leadT1ad

আজ ১৫ আগস্ট

শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের গোপন বার্তায় যা ছিল

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
স্ট্রিম গ্রাফিক

আজ ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ৫০ বছর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসন থেকে নতুন এক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সূচনা হয়। সামরিক অভুত্থানের মাধ্যমে সংঘটিত এই পালাবদলকে তখন ঢাকার মার্কিন দূতাবাস দেখেছিল এক ‘সফল ও চ্যালেঞ্জহীন’ ক্ষমতার পরিবর্তন হিসেবে। সে সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ই. বোস্টারের পাঠানো গোপন তারবার্তায় এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। কয়েক বছর আগে মার্কিন সরকার এ তারবার্তাগুলো অবমুক্ত করে।

১৫–২০ আগস্ট পর্যন্ত বোস্টারের ধারাবাহিক তারবার্তায়, বিশেষ করে ১৫ ও ১৬ আগস্টের তার বার্তায় সে সময়কার ঢাকা ও বাংলাদেশের পরিস্থিতির চিত্র উঠে এসেছে। তাতে আরও বলা হয়, তখন ঢাকা ছিল শান্ত। উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিরোধ দেখা যায়নি। সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ—সব বাহিনী দেশের নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য জানিয়েছে।

তারবার্তার প্রাথমিক ভাষ্যে বোস্টার বলেন, শেখ মুজিবের পতন সাধারণ মানুষ শান্তভাবে মেনে নিয়েছে, এমনকি কিছুটা স্বস্তিও পেয়েছে। তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিবের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার প্রবণতা, পরিবারতন্ত্র আর রাজনৈতিকভাবে একদল কেন্দ্রিকতা জনগণকে তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।

এসব তারবার্তায় শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড নিয়ে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকারের চরিত্র ও চ্যালেঞ্জ নিয়েও মন্তব্য ও মূল্যায়ন ছিল। গৃহযুদ্ধ বিষয়েও তিনি সতর্ক করেছিলেন।

ডেভিস ই. বোস্টার। সংগৃহীত ছবি
ডেভিস ই. বোস্টার। সংগৃহীত ছবি

ভারতের ভূমিকা

বোস্টারের পর্যবেক্ষলে বলা হয়, নতুন সরকার ভারতবিরোধী মনোভাব রাখলেও প্রতিবেশী দেশের সন্দেহ বাড়াতে চায় না; বরং ভারতের কাছে ‘অবিচল ধারাবাহিকতা’ প্রদর্শনের চেষ্টা করবে। বোস্টার লেখেন, নতুন সরকার ভারতবিরোধী মনোভাবের হলেও ‘প্রতিবেশী ভারতের সন্দেহ বা শঙ্কা জাগাতে চাইবে না’; অর্থাৎ সরকার ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন বাড়াতে নয়, বরং কমাতে চায়।

তবে তারবর্তায় বোস্টার উল্লেখ করেন, রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) প্রভাব কিছুটা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার ইচ্ছা রয়েছে নতুন সরকারের। ২০ আগস্টের আরেক বার্তায় তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকায় শক্তিশালী ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে, ১৯ আগস্ট দিল্লিস্থ মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তা জানায়, ভারতের বামপন্থী নেতারা প্রকাশ্যে এই অভ্যুত্থানে ‘সিআইএ জড়িত’ বলে অভিযোগ তুললেও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেনি। ওয়াশিংটন অভ্যন্তরীণভাবে এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন মনে করেছিল।

নতুন সরকারের চরিত্র ও চ্যালেঞ্জ

‘মোশতাকের মন্ত্রিসভায় পুরোনো পরিচিত মুখ থাকলেও জনপ্রিয়তার সম্ভাবনা কম।’ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকারের চরিত্র সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তারবার্তায় এমন কথা লিখেছিলেন বোস্টার। এ সময় তিনি আরও মন্তব্য করেন, এই সরকারে মুজিবের ঘনিষ্ঠদের (মৃত বা বহিষ্কৃত) বাদ দেওয়া হয়েছে। তবুও এটি এমন সব পুরোনো পরিচিত মুখের সমন্বয়ে গঠিত, যাঁরা আগের দুঃশাসনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত।

প্রাথমিক ভাষ্যে বোস্টার বলেন, শেখ মুজিবের পতন সাধারণ মানুষ শান্তভাবে মেনে নিয়েছে, এমনকি কিছুটা স্বস্তিও পেয়েছে। তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিবের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার প্রবণতা, পরিবারতন্ত্র আর রাজনৈতিকভাবে একদল কেন্দ্রিকতা জনগণকে তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।

অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তারবার্তায় যা পাওয়া যায় তা হলো, এটি করেছিলেন মাত্র কয়েকজন। তাই ক্ষমতা গ্রহণের পর করণীয় নিয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে সে সময় বোস্টার সতর্ক করেন, দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে সরকারের প্রাথমিক সুবিধাজনক অবস্থান দ্রুত হারিয়ে যেতে পারে। আর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে সেনাবাহিনী আবারও হস্তক্ষেপ করতে পারে।

বোস্টারের মতে, নতুন সরকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অতীতের চেয়ে বেশি সৌহার্দ্যময় হতে পারে। কারণ, মুজিব সরকারের বামঘেঁষা নেতারা তখন আর ক্ষমতার বলয়ে ছিলেন না। অন্যদিকে খন্দকার মোশতাক সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, মোশতাক আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশংসা করেছেন। তিনি মনে করতেন, যুক্তরাষ্টই বাংলাদেশকে সবচেয়ে কার্যকর সহায়তা দিতে সক্ষম। তবে এ সহায়তার প্রত্যাশা মার্কিন কূটনীতির জন্য চ্যালেঞ্জও বয়ে আনতে পারে বলে বোস্টার উল্লেখ করেন।

গৃহযুদ্ধ ও আঞ্চলিক ঝুঁকি

২০ আগস্টের তারবার্তায় বোস্টার সতর্ক করেন, গৃহযুদ্ধ হলে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তাই নতুন সরকারের প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত অভ্যন্তরীণ সংঘাত এড়ানো এবং দ্রুত স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা।

মার্কিন সরকারের অবমুক্ত করা এসব বার্তা থেকে স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক মূল্যায়ন ছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান দ্রুত ও অনায়াসে সফল হয়েছে। নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করবে না, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করবে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে—তারবার্তায় এমন ধারণাও প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।

১৯৭৫ সালের ১৫–২০ আগস্টের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দূতাবাস থেকে পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ তারবার্তাগুলোর সারাংশ:

১৫ আগস্ট ১৯৭৫

তারবার্তা: COUP IN BANGLADESH: SITUATION REPORT

প্রেরক: রাষ্ট্রদূত ডেভিস ই. বোস্টার (ঢাকা)

  • ভোরে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত।
  • সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ—সব বাহিনী অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে।
  • নতুন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা: খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
  • ঢাকা শান্ত। তীব্র কোনো প্রতিরোধ দেখা যায়নি।
  • ঘটনার ভাষ্য: এটি কার্যত সফল সামরিক অভ্যুত্থান, নতুন নেতৃত্ব ক্ষমতায় সুপ্রতিষ্ঠিত হতে চাইছে।
  • ভারতের প্রতিক্রিয়া এখনো অজানা। তবে এই ঘটনাকে তারা হয়তো ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ’ বিষয় হিসেবে দেখছে।
১৬ আগস্ট ১৯৭৫, রাষ্ট্রদূত ডেভিস ই. বোস্টারের পাঠানো তারবার্তা।
১৬ আগস্ট ১৯৭৫, রাষ্ট্রদূত ডেভিস ই. বোস্টারের পাঠানো তারবার্তা।

১৬ আগস্ট ১৯৭৫

তারবার্তা: PRELIMINARY COMMENT ON THE COUP IN BANGLADESH

প্রেরক: রাষ্ট্রদূত ডেভিস ই. বোস্টার (ঢাকা)

  • নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে না। তবে অতীতের মতো প্রো-ইন্ডিয়ান থাকবে না।
  • ভারতের সন্দেহ বা শঙ্কা না বাড়ানোই তাদের কূটনৈতিক লক্ষ্য হবে।
  • সোভিয়েত প্রভাব কিছুটা কমিয়ে ভারসাম্য আনার চেষ্টা হতে পারে।
  • যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা।

২০ আগস্ট ১৯৭৫

তারবার্তা: SITUATION UPDATE & INDIAN REACTION CONCERNS

প্রেরক: রাষ্ট্রদূত ডেভিস ই. বোস্টার (ঢাকা)

  • গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা এড়ানো এখন প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য। কারণ, গৃহযুদ্ধ হলে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
  • গত সপ্তাহের ঘটনাবলীতে ‘ভারত জড়িত’ থাকার কোনো প্রমাণ নেই।
  • দেশজুড়ে শক্তিশালী ভারতবিরোধী মনোভাব দেখা যাচ্ছে।
  • নতুন সরকার স্থিতিশীল হতে চাইছে, তবে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ বড়।

তারবার্তায় বোস্টার সতর্ক করেন, গৃহযুদ্ধ হলে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তাই নতুন সরকারের প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত অভ্যন্তরীণ সংঘাত এড়ানো এবং দ্রুত স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা।

যেভাবে তৈরি হলো হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট

রাজনৈতিক পটভূমি: মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রগঠনের প্রধান কাণ্ডারী। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন সর্বশক্তিমান রাজনৈতিক নেতাও। এই বাস্তবতায় ১৯৭৫ সালের শুরুতে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশালের প্রতিষ্ঠা এবং সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত অনেকের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে সরে আসা হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিল। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি কার্যত নিষ্ক্রিয় বা দমন হওয়ায় এ সময় ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছিল ভীষণভাবে। পাশাপাশি সংকুচিত হয়েছিল সমালোচনা প্রকাশের পথ। বিশ্লেষকদের মতে, এতে অসন্তুষ্টি শুধু বিরোধী গোষ্ঠীতে নয়, ক্ষমতার ভেতরকার কিছু অংশেও জমে ওঠে।

বিচার বর্হিভূত হত্যা: স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের নের্তৃত্বে গঠিত সরকারের হাতে প্রথম বিচার বর্হিভূত হত্যার শিকার হন মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদার। ১৯৭৫ সালের ১ আগস্ট সাভার থেকে গ্রেপ্তারের পর ২ আগস্ট বিপ্লবী এই নেতাকে হত্যা করা হয়। দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর 'বাংলাদেশ: আ লিগ্যাসি অব ব্লাড' বইয়ে সিরাজ সিকদারের বোন শামীম সিকদারের বরাতে লিখেছেন, শামীম সিকদার তাঁর ভাই হত্যার জন্য শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করেছিলেন।

শুধু সিরাজ সিকদার নন, মুজিবের শাসনামলে তাঁর গড়া রক্ষীবাহিনীর হাতে জাসদসহ ভিন্নমতের অনেকেই নিহত হয়েছিলেন, যা জনমনে যা নীরব অসন্তোষের জন্ম দিয়েছিল।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ছবি: সংগৃহীত
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ছবি: সংগৃহীত

অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি: ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এ সময় ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি সরকারের জনসমর্থনে বড় ধাক্কা দেয়। খাদ্য সংকট, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, কালোবাজারি–এসব সমস্যা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় জনগণের আশা-ভরসা যেমন ক্ষয় করেছে, তেমনি যে নেতাকে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ ভরসাস্থল মনে করেছে, তাঁর সেই ইমেজও ধূলায় লুটিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে সাফল্য এলেও জনগণের প্রত্যাশার তুলনায় উন্নয়ন ছিল ধীর। দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিও ছিল না। অর্থনীতিবিদদের ভাষ্যে, এসব কারণেই মূলত তখনকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল।

প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা সংকট: ইতিহাস থেকে জানা যায়, একাত্তরের পর সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একক কাঠামো ও শৃঙ্খলা আনার প্রক্রিয়া ছিল জটিল। কিছু মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা কর্মকর্তা সরকারের নীতি ও পদ্ধতি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন; বিশেষত ‘রক্ষীবাহিনী’ নামে বিশেষ মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের পর থেকে সেনা সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে শেখ মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও পক্ষপাতের অভিযোগ তার প্রশাসনিক বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

দিল্লিস্থ মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তা জানায়, ভারতের বামপন্থী নেতারা প্রকাশ্যে এই অভ্যুত্থানে ‘সিআইএ জড়িত’ বলে অভিযোগ তুললেও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেনি।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব: মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা ছিল। তবে স্বাধীন দেশে সরকার গঠনের পর সে জনপ্রিয়তায় ধীরে ধীরে ধস নামে। এর মূলে ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বের বলয় থেকে তাঁর একনায়ক হয়ে ওঠা। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আর তাঁর পরিবারকেন্দ্রিক প্রভাবও এক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী, বিভিন্ন বইপত্রে এমনটাই বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রভাব: মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) মধ্যেও ঘনিষ্ঠ মিত্রতা ছিল। ফলে অনেকের এমন ধারণা ছিল, এই মিত্রতা বাংলাদেশকে একপাক্ষিক কূটনৈতিক অবস্থানে ফেলছে। একাত্তর-পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সঙ্গে শেখ মুজিব সরকারের সম্পর্ক ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল। আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে ভারসাম্যের এই অভাব অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন এনে দেয়।

তাৎক্ষণিক কারণ: অভ্যুত্থান ছিল সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের পরিকল্পনা, যা সেই সময়কার অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়েছিল। পরিকল্পনাকারীদের বিশ্বাস ছিল, শেখ মুজিব সরকারের পতন হলে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে না। বাস্তবে তেমনই ঘটেছিল। সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে ও বেসামরিক প্রশাসনে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ না থাকায় অভ্যুত্থানটি দ্রুত সফল হয়।

শেখ মুজিবর রহমানের পতন ছিল বহুমাত্রিক সংকটের ফল। একদিকে জনসমর্থন শেষ হওয়া, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সামরিক অসন্তোষ; অন্যদিকে ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীভূতকরণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ভারসাম্যের অভাব—সব মিলিয়ে নির্মম ও দুঃখজনক এ হত্যাকাণ্ড নিছক কিছু সেনা সদস্যের সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না; বরং এটি ছিল রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন স্তরে জমে থাকা অমীমাংসিত অসন্তোষের আকস্মিক বিস্ফোরণ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত