leadT1ad

ছয় মাসে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৪০০ টাকা পর্যন্ত

ফলন ভালো, মজুতও আছে: তবু চালের দাম বাড়ছে কেন

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে শুল্কমুক্ত আমদানি থাকা সত্ত্বেও ৫০ কেজির প্রতি বস্তায় চালের দাম বেড়েছে অন্তত ৪০০ টাকা। গত বছর যেখানে দাম ছিল ২ হাজার ৯০০ থেকে ৩ হাজার ১০০ টাকা, সেখানে এখন একই চালের দাম ৩ হাজার ৫০০–৩ হাজার ৯০০ টাকার মধ্যে।

মো. ইসতিয়াকঢাকা
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ২১: ৩১
চালের বাজার। ছবি: প্রতিবেদক

চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম নিম্নমুখী। সরকারের গুদামেও রেকর্ড পরিমাণ চালের মজুত রয়েছে। তারপরও বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার বেসরকারিভাবে আমদানির অনুমতি দিয়ে রেখেছে, আমদানির শুল্কও প্রত্যাহার করা হয়েছে। একইসঙ্গে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিও চালু রয়েছে। তারপরও দেশের বাজারে চালের দাম বাড়তি।

এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য পাইকারী ব্যবসায়ীরা ‘দেশের করপোরেট সিন্ডিকেটকেই’ দায়ী করছেন। অনেকে আবার অজুহাত হিসেবে বন্যা ও বৃষ্টির কথাও বলছেন। তবে কারণ যাই হোক, বাজার বিশ্লেষক ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের মতে, এটি মোটেই স্বাভাবিক নয়।

বাজারে দাম বৃদ্ধির চিত্র

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাস দেড়েক ধরে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে চাল। মোটা চালের দামই এখন ৬০ টাকার বেশি। মাঝারি মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল কেজিপ্রতি ৬৫–৭০ টাকা, সরু জাতের চাল ৭৫–৮৫ টাকা এবং ভালো মানের চাল ৯০–১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।

চালের বাজার। ছবি: প্রতিবেদক
চালের বাজার। ছবি: প্রতিবেদক

ক্রেতাদের অভিযোগ, বোরো জাতের নতুন চাল বাজারে আসার পর সরু চালের দাম কেজিতে ৭৫ টাকা পর্যন্ত নেমেছিল। এখন তা বেড়ে ৮০–৮২ টাকা। মাঝারি ও মোটা চালের ক্ষেত্রেও বাজারে একই চিত্র। গত ১৫ দিনে মোটা চালের খুচরা দাম বেড়েছে কেজিতে চার থেকে ছয় টাকা। অন্য চালেও প্রকারভেদে বেড়েছে কেজিতে পাঁচ থেকে ছয় টাকা।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ফটকের পাশে কুড়াতলী বাজারে কথা হয় গৃহিণী শিউলি আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখন বাজারে এলে মনে হয়, সোনার দামে চাল কিনছি। এক মাস আগেও ৭৫ টাকায় চিকন চাল পেয়েছি, আজ ৮২ টাকা চাইছে।’

চাকরিজীবী মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘আমার মাসিক খরচের বড় অংশই চলে যাচ্ছে শুধু খাবার কেনায়। চালের দাম না কমলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাবে।’

সূত্র: টিসিবি ও বিবিএস। স্ট্রিম গ্রাফিক
সূত্র: টিসিবি ও বিবিএস। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাজার করতে আসা আরেক ক্রেতা ব্যবসায়ী তানভীর ইসলাম বলেন, ‘সরকার আমদানির অনুমতি দিয়েছে, শুল্কও কমিয়েছে। তারপরও বাজারে দাম কমছে না। নিশ্চয়ই সিন্ডিকেটের খেলা চলছে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে শুল্কমুক্ত আমদানি থাকা সত্ত্বেও ৫০ কেজির প্রতি বস্তায় চালের দাম বেড়েছে অন্তত ৪০০ টাকা। গত বছর যেখানে দাম ছিল ২ হাজার ৯০০ থেকে ৩ হাজার ১০০ টাকা, সেখানে এখন একই চালের দাম ৩ হাজার ৫০০–৩ হাজার ৯০০ টাকার মধ্যে।

ঢাকা শহরের অন্যতম পাইকারি বাজার কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী মোরশেদ বলেন, ‘সরবরাহ ঠিক আছে। তবুও ঈদের পর থেকে দাম বাড়ছে।’

পার্শ্ববর্তী হাতিরপুল বাজারের মেসার্স নূর রাইস এজেন্সির মালিক জানান, মোটা চাল এখন কম পাওয়া যায়। তবুও খুচরায় কেজি ৫৮ টাকা। ৫০ কেজির বস্তায় চিকন ও মোটা—সব ধরনের চালের দাম প্রায় ৩৯০০ টাকা। প্রতিটি বস্তায় দাম বেড়েছে অন্তত ২০০ টাকা।

চাল ব্যবসায়ীরা জানান, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও করপোরেট কোম্পানির প্রতিনিধিরা কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনে নিয়েছেন। ফলে মিলার ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে ধান–চাল নেই বললেই চলে।

চাল ব্যবসায়ীরা জানান, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও করপোরেট কোম্পানির প্রতিনিধিরা কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনে নিয়েছেন। ফলে মিলার ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে ধান–চাল নেই বললেই চলে।

