জন্মদিনে ফিরে দেখা
আজ ২৮ জুন। অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের জন্মদিন। নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল ছোটবেলায়ই। তাঁর জন্মদিনে জানা যাক তাঁর ছোটবেলার গল্প।
স্ট্রিম ডেস্ক
আজ ২৮ জুন। মুহাম্মদ ইউনূসের জন্মদিন। ক্ষুদ্রঋণের ধারণা ও সামাজিক ব্যবসা দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। বর্তমানে এই মানুষটি বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
কিন্তু এই চেনা ইউনূসের জীবনের কতটুকু জানি আমরা? মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনের যে বহুবর্ণিলতা, সেখানে যেমন রয়েছে ক্ষুদ্রঋণ, তেমনি আছে ছোটবেলার বক্সিরহাট রোড, মায়ের ধমক, বাবার নিঃশব্দ শিক্ষা, মায়াপুরী স্টুডিও, ‘শুকতারা’ পত্রিকা কিংবা আলুর চপের গল্প। একজন মানুষের ‘বড় মানুষ’ হয়ে ওঠার গল্প কখনো কখনো শুরু হয় সাধারণ একটা গলির ভেতর থেকেই।
এই লেখায় ফিরে তাকানো হয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের সেই ছোটবেলার দিকে। মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত মুহাম্মদ ইউনূসের আত্মজীবনী ‘গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন’ বইয়ের আলোকে দেখা যাক, কেমন ছিল তাঁর কিশোরবেলা?
মুহাম্মদ ইউনূস বড় হয়েছেন চট্টগ্রাম শহরের পুরোনো বাণিজ্যিক এলাকা বক্সিরহাট রোডে। এই রাস্তা দিয়ে চাক্তাই নদীর ঘাট থেকে শহরের বাজারে মালপত্র আনা-নেওয়া হতো। এলাকাজুড়ে ছিল মানুষের ভিড় আর কোলাহল। এখানে যাঁরা বসবাস করতেন তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন গহনার দোকানের কারিগর। ‘সোনাপট্টি’ নামে পরিচিত সেই এলাকায় ছোট একটা দোতলা বাড়ির ওপরতলায় থাকতেন মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁদের পরিবার। বাড়ির নম্বর ছিল ২০। নিচতলায় সামনের দিকে ছিল তাঁর বাবার গহনার দোকান।
শৈশবের বক্সিরহাট রোড ছিল ইউনূসের কাছে এক বিস্ময়ের জগৎ। রাস্তার পেট্রোলের গন্ধ, ফেরিওয়ালা, জাদুকর থেকে ভিক্ষুক আর পাগলদের চিৎকার—এসবই ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। সারাদিন রাস্তায় ট্রাক-ড্রাইভারদের চিৎকার, ঝগড়া, হর্নে ভারী হয়ে থাকত পরিবেশ। সব সময় মনে হতো আশেপাশে যেন উৎসব চলছে।
তাঁদের বাড়ির তিন তলার রেলিংঘেরা ছাদ ছিল ইউনূসের প্রিয় খেলার জায়গা। একঘেয়ে লাগলে বাবার দোকানে গিয়ে স্বর্ণকারদের কাজ দেখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতেন জাপানি বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে কাগজের ইস্তেহার। খুব মজা পেতেন। গলায় মেশিনগানের আওয়াজ তুলে ঘুড়ি ওড়াতেন।
একদিন বিমান হামলায় ইউনূসদের বাড়ির এক পাশের দেয়াল ভেঙে পড়ল। তখন তাঁর বাবা তড়িঘড়ি করে পুরো পরিবারকে পাঠিয়ে দেন শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে, বাথুয়া গ্রামে। এখানেই তাঁদের আদিবাড়ি। আর এই বাথুয়া গ্রামেই ১৯৪০ সালে জন্ম মুহাম্মদ ইউনূসের।
মুহাম্মদ ইউনূসের বাড়ির পাশে ছিল লামারবাজার অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। স্কুলটা ছিল খুবই সাধারণ। আশপাশের খেটে খাওয়া পরিবারের ছেলেমেয়েরা ছিল তাঁর সহপাঠী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভাষায় ছিল চট্টগ্রামের স্থানীয় টান।
স্কুলের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। তবুও প্রধান শিক্ষকের একান্ত চেষ্টা ছিল যেন গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ পায়। স্কুলে বলা হতো, মেধাবীরা বৃত্তি পাবে, যাতে তারা লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই স্বপ্ন অনেকের জন্যই ছিল অধরা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইউনূস দেখলেন, একে একে তাঁর সহপাঠীরা স্কুল ছাড়ছে। হয়তো কেউ কাজের খোঁজে, কেউবা সংসারের ভার লাঘব করতে।
এই স্কুলটাই মুহাম্মদ ইউনূসের ভিত গড়ে দেয়। এখানে তিনি শিখেছিলেন পড়াশোনা মানে শুধু পরীক্ষায় পাস করা নয়। শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শৃঙ্খলা আর মানবিকতা। তিনি দেখেছিলেন, শিক্ষকরা শুধু বই পড়াচ্ছেন না, তাঁরা গল্প আর কবিতাও শোনাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতা তখন তাঁর কিশোর মনে আলো জ্বালিয়েছিল।
মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর ভাইবোনেরা একে অন্যকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, ‘আজকের আবহাওয়ার পূর্বাভাস কী?’ এর মানে তাঁদের মায়ের মেজাজ কেমন থাকবে সামনের কয়েক ঘণ্টা, সেটার আভাস পাওয়া। যখন তাঁদের মা দীর্ঘ সময় চুপ থাকতেন, তাঁরা বুঝতেন এবার ঝড় উঠবে।
মায়ের ভয়ে তিনি ভাইবোনকে সাংকেতিক নামে ডাকা শুরু করেন। কেউ দুই নম্বর, কেউবা চার। বড় হওয়ার পরেও ইউনূসের পরিবারের সবাই মজা করে এই সাংকেতিক নামগুলোই ব্যবহার করতেন।
ক্লাসের বইপত্রের পাশাপাশি মুহাম্মদ ইউনূস প্রচুর ‘আউট বই’ পড়তেন। রহস্য রোমাঞ্চ ও গোয়েন্দা কাহিনির ভক্ত ছিলেন তিনি। বারো বছর বয়সেই নিজের মতো করে একটা গোটা রহস্য কাহিনি লিখে ফেলেছিলেন।
কিন্তু এত পড়ার খোরাক সব সময় জোগাড় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন শুরু করেছিলেন পুরোনো বই কেনা, ধার নেওয়া, এমনকি কখনো চুপিচুপি বই চুরি করাও। তাঁর প্রিয় পত্রিকা ছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘শুকতারা’। এই শিশু-কিশোর সাহিত্য পত্রিকায় একটি প্রতিযোগিতা হতো, যেখানে বিজয়ীদের ডাকযোগে পাঠানো হতো পত্রিকা। বিজয়ীদের নামও পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো।
তখন মুহাম্মদ ইউনূস বিজয়ীদের মধ্যে কারও নাম বেছে নিয়ে পত্রিকার অফিসে চিঠি লিখতেন, বলতেন আমার বাড়ির ঠিকানা বদলেছে। তাই নতুন ঠিকানায় পত্রিকা পাঠাতে হবে। এরপর তিনি বাড়ির পাশের দোকানের ঠিকানা দিতেন, যাতে পত্রিকা আসার পর সেটা বাবার হাতে না পড়ে। আর প্রতিদিন খবর পড়ার জন্য তিনি যেতেন পাড়ার চিকিৎসক ডা. রসিকলাল বণিকের চেম্বারে। সেখানে বসে বসে পড়তেন পত্রিকার সাম্প্রতিক খবর।
