leadT1ad

এআই প্রযুক্তির আধিপত্যে এগিয়ে আছে কে, চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্র

সম্প্রতি চিপ নির্মাতা কোম্পানি এনভিডিয়া বিশ্বের প্রথম ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে এবং কোম্পানির সিইও জেনসেন হুয়াং এখন বিশ্বজুড়ে রকস্টার মর্যাদা পেয়েছেন। ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের মূল্যমান নিয়ে ওপেনএআইয়ের লাভজনক অংশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী মাইক্রোসফটও পিছিয়ে নেই।

স্ট্রিম ডেস্ক
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এআই আধিপত্যের লড়াই। প্রতীকী ছবি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির আধিপত্যের লড়াইয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কেউই এখনো নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করতে পারেনি। যদিও বাজার পরিস্থিতি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রই শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারে।

সম্প্রতি চিপ নির্মাতা কোম্পানি এনভিডিয়া বিশ্বের প্রথম ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে এবং কোম্পানির সিইও জেনসেন হুয়াং এখন বিশ্বজুড়ে রকস্টার মর্যাদা পেয়েছেন। ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের মূল্যমান নিয়ে ওপেনএআইয়ের লাভজনক অংশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী মাইক্রোসফটও পিছিয়ে নেই।

তবে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দুনিয়ায় প্রাথমিক নেতৃত্ব মানেই শেষ জয়ের নিশ্চয়তা নয়। বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই চীনের অসাধারণ এআই অগ্রগতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে নতুন পথ দেখিয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে চীনের ডিপসিক (DeepSeek) তাদের আর১ (R1) লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল খরচ ও প্রক্রিয়াকরণ দক্ষতার দিক থেকে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে।

আরও চিন্তার বিষয় হলো, ট্রাম্প প্রশাসনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ওপর প্রকাশ্য আক্রমণ এবং ক্রমবর্ধমান চীনভীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ‘অন্যদের সঙ্গে কাজ না করার’ মনোভাব গড়ে উঠছে।

চলতি মাসেই চীনা স্টার্টআপ মুনশট এআই প্রকাশ করেছে তাদের কিমি কে২ (Kimi K2) মডেল, যা প্রযুক্তির মানদণ্ডে অনেক পশ্চিমা প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাড়িয়ে গেছে।

এআই প্রযুক্তির লড়াইয়ে অনেকগুলো বিষয়ের প্রভাব রয়েছে—শুধু শক্তিশালী চিপ নয়, প্রতিভা, সফটওয়্যার এবং কৌশলগত মনোযোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপাতত সেমিকন্ডাক্টরের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত জয়। ২০২৪ সালে ‘ছোট জায়গা, বেশি নিরাপত্তা’ (Small Yard, High Fence) নীতির আওতায় বাইডেন প্রশাসন উন্নত সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে এই নীতিই চীনের জন্য শাপে বর হয়েছে। চীন এখন নিজস্ব এআই চিপ তৈরিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে শুরু করেছে।

শেষ পর্যন্ত এআই প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব হার্ডওয়্যারের মাধ্যমে নয়, বরং সফটওয়্যারে কৌশলগত সাফল্যের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সদ্য ঘোষিত ‘এআই অ্যাকশন প্ল্যান’ সত্ত্বেও দীর্ঘ মেয়াদে চীনের প্রস্তুতিও বেশ শক্তিশালী। ২০২৪ সালের গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে চীন রয়েছে ১১তম স্থানে, আর যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে তৃতীয় স্থানে। ১৫ বছর আগেও এই ইনডেক্সে চীন ছিল ৪৩তম।

গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স বিশ্বজুড়ে উদ্ভাবনের উত্থান-পতনের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরলেও মৌলিক তাত্ত্বিক গবেষণার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই ইনডেক্সে বাদ থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা ও তত্ত্বাবধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বেসরকারি খাত প্রধানত বাণিজ্যিক মুনাফার উদ্দেশ্যেই কাজ করে, অন্যদিকে সরকারি সমর্থন বিজ্ঞানী ও গবেষকদের জ্ঞানের বহু দূরবর্তী সীমা অন্বেষণের সুযোগ করে দেয়।

আরও চিন্তার বিষয় হলো, ট্রাম্প প্রশাসনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ওপর প্রকাশ্য আক্রমণ এবং ক্রমবর্ধমান চীনভীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ‘অন্যদের সঙ্গে কাজ না করার’ মনোভাব গড়ে উঠছে।

এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বিপজ্জনকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের (এনএসএফ) সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফেডারেল সরকারের গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় ১৯৬৪ সালের স্পুটনিক-পরবর্তী সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে। বিশেষ করে মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে, ১৯৭০-এর দশকে যেখানে এই ব্যয় ছিল মোট বাজেটের ৩০ শতাংশ, তা বর্তমানে নেমে এসেছে প্রায় ১০ শতাংশে।

আরও চিন্তার বিষয় হলো, ট্রাম্প প্রশাসনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ওপর প্রকাশ্য আক্রমণ এবং ক্রমবর্ধমান চীনভীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ‘অন্যদের সঙ্গে কাজ না করার’ মনোভাব গড়ে উঠছে। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স-এর সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, ট্রাম্প প্রশাসনের ২০২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে মৌলিক গবেষণায় সরকারি অর্থায়ন কমিয়ে ৩০ বিলিয়ন ডলারে আনা হবে, যা ২০২৫ অর্থবছরে ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার। এনএসএফের হিসাব অনুযায়ী, এটি ২০০২ সালের স্তরে ফেরত যাওয়ার সমান হবে।

অন্যদিকে, চীন তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কর্মসূচি এগিয়ে নিতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ২৯ শতাংশের বিপরীতে ২৮ শতাংশ অবদান এসেছে চীন থেকে। গবেষণা ও উন্নয়নের খাতে চীনের ব্যয় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ হারে বেড়েছে, বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের বেড়েছে মাত্র ৩.৭ শতাংশ।

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এআই আধিপত্যের লড়াই। প্রতীকী ছবি।
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এআই আধিপত্যের লড়াই। প্রতীকী ছবি।

স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ সেন্টারের বিশেষজ্ঞ জিমি গুডরিচের মতে, সরকার-সমর্থিত মৌলিক গবেষণা খাতে ব্যয় কমিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী নেতৃত্ব চীনের হাতে তুলে দিচ্ছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নিয়েছেন। চীনের পূর্ববর্তী সরকারগুলোর ‘বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন’-এর ধারা অব্যাহত রেখে তিনি দীর্ঘদিন ধরে উদ্ভাবনের ভিত্তি হিসেবে মৌলিক গবেষণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন।

আজকের বৈশ্বিক এআই আধিপত্যের লড়াইকে প্রায়শই আমেরিকার বাজারভিত্তিক শিল্পনীতি বনাম চীনের রাষ্ট্র-সমর্থিত শিল্পনীতির সংঘাত হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু একমাত্র মৌলিক গবেষণাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে। সেটা হোক সরকারি কিংবা বেসরকারি ব্যবস্থা—উদ্ভাবনের মূল উৎস সবসময়ই অনুসন্ধান।

‘জেনেসিস: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি, হোপ এন্ড দ্য হিউম্যান স্পিরিট’ বইয়ে হেনরি কিসিঞ্জার, ক্রেইগ মান্ডি ও এরিক শ্মিট দাবি করেছেন, নতুন কিছু উদ্ঘাটন বা আবিষ্কার মানবজাতির সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। শুধু তাত্ত্বিক কিংবা ব্যবহারিক গবেষণা নয়, বরং বিস্তৃত ক্ষেত্রে গবেষণায় সমর্থন ও তত্ত্বাবধান আমাদের জানার ও বোঝার গভীরতাকে আরও প্রসারিত করে।

চীনারা বহু আগেই এই শিক্ষা আত্মস্থ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত আমেরিকা হয়তো এই শিক্ষাই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আবার শিখবে ।


চেক রিপাবলিক ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন এস রোচের মতামত অবলম্বনে তুফায়েল আহমদ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত