোনো কঠিন ও অসামান্য কাজ সম্ভব, শুধু সেটাই প্রমাণ করবার জন্য আমি একটির পর একটি গল্প লিখতে লাগলাম।’ ঘটনাচক্রে সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই রশীদ করীমের জীবনে গল্প লেখার প্রয়োজনটিই ফুরিয়ে যায়। বিষয়টি তিনি এভাবে হাজির করেছেন, ‘‘সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। আমার গল্প লেখার প্রয়োজনও ফুরালো। ১৯৬১ সালে ‘উত্তম পুরুষ’ লিখে সাহিত্য জগতে আমার পুনঃপ্রবেশ।’’
বারোটি উপন্যাসের ভেতরে আয়তনে তিনটি উপন্যাস বেশ দীর্ঘ- ‘উত্তম পুরুষ’, ‘আমার যত গ্লানি’ ও ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’। জীবদ্দশায় রশীদ করীমের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়েছে, নিন্দা-প্রশংসাও যথারীতি বিপুল ছিল। ‘উত্তমপুরুষ’ সম্পর্কে বিখ্যাত ‘সমকাল’ সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের মন্তব্য ছিল, ‘লেখাটা বড্ড কমুনাল।’
চল্লিশ দশকের কলকাতার প্রতিবেশ যা ছিল, সেটির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই রশীদ করীম ‘উত্তম পুরুষ’ রচনা করেছেন। ফলে এর ভেতরের সাম্প্রদায়িকতার দোষটি লেখকের নয়, তৎকালীন পরিস্থিতির। রফিকউল্লাহ খান লিখেছেন, ‘রশীদ করীমের উপন্যাস বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অপুষ্ট মুসলমান মধ্যবিত্তের হৃদয়শক্তির অপূর্ণতাজনিত সীমাবদ্ধতার রূপায়ণে বিশিষ্ট।’ ‘প্রষণ্ন পাষাণ’ উপন্যাসের ঘটনা, চরিত্র ও এর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াগুলি বাস্তবসম্মত ও সমগ্র হয়ে ওঠেনি বলে মনে করেছেন তিনি।
রফিকউল্লাহ মনে করে, ‘‘অথচ জীবনের খণ্ডিত, বিচূর্ণিত মুহূর্তকেও সমগ্র করে তোলা উপন্যাসের স্বধর্ম। রশীদ করীমের জীবনবোধের দ্বিধাই সম্ভবত এর অন্যতম কারণ। তাঁর ‘উত্তম পুরুষ’ উপন্যাসে এই দ্বিধার পরিচয় অধিকতর সুস্পষ্ট, যেখানে সমাজবোধ ও ইতিহাসচেতনার ক্ষেত্রে লেখকের সীমাহীন ভ্রান্তি আমাদের বিব্রত করে। একটি মহৎ উপন্যাসও জীবনবোধশূন্য হতে পারে। কিন্তু ঔপন্যাসিকের জীবনার্থহীনতা সেই শূন্যতাকে যথার্থ ও অনিবার্য করে তুলতে ব্যর্থ হয়।’’ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট গল্পকার ও প্রাবন্ধিক অতীন্দ্রিয় পাঠক ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’ উপন্যাস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘চরিত্রগুলি, বিভিন্ন ঘটনা, নানা তথ্যাদির এই বিশ্লেষণের পর মনে হতে পারে এটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। মানবিকও হতে পারে। অথবা যৌথভাবে, রাজনৈতিক চাপে মানবিকতার সংকট এই উপন্যাসের প্রতিপাদ্য বিষয়।’
‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’ উপন্যাাসের আলোচনা প্রসঙ্গে রফিকুল্লাহ খান লিখেছেন, ‘মানবমনের অন্তস্তলবাসী সংকটের রূপায়ণে রশীদ করীমের শিল্পদক্ষতা এ-উপন্যাসে প্রাগ্রসরতার স্বাক্ষরবাহী।’ এছাড়াও তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘রশীদ করীমের উপন্যাসবিধৃত চরিত্র-পাত্ররা যেন অনেকটা ইউরোপীয় ধাঁচে গড়া। একই চরিত্রের মধ্যে অনেকগুলো পারম্পর্যহীন কার্যকারণহীন অনুভূতি ও বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস সম্ভবত ঔপন্যাসিকের বিচিত্র শিল্প-অভিজ্ঞতার ফল।’
‘আমার যত গ্লানি’ উপন্যাস নিয়ে রফিকুল্লাহ খান লেখেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে মধ্যবিত্তমানসের দ্বিধান্বিত ও অন্তর্দ্বন্দ্বময় আত্মস্বরূপের উন্মোচন ঘটেছে রশীদ করীমের আমার যত গ্লানি উপন্যাসে।’ মুক্তিযদ্ধের সময়কার গণহত্যার চিত্র এই উপন্যাসে ভয়াবহভাবে বর্ণিত। তদুপরি সমালোচকের মনে হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ-উৎসারিত চেতনার পরিবর্তে রশীদ করীম সন্ধান করেছেন মধ্যবিত্তের আত্মরতি, আত্মধিক্কার, বিচ্ছিন্নতাবোধ ও কৌতুকপ্রবণতা।’
দেশভাগ, পাকিস্তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের উত্থান-এই সময়পর্বের আত্মবিবরণ হয়ে উঠেছে রশীদ করীমের সাহিত্য। তিনি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন ইতিহাস-জিজ্ঞাসার সামনে। তাঁর জীবন ও সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে বাঙালি মধ্যবিত্তের আত্মসত্তা অন্বেষণের নিবিড় আখ্যান।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক; কথাসাহিত্যিক।
দুটি হাতের মধ্যে আমরা ডানহাতকেই বেশি এগিয়ে রাখি তাই না! ডান হাতই যেন সঠিক। বাম হাত দিয়ে কাউকে কোনো কিছু দিলেই তো মা দিতো বকা! তবে কেউ কেউ আমাদের আশপাশে ছিল যাঁরা বাম হাতে লিখতেন বা কাজ করতেন।
২১ ঘণ্টা আগেথাকি আমি ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে। ভদ্দরলোকের চৌহদ্দীর বাইরে। তবুও তো, কত কিছুর সাধ হয়। ভাবলাম, ভদ্দরলোকেরা তো শুনি কত কীই খায়, একদিন চেখে দেখা যাক তাদের খাবার। তো, গেলাম একদিন ভদ্দরলোকেদের শহর, বনানীতে। কিন্তু, কিছুই তো চিনি না। কই খাইতে যাওয়া যায়?
১ দিন আগেপরীক্ষার হল থেকে অফিসের মিটিং, কাজের জিনিস মনে পড়ে না কিন্তু মাথায় মাছির মতো ভনভন করে বাজে কিছু ভাইরাল গান। চান বা না চান, বাসের স্পিকার থেকে চায়ের টং-এ বসা মুরুব্বির নোকিয়া ১২০০ সেট মারফত এইসব গান আপনার কানে ঢুকে পড়ছে হরদম। গত এক দশকে এই কালেকটিভ নেশা জাগানিয়া ৭টা ভাইরাল গান কোনগুলা ছিল?
২ দিন আগেহ্যারি পটারের গল্পগুলো কোথায় ঘটে? অতীতে না ভবিষ্যতে? কিছুদিন আগেই একজন আমাকে বললেন, সপ্তম বইয়ের ক্লাইম্যাক্সেও হ্যারি মরে নি (এবং এই তথ্য নাকি খুব জরুরি!)। অথচ হ্যারি যে অসুস্থ ছিল এটাই তো আমি জানতাম না!
৩ দিন আগে