কারওয়ান বাজারের ইসলাম রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘চালের বাজার করপোরেট হাউসগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ভরা মৌসুমেও তারা দাম বাড়াচ্ছে। অথচ সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে। রহস্যময় এই নিয়ন্ত্রণ বন্ধ না করলে বাজার কোনোভাবেই স্থিতিশীল হবে না।’

বাংলাদেশ অটো রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘চলতি বছর উৎপাদিত ধানের প্রায় অর্ধেক করপোরেট ব্যবসায়ীরা মজুত করেছেন। তারা ছোট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে অধিক দরে ধান কিনে সংকট তৈরি করছেন।’

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘পর্যাপ্ত আমদানি থাকা সত্ত্বেও কারা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারের সঠিক মনিটরিং না থাকায় ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করছে।’

অন্যদিকে, করপোরেট কোম্পানিগুলো এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম স্বপন স্ট্রিমকে বলেন, ‘দেশ এখনো চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। দুই মাস আগে যদি আমদানির অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে বাজারে সংকট তৈরি হতো না।’

খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ) মনিরুজ্জামান জানান, রেকর্ড পরিমাণ বোরো সংগ্রহ করা হয়েছে। সরকারি মজুতও ভালো। বেসরকারি ও সরকারি—দুইভাবেই আমদানি হচ্ছে। ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এতে বাজার স্থিতিশীল হওয়ার আশা করা যায়।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক আব্দুল জলিল বলেন, ‘চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মহানগরে ১০টি ও প্রতিটি জেলায় একটি করে টিম কাজ করছে। সারা দেশের চালের আড়তে অভিযান চলছে। কেউ যদি বলে মনিটরিং নেই, তা সঠিক নয়।’

আমদানির সিদ্ধান্ত ও ভারতের বাজারে প্রভাব

চাল আমদানির মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার ৪ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থনীতিসংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়।

কিন্তু এর প্রভাব পড়েছে প্রতিবেশী ভারতে। ভারতের ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, বাংলাদেশ ৫ লাখ টন চাল শুল্কমুক্ত আমদানির সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর মাত্র দুই দিনেই দেশটিতে চালের দাম ১৪ শতাংশ বেড়ে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য বিপুল পরিমাণ চাল মজুত করেছেন। ইতোমধ্যেই পেট্রাপোল–বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে চাল রপ্তানি শুরু হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য বিপুল পরিমাণ চাল মজুত করেছেন। ইতোমধ্যেই পেট্রাপোল–বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে চাল রপ্তানি শুরু হয়েছে।

ভারতের বাজারে স্বর্ণা জাতের চাল কেজিতে ৩৪ রুপি থেকে বেড়ে ৩৯ রুপি, মিনিকেট ৪৯ রুপি থেকে ৫৫ রুপি, রত্না ৩৬–৩৭ রুপি থেকে ৪১–৪২ রুপি এবং সোনা মসুরি ৫২ রুপি থেকে বেড়ে ৫৬ রুপিতে পৌঁছেছে।

রাইসভিলা-র সিইও সুরজ আগরওয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত আমদানির ঘোষণা দেওয়ার পরদিন রাত থেকেই ভারত থেকে ট্রাক চলাচল শুরু হয়। লজিস্টিকস খরচের দিক থেকে পেট্রাপোল–বেনাপোল সীমান্ত সবচেয়ে সুবিধাজনক।’

হালদার ভেঞ্চার লিমিটেডের কেশব কুমার হালদার জানান, বাংলাদেশের অর্ডার বিশ্ববাজারে নতুন চাহিদা তৈরি করেছে। এতে ভারতীয় বাজার সাম্প্রতিক মন্দা থেকে পুনরুদ্ধারে সাহায্য পাবে।

পর্যাপ্ত মজুত

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সরকারি গুদামে মজুত রয়েছে ২১ লাখ ৪৩ হাজার ১৮৭ টন খাদ্যশস্য। এর মধ্যে চাল ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৪ টন ও ধান ১ লাখ ১ হাজার ৫৩০ টন।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫০ থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন। অর্থাৎ উৎপাদন ও মজুতের দিক থেকে ঘাটতি নেই। তারপরও বোরোর ভরা মৌসুমে টানা তিন মাস ধরে দাম ঊর্ধ্বমুখী।

খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার গণমাধ্যমে বলেন, ‘দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি খাদ্যশস্য মজুত আছে। খুব শিগগিরই চালের দাম কমে আসবে।’

সূত্র: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)
সূত্র: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)

বিশ্ববাজারে কমছে, দেশে বাড়ছে

ট্রেডিং ইকোনমিকসের তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে বিশ্ববাজারে চালের দাম কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছরের সাত মাসে কমেছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ, আর এক বছরে কমেছে ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, বিশ্ববাজারে চালের মূল্যসূচক এ বছরে ১৩ শতাংশ কমেছে।

ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানে রেকর্ড উৎপাদন ও রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে দাম কমেছে। অথচ বাংলাদেশে দাম ক্রমেই বেড়েছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে নতুন করে দাম না বাড়লেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সরু জাতের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ১৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ, মাঝারি জাতের পাইজাম ও আটাশ ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং মোটা জাতের স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের দাম ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানায়, টানা তিন মাস কমার পর জুলাই মাসে আবারও বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। জুলাইয়ে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর আগে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে তা কমেছিল।

Ad 300x250

সম্পর্কিত