বই নিষিদ্ধ
অনুরাধা ভাসিন
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে দেওয়া জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়। দুটি আলাদা ভাগ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে নয়াদিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়।
এই ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। তার আগেই ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলকে ঘিরে আরও সম্ভাব্য বিভাজন বা অন্য প্রশাসনিক পরিবর্তনের খবর ছড়িয়ে পড়ছে। শ্রীনগরের আকাশে যুদ্ধবিমানের অস্বাভাবিক গতিবিধি আতঙ্কিত করছে স্থানীয় মানুষদের। মানুষের স্মৃতিতে ফিরে আসছে ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের সেইসব ভয়াবহ দিনের কথা। সেই দিনগুলোতেও আকাশে যুদ্ধবিমানের অস্বাভাবিক ওড়াওড়ি ছিল। তখনও আজগুবি সব খবর ছড়িয়ে পড়েছিল।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে দেওয়া জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়। দুটি আলাদা ভাগ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে নয়াদিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়।
এই ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। তার আগেই ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলকে ঘিরে আরও সম্ভাব্য বিভাজন বা অন্য প্রশাসনিক পরিবর্তনের খবর ছড়িয়ে পড়ছে। শ্রীনগরের আকাশে যুদ্ধবিমানের অস্বাভাবিক গতিবিধি আতঙ্কিত করছে স্থানীয় মানুষদের। মানুষের স্মৃতিতে ফিরে আসছে ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের সেইসব ভয়াবহ দিনের কথা। সেই দিনগুলোতেও আকাশে যুদ্ধবিমানের অস্বাভাবিক ওড়াওড়ি ছিল। তখনও আজগুবি সব খবর ছড়িয়ে পড়েছিল।
কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়ার ষষ্ঠ বার্ষিকীতেই এলো আরেকটা খবর। সরকারি আদেশে ২৫টি বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বইগুলো জম্মু ও কাশ্মীরের ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে লেখা। অভিযোগ—বইগুলো ‘ভুল বয়ান’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ছড়াচ্ছে। যদিও সরকারের এই অতি সাধারণীকরণকৃত সিদ্ধান্ত প্রমাণহীন, যাচাই-বাছাই করলে টিকবে না।
নিষিদ্ধ করা বইগুলোর একটি আমার লেখা ‘অ্যা ডিসম্যান্টলড স্টেট: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব কাশ্মীর আফটার আর্টিকেল ৩৭০’। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে হার্পারকলিন্স বইটি প্রকাশ করে। ২০১৯–এর পর জম্মু ও কাশ্মীরের দৈনন্দিন বাস্তবতার দলিল এই বই। মাঠপর্যায়ের গবেষণা, বহু মানুষের সাক্ষাৎকার আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা। জম্মু ও কাশ্মীরে ভারত সরকারের ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ ফিরিয়ে আনার যে দাবি তাকে এই বই বেলুনের মতো ফুটো করে দিয়েছে।
আর্টিকেল ৩৭০ বাতিলের সিদ্ধান্তকে সরকার এই বলে ন্যায্যতা দিতে চেয়েছিল যে, তা এই অঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়ন নিয়ে আসবে। এর ভেতর দিয়ে সরকার আড়াল করতে থাকে রাজ্যজুড়ে তাদের চাপিয়ে দেওয়া অনেকগুলো বাস্তবতা। কাশ্মীর জুড়ে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে নজিরবিহীন শারীরিক ও সাইবার নিয়ন্ত্রণ। ঘটছে নির্বিচার গ্রেপ্তার, এর মধ্যে ভারতপন্থী বলে পরিচিত রাজনীতিবিদ ও তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন। কাঁটাতার ও সামরিক ব্যারিকেড দিয়ে কাশ্মীর উপত্যকাকে এক কারফিউ–জোনে পরিণত করা হয়েছে। ইন্টারনেট থেকে টেলিফোন—যোগাযোগের সকল উপায়কে বন্ধ করে জনগণকে অন্ধকারে রেখেছে সরকার।
ছয় মাস পরে নিষেধাজ্ঞা খানিকটা শিথিল হয়। চালু করা হয় আংশিক ইন্টারনেট সেবা। কিন্তু তখন ভারত রাষ্ট্রের দমনচক্র আরও কঠোর হয়ে ওঠে। বেড়ে যায় সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সামাজিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান, তল্লাশি আর গ্রেপ্তার। এসময় যে কাউকে বিনা বিচারে দুই বছর পর্যন্ত আটকে রাখার বিতর্কিত জননিরাপত্তা আইনের (পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট বা পিএসএ) ব্যবহার করে নির্বিচার আটক ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়।
এসব বাস্তবতার খুব সামান্যই এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রের দমননীতির কারণে সাংবাদিকতা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে স্থানীয় সংবাদপত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে পত্রিকাগুলো সরকারি লাইনে হাঁটেনি, সেগুলোর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। মানিয়ে নেওয়া পত্রিকাগুলো সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে বেঁচে আছে বটে—তবে তাদের সাংবাদিকতা হারিয়ে গেছে।
নিয়ন্ত্রণ করে নেওয়া সংবাদপত্রগুলো আর প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহের দলিল রইল না। জনগণের কণ্ঠ পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। সাংবাদিকরাও আর প্রশ্ন করতে পারলেন না। এই অঞ্চলের বিস্তৃতি দৈনন্দিন ইতিহাস যেখানে ছিল—সেরকম সংবাদপত্রের সমৃদ্ধ আর্কাইভও অদৃশ্য হয়ে গেল বা সরিয়ে দেওয়া হলো।
গত ছয় বছরে যেকোনো সমালোচনার প্রতি সরকার চরম অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশ করেন এরকম সবার ওপর শাস্তি নেমে এসেছে। কখনো ভয়ভীতি ও জিজ্ঞাসাবাদ, কখনো ডিভাইস জব্দ, আবার কখনও আয়কর ও অর্থপাচার মামলা বা সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে বিদ্ধ করা হয়েছে তাদের। সঙ্গে ছিল স্বল্পমেয়াদি আটক বা দীর্ঘমেয়াদি গ্রেপ্তার। স্থানীয় সাংবাদিকতা পরিণত হয়েছে সরকারি জনসংযোগ বিভাগের সম্প্রসারিত শাখায়। নাগরিকদের কণ্ঠরোধ তো আরো আগেই করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে তথ্যের প্রবাহে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করা হয়েছে।
আমার বই সেই শূন্যতাটাই পূরণ করতে চেয়েছে। বইটিতে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের প্রথম দুই বছরকে ১২টি অধ্যায়ে আমি তুলে ধরেছি। এর মধ্যে ছিল—জনসাধারণের ওপর নেমে আসা ক্রমাগত দমন-পীড়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতাকে সংকীর্ণ করে ফেলা, ভিন্নমতকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা, কীভাবে নতুন সরকারি নীতি ও পদক্ষেপ মানুষের ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি কেড়ে নিয়েছে সেই চিত্র।
এক কথায় বইটিতে সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। এই সত্য উন্মোচিত হলে ভারত রাষ্ট্রের সরকারি সব বয়ান হুমকির মুখে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই আমার এই অনুসন্ধানে অস্বস্তি বোধ করেছে ভারত নামে এক আতঙ্কগ্রস্ত রাষ্ট্র। জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে যে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেবল আরো বেশি সামরিকায়ন, নির্মম দমন আর ভিন্নমত স্তব্ধ করার মধ্যেই সীমিত। সরকারের দমননীতি, পুলিশি নজরদারির রাষ্ট্র গঠন ও ভুল উন্নয়ন মডেল যে টেকসই নয় এবং এটি যে ব্যর্থ হবেই—আমার বইটি সেই সতর্কবার্তা জানিয়েছিল।
গত ছয় বছরে ভারত সরকার বিশ্বের চোখে ধুলো দিতে চেয়েছে শান্তি, স্বাভাবিকতা, পর্যটন ও উন্নয়নের সাফল্যের গল্প প্রচার করে। তবে এ বছরের ২২ এপ্রিল কাশ্মীরে ২৬ জন নিরীহ বেসামরিক নাগরিক হত্যার ঘটনা সরকারের সেই বেলুন ফাটিয়ে দিয়েছে। সরকারের উচিত ছিল এই ঘটনাকে কাশ্মীরে তাদের বহাল নীতিকে পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত হিসেবে নেওয়া।
অথচ সরকার ঘটনাটির পর আগের চেয়েও কঠোর হয়েছে। নতুন করে শুরু হয়েছে কাশ্মীরিদের ওপর দানবীয় নির্যাতন, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া। অথচ এই সময়ে কাশ্মীরে নাগরিকরা সন্ত্রাসবাদবিরোধী জনসমাবেশ করেছেন, সহিংসতা প্রত্যাখ্যানের ডাক দিয়ে পালন করেছেন বিভিন্ন কর্মসূচি। তিন দশকের ইতিহাসে এরকম হয়নি। এদিকে, তদন্তকারীরাও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডে স্থানীয়রা নয় বরং বিদেশিরা জড়িত।
গত তিন মাসে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে যে কাশ্মীরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সর্বব্যাপী নজরদারি আরও জোরদার করা হবে। ২৫টি বই নিষিদ্ধ করা এই চিন্তারই সম্প্রসারণ। অথচ বইগুলোর মধ্যে এই অঞ্চল সম্পর্কে গবেষণাধর্মী ইতিহাস, রাজনীতি ও আইনি বিষয়ে বর্ণনা আছে। সরকারি বয়ানের বাইরে আছে পাল্টা-বয়ান। সরকারি ইতিহাসের বাইরেও রয়েছে বিকল্প স্মৃতি। সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা সকল পাল্টা-বয়ান ও বিকল্প স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
সরকারি বয়ানের সঙ্গে খাপ খায় না বা সমালোচনা করে এমন সব লেখাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করে সরকার এখন এই বইগুলোকে বাজেয়াপ্ত করতে পারে। শুধু লিখিত শব্দকেই যে দোষী ঠাওরানো হচ্ছে এমন নয়। আপনি যদি সরকারি প্রেসক্রিপশনের বাইরে কিছু পড়েন তাহলেও আপনি জাতির নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য হুমকি। কিন্তু এভাবে নিষিদ্ধ করে চিন্তা ও স্মৃতিকে দমিয়ে রাখা যাবে না।
এই নিষেধাজ্ঞা অযৌক্তিক, জঘন্য, অপ্রাসঙ্গিক ও হাস্যকর। আর তা দেওয়া হয়েছে এমন এক সময় যখন শ্রীনগরে সরকার ‘চিনার বই উৎসব’ করছে। অথচ একই সময়ে দেওয়া সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা একটি ভয়াবহ বার্তা পৌঁছে দিল আমাদের কাছে। জ্ঞান ও তথ্য নিয়ন্ত্রণ করবে রাষ্ট্র। মানুষ কী লিখবে ও পড়বে, তাও রাষ্ট্রই ঠিক করে দেবে। নাগরিকদের চিন্তা জগতে পুলিশি তদারকি হবে আরও কঠোর।
গত বছর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীরে প্রথম বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘তারা (স্থানীয় রাজনীতিবিদ) যুবকদের হাতে পাথর দিয়েছে, আর তাঁর সরকার দিয়েছে বই ও ল্যাপটপ।’
অথচ কাশ্মীরে এখন প্রতিনিয়ত তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় ল্যাপটপসহ ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করা হয়। আর এখন তো কাশ্মীর নিয়ে লেখা বইও নিষিদ্ধ করা হলো। সরকারি দাবি যে আসলে ফাঁপা তা বুঝতে আর কারো বাকি রইল না। সব মিলিয়ে আমি আমার বইয়ে যা বলতে চেয়েছি সরকার সেটাকেই আরও সঠিক বলে প্রমাণ করল। কাশ্মীর মোটেও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।
অনুরাধা ভাসিন: কাশ্মীর টাইমসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, লেখক
[আল-জাজিরার ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সালেহ ফুয়াদ]
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে দেওয়া জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়। দুটি আলাদা ভাগ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে নয়াদিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়।
এই ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। তার আগেই ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলকে ঘিরে আরও সম্ভাব্য বিভাজন বা অন্য প্রশাসনিক পরিবর্তনের খবর ছড়িয়ে পড়ছে। শ্রীনগরের আকাশে যুদ্ধবিমানের অস্বাভাবিক গতিবিধি আতঙ্কিত করছে স্থানীয় মানুষদের। মানুষের স্মৃতিতে ফিরে আসছে ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের সেইসব ভয়াবহ দিনের কথা। সেই দিনগুলোতেও আকাশে যুদ্ধবিমানের অস্বাভাবিক ওড়াওড়ি ছিল। তখনও আজগুবি সব খবর ছড়িয়ে পড়েছিল।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে দেওয়া জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়। দুটি আলাদা ভাগ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে নয়াদিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়।
এই ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। তার আগেই ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলকে ঘিরে আরও সম্ভাব্য বিভাজন বা অন্য প্রশাসনিক পরিবর্তনের খবর ছড়িয়ে পড়ছে। শ্রীনগরের আকাশে যুদ্ধবিমানের অস্বাভাবিক গতিবিধি আতঙ্কিত করছে স্থানীয় মানুষদের। মানুষের স্মৃতিতে ফিরে আসছে ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের সেইসব ভয়াবহ দিনের কথা। সেই দিনগুলোতেও আকাশে যুদ্ধবিমানের অস্বাভাবিক ওড়াওড়ি ছিল। তখনও আজগুবি সব খবর ছড়িয়ে পড়েছিল।
কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়ার ষষ্ঠ বার্ষিকীতেই এলো আরেকটা খবর। সরকারি আদেশে ২৫টি বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বইগুলো জম্মু ও কাশ্মীরের ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে লেখা। অভিযোগ—বইগুলো ‘ভুল বয়ান’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ছড়াচ্ছে। যদিও সরকারের এই অতি সাধারণীকরণকৃত সিদ্ধান্ত প্রমাণহীন, যাচাই-বাছাই করলে টিকবে না।
নিষিদ্ধ করা বইগুলোর একটি আমার লেখা ‘অ্যা ডিসম্যান্টলড স্টেট: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব কাশ্মীর আফটার আর্টিকেল ৩৭০’। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে হার্পারকলিন্স বইটি প্রকাশ করে। ২০১৯–এর পর জম্মু ও কাশ্মীরের দৈনন্দিন বাস্তবতার দলিল এই বই। মাঠপর্যায়ের গবেষণা, বহু মানুষের সাক্ষাৎকার আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা। জম্মু ও কাশ্মীরে ভারত সরকারের ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ ফিরিয়ে আনার যে দাবি তাকে এই বই বেলুনের মতো ফুটো করে দিয়েছে।
আর্টিকেল ৩৭০ বাতিলের সিদ্ধান্তকে সরকার এই বলে ন্যায্যতা দিতে চেয়েছিল যে, তা এই অঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়ন নিয়ে আসবে। এর ভেতর দিয়ে সরকার আড়াল করতে থাকে রাজ্যজুড়ে তাদের চাপিয়ে দেওয়া অনেকগুলো বাস্তবতা। কাশ্মীর জুড়ে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে নজিরবিহীন শারীরিক ও সাইবার নিয়ন্ত্রণ। ঘটছে নির্বিচার গ্রেপ্তার, এর মধ্যে ভারতপন্থী বলে পরিচিত রাজনীতিবিদ ও তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন। কাঁটাতার ও সামরিক ব্যারিকেড দিয়ে কাশ্মীর উপত্যকাকে এক কারফিউ–জোনে পরিণত করা হয়েছে। ইন্টারনেট থেকে টেলিফোন—যোগাযোগের সকল উপায়কে বন্ধ করে জনগণকে অন্ধকারে রেখেছে সরকার।
ছয় মাস পরে নিষেধাজ্ঞা খানিকটা শিথিল হয়। চালু করা হয় আংশিক ইন্টারনেট সেবা। কিন্তু তখন ভারত রাষ্ট্রের দমনচক্র আরও কঠোর হয়ে ওঠে। বেড়ে যায় সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সামাজিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান, তল্লাশি আর গ্রেপ্তার। এসময় যে কাউকে বিনা বিচারে দুই বছর পর্যন্ত আটকে রাখার বিতর্কিত জননিরাপত্তা আইনের (পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট বা পিএসএ) ব্যবহার করে নির্বিচার আটক ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়।
এসব বাস্তবতার খুব সামান্যই এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রের দমননীতির কারণে সাংবাদিকতা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে স্থানীয় সংবাদপত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে পত্রিকাগুলো সরকারি লাইনে হাঁটেনি, সেগুলোর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। মানিয়ে নেওয়া পত্রিকাগুলো সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে বেঁচে আছে বটে—তবে তাদের সাংবাদিকতা হারিয়ে গেছে।
নিয়ন্ত্রণ করে নেওয়া সংবাদপত্রগুলো আর প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহের দলিল রইল না। জনগণের কণ্ঠ পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। সাংবাদিকরাও আর প্রশ্ন করতে পারলেন না। এই অঞ্চলের বিস্তৃতি দৈনন্দিন ইতিহাস যেখানে ছিল—সেরকম সংবাদপত্রের সমৃদ্ধ আর্কাইভও অদৃশ্য হয়ে গেল বা সরিয়ে দেওয়া হলো।
গত ছয় বছরে যেকোনো সমালোচনার প্রতি সরকার চরম অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশ করেন এরকম সবার ওপর শাস্তি নেমে এসেছে। কখনো ভয়ভীতি ও জিজ্ঞাসাবাদ, কখনো ডিভাইস জব্দ, আবার কখনও আয়কর ও অর্থপাচার মামলা বা সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে বিদ্ধ করা হয়েছে তাদের। সঙ্গে ছিল স্বল্পমেয়াদি আটক বা দীর্ঘমেয়াদি গ্রেপ্তার। স্থানীয় সাংবাদিকতা পরিণত হয়েছে সরকারি জনসংযোগ বিভাগের সম্প্রসারিত শাখায়। নাগরিকদের কণ্ঠরোধ তো আরো আগেই করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে তথ্যের প্রবাহে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করা হয়েছে।
আমার বই সেই শূন্যতাটাই পূরণ করতে চেয়েছে। বইটিতে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের প্রথম দুই বছরকে ১২টি অধ্যায়ে আমি তুলে ধরেছি। এর মধ্যে ছিল—জনসাধারণের ওপর নেমে আসা ক্রমাগত দমন-পীড়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতাকে সংকীর্ণ করে ফেলা, ভিন্নমতকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা, কীভাবে নতুন সরকারি নীতি ও পদক্ষেপ মানুষের ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি কেড়ে নিয়েছে সেই চিত্র।
এক কথায় বইটিতে সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। এই সত্য উন্মোচিত হলে ভারত রাষ্ট্রের সরকারি সব বয়ান হুমকির মুখে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই আমার এই অনুসন্ধানে অস্বস্তি বোধ করেছে ভারত নামে এক আতঙ্কগ্রস্ত রাষ্ট্র। জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে যে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেবল আরো বেশি সামরিকায়ন, নির্মম দমন আর ভিন্নমত স্তব্ধ করার মধ্যেই সীমিত। সরকারের দমননীতি, পুলিশি নজরদারির রাষ্ট্র গঠন ও ভুল উন্নয়ন মডেল যে টেকসই নয় এবং এটি যে ব্যর্থ হবেই—আমার বইটি সেই সতর্কবার্তা জানিয়েছিল।
গত ছয় বছরে ভারত সরকার বিশ্বের চোখে ধুলো দিতে চেয়েছে শান্তি, স্বাভাবিকতা, পর্যটন ও উন্নয়নের সাফল্যের গল্প প্রচার করে। তবে এ বছরের ২২ এপ্রিল কাশ্মীরে ২৬ জন নিরীহ বেসামরিক নাগরিক হত্যার ঘটনা সরকারের সেই বেলুন ফাটিয়ে দিয়েছে। সরকারের উচিত ছিল এই ঘটনাকে কাশ্মীরে তাদের বহাল নীতিকে পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত হিসেবে নেওয়া।
অথচ সরকার ঘটনাটির পর আগের চেয়েও কঠোর হয়েছে। নতুন করে শুরু হয়েছে কাশ্মীরিদের ওপর দানবীয় নির্যাতন, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া। অথচ এই সময়ে কাশ্মীরে নাগরিকরা সন্ত্রাসবাদবিরোধী জনসমাবেশ করেছেন, সহিংসতা প্রত্যাখ্যানের ডাক দিয়ে পালন করেছেন বিভিন্ন কর্মসূচি। তিন দশকের ইতিহাসে এরকম হয়নি। এদিকে, তদন্তকারীরাও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডে স্থানীয়রা নয় বরং বিদেশিরা জড়িত।
গত তিন মাসে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে যে কাশ্মীরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সর্বব্যাপী নজরদারি আরও জোরদার করা হবে। ২৫টি বই নিষিদ্ধ করা এই চিন্তারই সম্প্রসারণ। অথচ বইগুলোর মধ্যে এই অঞ্চল সম্পর্কে গবেষণাধর্মী ইতিহাস, রাজনীতি ও আইনি বিষয়ে বর্ণনা আছে। সরকারি বয়ানের বাইরে আছে পাল্টা-বয়ান। সরকারি ইতিহাসের বাইরেও রয়েছে বিকল্প স্মৃতি। সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা সকল পাল্টা-বয়ান ও বিকল্প স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
সরকারি বয়ানের সঙ্গে খাপ খায় না বা সমালোচনা করে এমন সব লেখাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করে সরকার এখন এই বইগুলোকে বাজেয়াপ্ত করতে পারে। শুধু লিখিত শব্দকেই যে দোষী ঠাওরানো হচ্ছে এমন নয়। আপনি যদি সরকারি প্রেসক্রিপশনের বাইরে কিছু পড়েন তাহলেও আপনি জাতির নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য হুমকি। কিন্তু এভাবে নিষিদ্ধ করে চিন্তা ও স্মৃতিকে দমিয়ে রাখা যাবে না।
এই নিষেধাজ্ঞা অযৌক্তিক, জঘন্য, অপ্রাসঙ্গিক ও হাস্যকর। আর তা দেওয়া হয়েছে এমন এক সময় যখন শ্রীনগরে সরকার ‘চিনার বই উৎসব’ করছে। অথচ একই সময়ে দেওয়া সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা একটি ভয়াবহ বার্তা পৌঁছে দিল আমাদের কাছে। জ্ঞান ও তথ্য নিয়ন্ত্রণ করবে রাষ্ট্র। মানুষ কী লিখবে ও পড়বে, তাও রাষ্ট্রই ঠিক করে দেবে। নাগরিকদের চিন্তা জগতে পুলিশি তদারকি হবে আরও কঠোর।
গত বছর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীরে প্রথম বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘তারা (স্থানীয় রাজনীতিবিদ) যুবকদের হাতে পাথর দিয়েছে, আর তাঁর সরকার দিয়েছে বই ও ল্যাপটপ।’
অথচ কাশ্মীরে এখন প্রতিনিয়ত তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় ল্যাপটপসহ ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করা হয়। আর এখন তো কাশ্মীর নিয়ে লেখা বইও নিষিদ্ধ করা হলো। সরকারি দাবি যে আসলে ফাঁপা তা বুঝতে আর কারো বাকি রইল না। সব মিলিয়ে আমি আমার বইয়ে যা বলতে চেয়েছি সরকার সেটাকেই আরও সঠিক বলে প্রমাণ করল। কাশ্মীর মোটেও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।
অনুরাধা ভাসিন: কাশ্মীর টাইমসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, লেখক
[আল-জাজিরার ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সালেহ ফুয়াদ]
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাঁদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তাঁরা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাতচল্লিশের সেই দেশভাগ বা পার্টিশনের প্রভাব এখনো বহন করে চলেছি আমরা। একে কোনো একরৈখিক বয়ানে বেঁধে ফেলা দুষ্কর।
১ দিন আগেনব্বইয়ের ক্লান্তি কিংবা বার্ধক্য-জরায় যতীন স্যার কখনোই নিঃসঙ্গতায় ছিলেন না। বাংলার প্রাকৃতজনের দার্শনিক জ্ঞান ও শান্তির দ্রোণাচার্য যতীন সরকার জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাতপাই, রামকৃষ্ণ রোডের 'বানপ্রস্থ' নামের বাড়িতে মানুষের সান্নিধ্যেই থাকতেন।
২ দিন আগেতারেক মাসুদ নামটি খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ কাজ নয়। আমি তাঁর ছাত্র, অনুসারী, সহযোগী বা উত্তরসূরি হলেও অন্য অনেকের মতোই আমিও তাঁকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম। কিন্তু এই ভাই ডাকার অভ্যস্ততা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এত গভীরে প্রোত্থিত যে আনুষ্ঠানিক কারণেও শুধু নামটি উচ্চারণে আমার অস্বস্তি হয়।
২ দিন আগেমাত্র ২৮ বছরের তরুণ ছিলেন আল-জাজিরার ফিলিস্তিনি প্রতিবেদক আনাস আল শরীফ। স্পষ্টতার সঙ্গে তুলে ধরতেন ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার অমানবিক রূপ। তাঁর প্রতিবেদনে প্রাণহীন শুষ্ক তথ্য ছাড়িয়ে উঠে আসত অবরুদ্ধ জীবনের নিখাদ ও অনাবৃত প্রতিচ্ছবি।
৩ দিন আগে