শৈশব-কৈশোরে ছবি তুলতে পছন্দ করতেন মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথমে একটা ‘বক্স ক্যামেরা’ কিনেছিলেন। ওটাই সব সময় ছিল তাঁর সঙ্গী। যেখানেই যেতেন, সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন ক্যামেরাটা। ছাদে দাঁড়িয়ে বিশেষজ্ঞ ফটোগ্রাফারের মতো ছবি তোলার বিষয় আর দৃশ্য নির্বাচন করতেন। কখনো মানুষের মুখ, কখনো রাস্তা, বাড়িঘর, উৎসব বা প্রকৃতি। সবই ধরা পড়ত তাঁর ক্যামেরার ফ্রেমে। ছবি তোলার এই শখে তাঁর সঙ্গী ছিলেন পাড়ার ‘মায়াপুরী স্টুডিও’-এর মালিক। তিনি ইউনূস ও তাঁর ভাইদের স্টুডিওর ডার্করুমে ঢোকার অনুমতি দিয়েছিলেন।
এরপর ইউনূস কিনে ফেলেন একটা ‘ফোল্ডিং ক্যামেরা’। সেই ক্যামেরার ভিউ-ফাইন্ডারে চোখ রেখে তিনি চেনা জগৎকেও নতুনভাবে দেখতে শুরু করেন। ছবির ভেতর দিয়েই শুরু হয় তাঁর অন্য এক দেখার যাত্রা।
শুধু বইয়ের পাতায় নয়, মুহাম্মদ ইউনূসের কিশোরবেলা ছড়িয়ে ছিল নানা শখ আর কৌতূহলে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল সিনেমা দেখা। দুই চাচার হাত ধরে তিনি প্রায়ই চলে যেতেন সিনেমা হলে। কখনো হিন্দি ছবি, কখনোবা হলিউডি। পর্দায় গল্প দেখার সেই উত্তেজনা আর মুগ্ধতা তাঁর কল্পনার জগৎকে আরও বিস্তৃত করে তুলেছিল।
গান গাওয়ার শখও ছিল তাঁর। প্রায়ই পল্লিগীতি গাইতেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল, ‘আয় মেরি, দিল কাঁহি আওর চল’। এই সবকিছু মিলিয়ে পড়ার বাইরেও গড়ে উঠেছিল ইউনূসের ভিন্ন এক শিল্পজগৎ।
ছবি আঁকার প্রতি ইউনূসের ভালোবাসা জন্মেছিল ছোটবেলাতেই। কিছুদিন এক পেশাদার শিল্পীর কাছে ছবি আঁকাও শিখেছিলেন। তাঁকে ‘ওস্তাদ’ বলে ডাকতেন। কিন্তু তাঁর এই শখ মেটাতে হতো লুকিয়ে। কারণ ইউনূসের বাবা চাইতেন ছেলেরা শুধুই পড়াশোনায় মন দিক। তাই ইজেল, ক্যানভাস, রং—সবই সাজানো থাকত এমনভাবে যেন দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো গোপন করা যায়। এই শখ থেকেই তাঁর আগ্রহ জন্মায় গ্রাফিক ও ডিজাইনের দিকে। পাশাপাশি ডাকটিকিট সংগ্রহের মতো শখও যোগ হয় তালিকায়। ছোট ছোট এই আগ্রহগুলোই ধীরে ধীরে এই মানুষটির চিন্তার জগৎকে বিস্তৃত করে তোলে।
ইউনূসের হাতখরচ ছিল খুবই সামান্য। এক্ষেত্রে শিল্পপ্রেমী চাচা-চাচিরা কেউ রং কিনে দিতেন, কেউ দিতেন উৎসাহ। কেউ আবার বাবাকে কিছু না বলেই তাঁর পাশে থাকতেন।
মা যখন রান্নাঘরে পিঠা কিংবা মচমচে নাশতা বানাতেন, ইউনূস তখন দাঁড়িয়ে থাকতেন পাশেই। প্রথম পিঠাটা কড়াই থেকে নামলে তখনই সেটা ছিনিয়ে নিতেন।
‘বাইরের খাবার’ খেতে খুব পছন্দ করতেন ইউনূস। তবে দামি কিছু নয়। সাধারণ খাবারেই ছিল তাঁর বিশেষ টান। সবচেয়ে পছন্দের ছিল আলুর চপ আর আলুর দম। কিন্তু ঝামেলা হলো, এসবের স্বাদ পাওয়ার জন্য দরকার পড়ত টাকার। তাই মাঝেমধ্যে বাবার পকেট থেকে চুপিচুপি কিছু টাকা সরিয়েও রাখতেন।
মুহাম্মদ ইউনূস ছোটবেলা থেকেই ‘বড় পরিবারে’ বড় হয়ে অনেক দায়িত্ব নিতে শিখেছিলেন। চারপাশের মানুষের ওপর নির্ভর করা আর একে অপরকে সাহায্য করার মর্ম তিনি ছোটবেলায়ই বুঝেছিলেন।
মা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় শিক্ষক। গরিব আত্মীয়দের সাহায্য করতে তাঁর মা আলাদা করে টাকা জমিয়ে রাখতেন। বাবার দোকানে হাতের কাজ করে তাঁর মা যে টাকা আয় করতেন, তা তিনি ভাগ করে দিতেন দরিদ্র আর অসহায়দের মধ্যে। এই দয়া আর মমতা ইউনূসের জীবন গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
তাঁর বাবা ছিলেন প্রচণ্ড বাস্তববাদী। বাবার কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন কীভাবে সবকিছু মানিয়ে নিতে হয়। বাবার থেকে আরও শিখেছিলেন ‘দায়িত্ববোধ’। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও একজন মানুষ কীভাবে স্থির থেকে পরিবারকে আগলে রাখতে পারেন, সেটার এক অনন্য উদাহরণ ছিলেন তাঁর বাবা।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ইউনূসের জীবনে আসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। এই স্কুলের পরিবেশ ছিল মুক্ত ও উদার। সেখানে ধর্ম, জাত আর পরিচয়ের সংকীর্ণতা ছিল না। সবাই-ই একসঙ্গে মিশত। খেলাধুলা করত।
স্কুলে স্কাউটের কার্যক্রম ছিল তাঁর সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। ব্যায়াম, শিল্পকর্ম, ক্যাম্প ফায়ার—সব কিছুতেই ছিল তাঁর আগ্রহ। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাঁরা স্কাউট ক্যাম্প করতেন, বিচিত্রানুষ্ঠান আয়োজন করতেন। ‘উপার্জন সপ্তাহে’ রাস্তায় ফেরি করে, জুতা পলিশ করে কিংবা চায়ের দোকানে কাজ করে টাকা তুলতেন। এতে আনন্দ ছিল, ছিল জীবনের বাস্তবতা শেখার সুযোগ। আর এই স্কাউট আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ইউনূস বুঝতে পেরেছিলেন কীভাবে দায়িত্ব নিতে হয়। তার চেয়েও বেশি শিখেছিলেন নেতৃত্ব দেওয়ার কৌশল।
জীবনের ছোট ছোট অভিজ্ঞতাই ইউনূসের ভেতরে গড়ে দিয়েছে ভবিষ্যতের দিশা। যার বীজ লুকিয়ে ছিল সেই ছোটবেলায়। ফেলে আসা জীবনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা মুহাম্মদ ইউনূসকে করে তুলেছে অভিজ্ঞ, দায়িত্বশীল এবং নেতৃত্বদানের গুণসম্পন্ন একজন ‘আন্তর্জাতিক মানুষ’ হিসেবে।
আজ ২৮ জুন। মুহাম্মদ ইউনূসের জন্মদিন। ক্ষুদ্রঋণের ধারণা ও সামাজিক ব্যবসা দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। বর্তমানে এই মানুষটি বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
কিন্তু এই চেনা ইউনূসের জীবনের কতটুকু জানি আমরা? মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনের যে বহুবর্ণিলতা, সেখানে যেমন রয়েছে ক্ষুদ্রঋণ, তেমনি আছে ছোটবেলার বক্সিরহাট রোড, মায়ের ধমক, বাবার নিঃশব্দ শিক্ষা, মায়াপুরী স্টুডিও, ‘শুকতারা’ পত্রিকা কিংবা আলুর চপের গল্প। একজন মানুষের ‘বড় মানুষ’ হয়ে ওঠার গল্প কখনো কখনো শুরু হয় সাধারণ একটা গলির ভেতর থেকেই।
এই লেখায় ফিরে তাকানো হয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের সেই ছোটবেলার দিকে। মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত মুহাম্মদ ইউনূসের আত্মজীবনী ‘গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন’ বইয়ের আলোকে দেখা যাক, কেমন ছিল তাঁর কিশোরবেলা?
মুহাম্মদ ইউনূস বড় হয়েছেন চট্টগ্রাম শহরের পুরোনো বাণিজ্যিক এলাকা বক্সিরহাট রোডে। এই রাস্তা দিয়ে চাক্তাই নদীর ঘাট থেকে শহরের বাজারে মালপত্র আনা-নেওয়া হতো। এলাকাজুড়ে ছিল মানুষের ভিড় আর কোলাহল। এখানে যাঁরা বসবাস করতেন তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন গহনার দোকানের কারিগর। ‘সোনাপট্টি’ নামে পরিচিত সেই এলাকায় ছোট একটা দোতলা বাড়ির ওপরতলায় থাকতেন মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁদের পরিবার। বাড়ির নম্বর ছিল ২০। নিচতলায় সামনের দিকে ছিল তাঁর বাবার গহনার দোকান।
শৈশবের বক্সিরহাট রোড ছিল ইউনূসের কাছে এক বিস্ময়ের জগৎ। রাস্তার পেট্রোলের গন্ধ, ফেরিওয়ালা, জাদুকর থেকে ভিক্ষুক আর পাগলদের চিৎকার—এসবই ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। সারাদিন রাস্তায় ট্রাক-ড্রাইভারদের চিৎকার, ঝগড়া, হর্নে ভারী হয়ে থাকত পরিবেশ। সব সময় মনে হতো আশেপাশে যেন উৎসব চলছে।
তাঁদের বাড়ির তিন তলার রেলিংঘেরা ছাদ ছিল ইউনূসের প্রিয় খেলার জায়গা। একঘেয়ে লাগলে বাবার দোকানে গিয়ে স্বর্ণকারদের কাজ দেখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতেন জাপানি বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে কাগজের ইস্তেহার। খুব মজা পেতেন। গলায় মেশিনগানের আওয়াজ তুলে ঘুড়ি ওড়াতেন।
একদিন বিমান হামলায় ইউনূসদের বাড়ির এক পাশের দেয়াল ভেঙে পড়ল। তখন তাঁর বাবা তড়িঘড়ি করে পুরো পরিবারকে পাঠিয়ে দেন শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে, বাথুয়া গ্রামে। এখানেই তাঁদের আদিবাড়ি। আর এই বাথুয়া গ্রামেই ১৯৪০ সালে জন্ম মুহাম্মদ ইউনূসের।
মুহাম্মদ ইউনূসের বাড়ির পাশে ছিল লামারবাজার অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। স্কুলটা ছিল খুবই সাধারণ। আশপাশের খেটে খাওয়া পরিবারের ছেলেমেয়েরা ছিল তাঁর সহপাঠী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভাষায় ছিল চট্টগ্রামের স্থানীয় টান।
স্কুলের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। তবুও প্রধান শিক্ষকের একান্ত চেষ্টা ছিল যেন গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ পায়। স্কুলে বলা হতো, মেধাবীরা বৃত্তি পাবে, যাতে তারা লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই স্বপ্ন অনেকের জন্যই ছিল অধরা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইউনূস দেখলেন, একে একে তাঁর সহপাঠীরা স্কুল ছাড়ছে। হয়তো কেউ কাজের খোঁজে, কেউবা সংসারের ভার লাঘব করতে।
এই স্কুলটাই মুহাম্মদ ইউনূসের ভিত গড়ে দেয়। এখানে তিনি শিখেছিলেন পড়াশোনা মানে শুধু পরীক্ষায় পাস করা নয়। শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শৃঙ্খলা আর মানবিকতা। তিনি দেখেছিলেন, শিক্ষকরা শুধু বই পড়াচ্ছেন না, তাঁরা গল্প আর কবিতাও শোনাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতা তখন তাঁর কিশোর মনে আলো জ্বালিয়েছিল।
মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর ভাইবোনেরা একে অন্যকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, ‘আজকের আবহাওয়ার পূর্বাভাস কী?’ এর মানে তাঁদের মায়ের মেজাজ কেমন থাকবে সামনের কয়েক ঘণ্টা, সেটার আভাস পাওয়া। যখন তাঁদের মা দীর্ঘ সময় চুপ থাকতেন, তাঁরা বুঝতেন এবার ঝড় উঠবে।
মায়ের ভয়ে তিনি ভাইবোনকে সাংকেতিক নামে ডাকা শুরু করেন। কেউ দুই নম্বর, কেউবা চার। বড় হওয়ার পরেও ইউনূসের পরিবারের সবাই মজা করে এই সাংকেতিক নামগুলোই ব্যবহার করতেন।
ক্লাসের বইপত্রের পাশাপাশি মুহাম্মদ ইউনূস প্রচুর ‘আউট বই’ পড়তেন। রহস্য রোমাঞ্চ ও গোয়েন্দা কাহিনির ভক্ত ছিলেন তিনি। বারো বছর বয়সেই নিজের মতো করে একটা গোটা রহস্য কাহিনি লিখে ফেলেছিলেন।
কিন্তু এত পড়ার খোরাক সব সময় জোগাড় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন শুরু করেছিলেন পুরোনো বই কেনা, ধার নেওয়া, এমনকি কখনো চুপিচুপি বই চুরি করাও। তাঁর প্রিয় পত্রিকা ছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘শুকতারা’। এই শিশু-কিশোর সাহিত্য পত্রিকায় একটি প্রতিযোগিতা হতো, যেখানে বিজয়ীদের ডাকযোগে পাঠানো হতো পত্রিকা। বিজয়ীদের নামও পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো।
তখন মুহাম্মদ ইউনূস বিজয়ীদের মধ্যে কারও নাম বেছে নিয়ে পত্রিকার অফিসে চিঠি লিখতেন, বলতেন আমার বাড়ির ঠিকানা বদলেছে। তাই নতুন ঠিকানায় পত্রিকা পাঠাতে হবে। এরপর তিনি বাড়ির পাশের দোকানের ঠিকানা দিতেন, যাতে পত্রিকা আসার পর সেটা বাবার হাতে না পড়ে। আর প্রতিদিন খবর পড়ার জন্য তিনি যেতেন পাড়ার চিকিৎসক ডা. রসিকলাল বণিকের চেম্বারে। সেখানে বসে বসে পড়তেন পত্রিকার সাম্প্রতিক খবর।
শৈশব-কৈশোরে ছবি তুলতে পছন্দ করতেন মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথমে একটা ‘বক্স ক্যামেরা’ কিনেছিলেন। ওটাই সব সময় ছিল তাঁর সঙ্গী। যেখানেই যেতেন, সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন ক্যামেরাটা। ছাদে দাঁড়িয়ে বিশেষজ্ঞ ফটোগ্রাফারের মতো ছবি তোলার বিষয় আর দৃশ্য নির্বাচন করতেন। কখনো মানুষের মুখ, কখনো রাস্তা, বাড়িঘর, উৎসব বা প্রকৃতি। সবই ধরা পড়ত তাঁর ক্যামেরার ফ্রেমে। ছবি তোলার এই শখে তাঁর সঙ্গী ছিলেন পাড়ার ‘মায়াপুরী স্টুডিও’-এর মালিক। তিনি ইউনূস ও তাঁর ভাইদের স্টুডিওর ডার্করুমে ঢোকার অনুমতি দিয়েছিলেন।
এরপর ইউনূস কিনে ফেলেন একটা ‘ফোল্ডিং ক্যামেরা’। সেই ক্যামেরার ভিউ-ফাইন্ডারে চোখ রেখে তিনি চেনা জগৎকেও নতুনভাবে দেখতে শুরু করেন। ছবির ভেতর দিয়েই শুরু হয় তাঁর অন্য এক দেখার যাত্রা।
শুধু বইয়ের পাতায় নয়, মুহাম্মদ ইউনূসের কিশোরবেলা ছড়িয়ে ছিল নানা শখ আর কৌতূহলে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল সিনেমা দেখা। দুই চাচার হাত ধরে তিনি প্রায়ই চলে যেতেন সিনেমা হলে। কখনো হিন্দি ছবি, কখনোবা হলিউডি। পর্দায় গল্প দেখার সেই উত্তেজনা আর মুগ্ধতা তাঁর কল্পনার জগৎকে আরও বিস্তৃত করে তুলেছিল।
গান গাওয়ার শখও ছিল তাঁর। প্রায়ই পল্লিগীতি গাইতেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল, ‘আয় মেরি, দিল কাঁহি আওর চল’। এই সবকিছু মিলিয়ে পড়ার বাইরেও গড়ে উঠেছিল ইউনূসের ভিন্ন এক শিল্পজগৎ।
ছবি আঁকার প্রতি ইউনূসের ভালোবাসা জন্মেছিল ছোটবেলাতেই। কিছুদিন এক পেশাদার শিল্পীর কাছে ছবি আঁকাও শিখেছিলেন। তাঁকে ‘ওস্তাদ’ বলে ডাকতেন। কিন্তু তাঁর এই শখ মেটাতে হতো লুকিয়ে। কারণ ইউনূসের বাবা চাইতেন ছেলেরা শুধুই পড়াশোনায় মন দিক। তাই ইজেল, ক্যানভাস, রং—সবই সাজানো থাকত এমনভাবে যেন দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো গোপন করা যায়। এই শখ থেকেই তাঁর আগ্রহ জন্মায় গ্রাফিক ও ডিজাইনের দিকে। পাশাপাশি ডাকটিকিট সংগ্রহের মতো শখও যোগ হয় তালিকায়। ছোট ছোট এই আগ্রহগুলোই ধীরে ধীরে এই মানুষটির চিন্তার জগৎকে বিস্তৃত করে তোলে।
ইউনূসের হাতখরচ ছিল খুবই সামান্য। এক্ষেত্রে শিল্পপ্রেমী চাচা-চাচিরা কেউ রং কিনে দিতেন, কেউ দিতেন উৎসাহ। কেউ আবার বাবাকে কিছু না বলেই তাঁর পাশে থাকতেন।
মা যখন রান্নাঘরে পিঠা কিংবা মচমচে নাশতা বানাতেন, ইউনূস তখন দাঁড়িয়ে থাকতেন পাশেই। প্রথম পিঠাটা কড়াই থেকে নামলে তখনই সেটা ছিনিয়ে নিতেন।
‘বাইরের খাবার’ খেতে খুব পছন্দ করতেন ইউনূস। তবে দামি কিছু নয়। সাধারণ খাবারেই ছিল তাঁর বিশেষ টান। সবচেয়ে পছন্দের ছিল আলুর চপ আর আলুর দম। কিন্তু ঝামেলা হলো, এসবের স্বাদ পাওয়ার জন্য দরকার পড়ত টাকার। তাই মাঝেমধ্যে বাবার পকেট থেকে চুপিচুপি কিছু টাকা সরিয়েও রাখতেন।
মুহাম্মদ ইউনূস ছোটবেলা থেকেই ‘বড় পরিবারে’ বড় হয়ে অনেক দায়িত্ব নিতে শিখেছিলেন। চারপাশের মানুষের ওপর নির্ভর করা আর একে অপরকে সাহায্য করার মর্ম তিনি ছোটবেলায়ই বুঝেছিলেন।
মা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় শিক্ষক। গরিব আত্মীয়দের সাহায্য করতে তাঁর মা আলাদা করে টাকা জমিয়ে রাখতেন। বাবার দোকানে হাতের কাজ করে তাঁর মা যে টাকা আয় করতেন, তা তিনি ভাগ করে দিতেন দরিদ্র আর অসহায়দের মধ্যে। এই দয়া আর মমতা ইউনূসের জীবন গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
তাঁর বাবা ছিলেন প্রচণ্ড বাস্তববাদী। বাবার কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন কীভাবে সবকিছু মানিয়ে নিতে হয়। বাবার থেকে আরও শিখেছিলেন ‘দায়িত্ববোধ’। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও একজন মানুষ কীভাবে স্থির থেকে পরিবারকে আগলে রাখতে পারেন, সেটার এক অনন্য উদাহরণ ছিলেন তাঁর বাবা।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ইউনূসের জীবনে আসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। এই স্কুলের পরিবেশ ছিল মুক্ত ও উদার। সেখানে ধর্ম, জাত আর পরিচয়ের সংকীর্ণতা ছিল না। সবাই-ই একসঙ্গে মিশত। খেলাধুলা করত।
স্কুলে স্কাউটের কার্যক্রম ছিল তাঁর সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। ব্যায়াম, শিল্পকর্ম, ক্যাম্প ফায়ার—সব কিছুতেই ছিল তাঁর আগ্রহ। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাঁরা স্কাউট ক্যাম্প করতেন, বিচিত্রানুষ্ঠান আয়োজন করতেন। ‘উপার্জন সপ্তাহে’ রাস্তায় ফেরি করে, জুতা পলিশ করে কিংবা চায়ের দোকানে কাজ করে টাকা তুলতেন। এতে আনন্দ ছিল, ছিল জীবনের বাস্তবতা শেখার সুযোগ। আর এই স্কাউট আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ইউনূস বুঝতে পেরেছিলেন কীভাবে দায়িত্ব নিতে হয়। তার চেয়েও বেশি শিখেছিলেন নেতৃত্ব দেওয়ার কৌশল।
জীবনের ছোট ছোট অভিজ্ঞতাই ইউনূসের ভেতরে গড়ে দিয়েছে ভবিষ্যতের দিশা। যার বীজ লুকিয়ে ছিল সেই ছোটবেলায়। ফেলে আসা জীবনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা মুহাম্মদ ইউনূসকে করে তুলেছে অভিজ্ঞ, দায়িত্বশীল এবং নেতৃত্বদানের গুণসম্পন্ন একজন ‘আন্তর্জাতিক মানুষ’ হিসেবে।
খাইরুল বাসারের গান ইউটিউবে শুনতে গিয়ে কমেন্টবক্সে চোখ পড়ল। এক ভক্ত লিখেছেন, ‘খাইরুল বাসারের গানে আলাদা একটা পিনিক আছে।’ এই ‘পিনিক’ আসলে 'ক্যাচি' আর লিরিকে-টিউনে রেপিটেটিভ ফর্মের কারণে হুকলাইন মুখস্ত হয়ে যাওয়া। আর সঙ্গে বাংলা ঢোলের মাথাদোলানো সাউন্ডস্কেপ।
৫ ঘণ্টা আগে‘ঘরে না থাকলে লাইট-ফ্যান বন্ধ রাখুন’—মোটামুটি সকলেই এ বাক্যটির সঙ্গে পরিচিত। বিদ্যুৎ খরচ কমাতে টিভি, রেডিও, পত্রিকা- কোথায় ছিল না এই বিজ্ঞাপন?
৬ ঘণ্টা আগেবাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও আধুনিকতার এক উজ্জ্বল ভাষ্যকার রশীদ করীম। উপন্যাসের আখ্যানে ধারণ করেছেন বাংলা অঞ্চলের মানুষের নৈমিত্তিক ছবি-ব্যক্তিক ও সামষ্টিক বাসনার রূপকল্প।
৯ ঘণ্টা আগেদুটি হাতের মধ্যে আমরা ডানহাতকেই বেশি এগিয়ে রাখি তাই না! ডান হাতই যেন সঠিক। বাম হাত দিয়ে কাউকে কোনো কিছু দিলেই তো মা দিতো বকা! তবে কেউ কেউ আমাদের আশপাশে ছিল যাঁরা বাম হাতে লিখতেন বা কাজ করতেন।
১ দিন আগে