leadT1ad

জন্মদিনে স্মরণ

গিটারের ছয়টি তারে বেঁচে থাকা আইয়ুব বাচ্চু

আজ ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর জন্মদিন। তিনি আমাদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, যিনি গিটারের ছয় তারে শ্রোতাদের আচ্ছন্ন করতেন। ‘এলআরবি’ ব্যান্ডের এই ফ্রন্টম্যান গড়ে তুলেছিলেন বাংলা রকের এক নতুন অধ্যায়। ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘ফেরারি মন’ থেকে শুরু করে অসংখ্য অমর সুরে তিনি হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি। জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

আল মাহফুজ
স্ট্রিম গ্রাফিক

তখন পুরোদমে গান করছেন আইয়ুব বাচ্চু, কনসার্ট মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন। 'এলআরবি'র কনসার্ট মানেই তখন টিকেটের সারিতে লম্বা লাইন। উন্মুক্ত মঞ্চে জনতার সেকি উন্মত্ততা! দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা গিটারিস্টের আয়েশি কারিকুরি, শ্রোতার কণ্ঠে গুঞ্জরিত ‘সেই তুমি..’। আইভানেজ গিটারে কী উচ্ছল প্রাণাবেগ! যেন আকাশ থেকে ঝরছে জরীন তারাবাতি। প্রতিটি গানের শেষে দর্শকের সঙ্গে বাচ্চুর ইন্টারেকশন। উপসংহারে গিটারের টংকারে ‘ট্রেডমার্ক’ জাতীয় সংগীত। একই গান, একই সুর তবু তা যেন অমীয় ফল্গুধারা!

কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত
কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

‘জাদুকর' বাচ্চু হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মতো আচ্ছন্ন করে রাখতেন দর্শক-শ্রোতাদের। অনেকের চোখ ভিজে যেত সুরের হুইসেলে। অনেকে সমস্বরে গেয়ে উঠত, পিয়াল বনে ডাহুক যেভাবে গায়। অনেকের মুখে রা নেই, একদম চুপ। দূর আকাশের তারা নয়, চর্মচক্ষে আইয়ুব বাচ্চুকে দেখার অভিজ্ঞতা! মিউজিক ছিল যার ধ্যান-জ্ঞান, তিনি গণমানুষের কাছে ছিলেন এতটাই প্রভাব বিস্তারী।

বাংলাদেশে পপ-রক জনরা জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আজম খানের। এরপর ‘পপ গুরু’র পাশাপাশি ব্যান্ড মিউজিকে পদার্পণ করে সোলস, ফিডব্যাক, রেনেসাঁ (মেলো-রক), মাইলস, এলআরবি, ফিলিংস, ওয়ারফেজ, ডিফরেন্ট টাচসহ অসংখ্য ব্যান্ড। এ কথা না বললেই নয়, বাংলা ভাষায় রক মিউজিকের অন্যতম অগ্রগামী পথিক ছিলেন বাচ্চু। পরে সেই পথ ধরে হেঁটে চলেছে আরও অনেকেই। এক জীবনে নন্দিত গানের যত পসরা সাজিয়েছেন, দুই হাতে তা ধরার নয়। গিটারের তারে এবি যে সুরের মূর্ছনা ছড়িয়েছেন, তাকে বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়।

গিটারধ্যানী আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত
গিটারধ্যানী আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৯ সালে ‘ফিলিংস’ (বর্তমানে নগরবাউল) ব্যান্ডে যোগদানের মাধ্যমে নিজের রক মিউজিক জার্নির গোড়াপত্তন করেন আইয়ুব বাচ্চু। এর আগে অবশ্য চট্টগ্রামে ‘গোল্ডেন বয়েজ’, ‘স্পাইডার’, রিদম ৭৭’ ব্যান্ডে গান-বাজনা করতেন। ফিলিংসে বছরখানেক বাজিয়ে ‘সোলস’-এ গিটারবাদক হিসেবে যোগ দিয়ে এক এক করে চারটি অ্যালবামে কাজ করেন। একসময় সোলস ছেড়ে দিয়ে তৈরি করেন নিজের ব্যান্ড। ১৯৯১ সালে গড়া ব্যান্ডের নাম ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’।

পরবর্তীকালে নাম পাল্টে রাখা হয় ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’, যার সংক্ষিপ্ত রুপ ‘এলআরবি’। নব্বইয়ের দশকে আইয়ুব বাচ্চু ও তাঁর ব্যান্ড ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। শ্রোতারা ভালোবেসে গ্রহণ করে এলআরবিকে। তন্ময় হতে থাকে বিবিধ সুরের মহুয়ায়। আইয়ুব বাচ্চুর গিটারের নেশায় মুহূর্তেই পাগলপারা হয়ে যায় শ্রোতারা। এই হাসন-লালনের দেশে রক মিউজিককে তিনি গণমানুষের হৃদয়ের কোটরে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

আইয়ুব বাচ্চুর গিটার। ছবি: সংগৃহীত
আইয়ুব বাচ্চুর গিটার। ছবি: সংগৃহীত

আইয়ুব বাচ্চুর জনপ্রিয় গানের সংখ্যা বলে শেষ করা যাবে না। ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘ফেরারি মন’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘সে তারা ভরা রাতে’, ‘হাসতে দেখো’, ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘বেলা শেষে’, ‘তাজমহল’, ‘প্রতিদান চায় না’–এমন হৃদয়ছোঁয়া অজস্র গান। তাঁর গিটারের তুমুল স্বাক্ষর তো পাওয়া যায় এলআরবির আর তাঁর নিজের সলো অ্যালবামগুলোতে।

এ ছাড়া, ব্যান্ডের বাইরেও তিনি প্রচুর কাজ করেছেন। এর মধ্যে অমর সৃষ্টির এক উদাহরণ দেয়া যাক–কণ্ঠশিল্পী আগুনের গাওয়া ‘আমার স্বপ্নগুলো কেন এমন স্বপ্ন হয়’-এর তুঙ্গে ওঠা গিটার প্লাকিং যদি শুনে থাকেন, আপনি ঘোরলাগা মৌমাছি হয়ে যেতে পারেন। আপনার চোখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে মূর্ছনায়, মুখরতায়। অন্য কোনো শব্দ তখন বিরক্ত ধরাতে পারে আপনার কানে। গিটারে বুঁদ হয়ে আপনি হয়তো তখন সত্যি সত্যি ব্লাইন্ড হয়ে যেতে চাইবেন। কারণ আপনি জানেন, ভালোবাসা অন্ধ।

বিদায়ের সময়েই নাকি টের পাওয়া যায় বুকের ভেতর বৃষ্টি ঝরার শোক। এমন নিযুত শোক ঝরেছিল লাখো ভক্তের মনে, আইয়ুব বাচ্চুর প্রয়াণে। আজ কিংবদন্তি এই রকস্টারের জন্মদিন। নিপুণ গিটার বাদকের বেলায় এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়–আইয়ুব বাচ্চু থাকবেন সংগীতের সাতটি সুরে, আইয়ুব বাচ্চু থাকবেন গিটারের ছয়টি তারে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত