leadT1ad

নতুন গবেষণা

সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় হুমকিতে চট্টগ্রাম উপকূল

আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন (প্যানেল আইপিসিসি) অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বৈশ্বিক হার বছরে ৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার। শুধু তাই নয়, মানবসৃষ্ট কার্যকলাপের কারণে কয়েক দশকে উচ্চতা বৃদ্ধির গতি আরও বেড়েছে।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় হুমকিতে চট্টগ্রাম উপকূল। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের উপকূলীয় তিন অঞ্চলের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে রয়েছে পূর্বাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম উপকূল। নতুন এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এর ফলে দেশের বাণিজ্য, শিল্প ও পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্র চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চল হয়ে উঠবে আরও ঝুঁকিপূর্ণ।

গবেষণাটির শিরোনাম ‘ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমির উল্লম্ব গতিবিধি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হিসাব।’ এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের তিনটি উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ভিন্ন ভিন্ন। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলীয় সমতল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় উচ্চতা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। এটি বছরে গড়ে ৪ দশমিক ৭৩ মিলিমিটার পর্যন্ত ওঠে। পশ্চিমাঞ্চলীয় সুন্দরবনের গঙ্গা জোয়ারভাটা সমভূমিতে এই হার তুলনামূলকভাবে মাঝারি, বছরে ৩ দশমিক ৬৬ মিলিমিটার। আর মধ্যাঞ্চলীয় ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও বরিশালের কিছু অংশজুড়ে বিস্তৃত মেঘনা মোহনায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম, বছরে মাত্র ২ দশমিক ৪ মিলিমিটার।

আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন (প্যানেল আইপিসিসি) অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বৈশ্বিক হার বছরে ৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার। শুধু তাই নয়, মানবসৃষ্ট কার্যকলাপের কারণে কয়েক দশকে উচ্চতা বৃদ্ধির গতি আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে নিম্নভূমির ও উচ্চ জনঘনত্বের দেশ। ফলে বাংলাদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি।

গবেষক দল বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির একটি সমন্বিত চিত্র পাওয়ার জন্য টিজি রেকর্ড, এসএ এবং ইনসার থেকে পাওয়া ভিএলএম ভিততথ্য একত্রে বিশ্লেষণ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি হওয়ায় বাংলাদেশ উপকূলে এ ধরনের বিশ্লেষণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

জিওমেটিকস ন্যাচারাল হ্যাজার্ডস অ্যান্ড রিস্ক জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিক গড় সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির (৩ দশমক ৩ মিলিমিটার/বছর) তুলনায় বাংলাদেশে এই হার গড়ে প্রায় ২ দশমিক ১ মিলিমিটার বেশি। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ও স্থানীয় ভূমিধস—দুই প্রভাব মিলিয়ে এই হিসাব করা হয়েছে ।

গবেষণা প্রকল্পটির প্রধান আশরাফ দেওয়ান স্ট্রিম-কে বলেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি কেবল হিমবাহ গলন বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে না। বরং ক্রমাগত ভূমি দখল ও সাগরে ভরাটের কারণেও হচ্ছে। এ কারণেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে তীব্র।’

গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির পৃথিবী ও গ্রহবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক আশরাফ দেওয়ান, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ প্রকৌশল, কম্পিউটিং ও গাণিতিক বিজ্ঞান গবেষক হার্দিক জৈন, বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. আলমগীর হোসেন, লন্ডনের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের মোহাম্মদ সরফরাজ গনি আদনান এবং কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ প্রকৌশল, কম্পিউটিং ও গাণিতিক বিজ্ঞান বিভাগের মো. রেদোয়ান মাহমুদ।

দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে এই গবেষণা। গবেষণাটির ফলাফল বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির বিষয়ে পূর্ববর্তী অনেক গবেষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আগে করা গবেষণাগুলোয় সাধারণত পশ্চিমাঞ্চলীয় সুন্দরবনের গঙ্গা জোয়ারভাটা সমভূমি কিংবা মধ্যাঞ্চলীয় মেঘনা মোহনা বন্যাভূমিকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছিল। অপরদিকে, পূর্ব উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম, এমনকি কোথাও কোথাও স্থিতিশীল বা কমে যাচ্ছে দেখানো হয়েছিল।

আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন (প্যানেল আইপিসিসি) অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বৈশ্বিক হার বছরে ৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার। শুধু তাই নয়, মানবসৃষ্ট কার্যকলাপের কারণে কয়েক দশকে উচ্চতা বৃদ্ধির গতি আরও বেড়েছে।

তবে আগের গবেষণাগুলোর বেশিরভাগই পরিচালিত হয়েছিল একক বা একাধিক টাইড গেজ (জোয়ার পরিমাপক) রেকর্ড ব্যবহার করে। সেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিবর্তন ও ভূমির উল্লম্ব গতিবিধি (VLM)—দুই প্রভাব মিলিয়ে আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি (RSLR) হিসাব করা হয়। এছাড়াও ব্যবহার করা হয়েছিল স্যাটেলাইট অলটিমেট্রি (SA) কিংবা জোয়ারভাটা ও অভ্যন্তরীণ নদীর তথ্য। এ কারণে বিভিন্ন গবেষণায় অসঙ্গতি ও অতিমূল্যায়ন থেকে গেছে বলে নতুন গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে গবেষণার প্রধান আশরাফ দেওয়ান বলেন, ‘এক গ্লাস পানির কথা ভাবুন। সেখানে যদি একটি পাথর ফেলেন, পানির স্তর উপরে উঠবে। একের পর এক ফেলতে থাকলে একসময় তা উপচে পড়বে। বাংলাদেশের উপকূলেও তাই ঘটছে—অপরিকল্পিত নির্মাণ ও নগরায়ণের কারণে দ্রুত সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

পরম সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির হার (ASLR) নির্ণয় করতে হলে টাইড গেজ (TG) রেকর্ডকে ভূমির উল্লম্ব গতিবিধি (VLM) দ্বারা সংশোধন করতে হয়। আর ভূমির উল্লম্ব গতিবিধি নির্ণয় করা হয় স্যাটেলাইট অলটিমেট্রি, গ্লোবাল ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম (GNSS) এবং ইন্টারফেরোমেট্রিক সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডারের (InSAR) মাধ্যমে।

গবেষক দল বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির একটি সমন্বিত চিত্র পাওয়ার জন্য টিজি রেকর্ড, এসএ এবং ইনসার থেকে পাওয়া ভিএলএম ভিততথ্য একত্রে বিশ্লেষণ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি হওয়ায় বাংলাদেশ উপকূলে এ ধরনের বিশ্লেষণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণায় দেখা গেছে, ভিএলএম-সমন্বিত এএসএলআর হার গড়ে বছরে ৪ দশমিক ৫৮ মিলিমিটার, যা এসএ থেকে প্রাপ্ত এএসএলআর হারের (৪ দশমিক ৯৪ মিলিমিটার/বছর) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে যায়। ফলে এই গবেষণায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘স্থান ও সময়ের জটিলতাগুলোকে ধারণ করার মাধ্যমে এই গবেষণা বাংলাদেশের উপকূলীয় ঝুঁকির একটি আরও সূক্ষ্ম ও গভীর চিত্র উপস্থাপন করেছে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত