leadT1ad

তিব্বতের ধর্ম নিয়ে কমিউনিস্ট চীনের এত মাথাব্যথা কেন

তিব্বতের ধর্ম চীনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরেই। কারণ, তা কেবল ধর্মমাত্র নয় বরং তিব্বতের জাতিসত্তা, সংস্কৃতি আর স্বাধীনতার প্রতীক। বৌদ্ধধর্ম নিয়ন্ত্রণ করলেই তিব্বতের মন-প্রাণ দখল করা যাবে—এই ধারণা থেকেই কমিউনিস্ট চীনের তীব্র আগ্রহ এ ধর্ম নিয়ে। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধর্মীয় নেতা দালাই লামার ৯০তম জন্মদিনে জেনে নেওয়া যাক এর আদ্যোপান্ত।

রাতুল আল আহমেদ
স্ট্রিম গ্রাফিক

চীনের কমিউনিস্ট সরকার সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বললেও বাস্তবে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। চীনা সরকার কেবল পাঁচটি ধর্মকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ধর্মগুলোকে আবার ‘চীনাকরণ’ নীতির মাধ্যমে কমিউনিস্ট আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে হয়।

চীনের উইঘুর মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বহুদিন ধরেই সরব। দেখা গেছে, সেখানে নজরদারির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সিসিটিভি ও তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আরও অভিযোগ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও স্বাধীন ধর্মচর্চাকারীরা প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।

কমিউনিস্ট চীন যেখানে ধর্মের ওপর খড়গহস্ত, সেখানে তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম নিয়ে সরকারের কেন এত আগ্রহ? ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজ বিলুপ্ত করার কৌশল প্রয়োগ না করে কেন বৌদ্ধধর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে চায় চীনা কমিউনিস্ট সরকার?

চীনা সরকারের কৌশল

চীনা সরকার বুঝতে পেরেছে, তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তিব্বতের জাতিসত্তা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতাবোধ আলাদা করা সম্ভব নয়। চীনের আশঙ্কা, দালাই লামা ও তিব্বতীয় বৌদ্ধরা যতদিন স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবে, ততদিন তিব্বত চীনা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

তিব্বতে ধর্মই জনগণের প্রধান অনুপ্রেরণা ও সংগঠনের মাধ্যম। তাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে জনগণের মনস্তত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ করাই চীনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। চীন এই কৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০০৭ সালে একটি আইন পাস করে। যেখানে বলা হয়, কোনো তিব্বতি বৌদ্ধ ‘টুলকু’ অর্থাৎ পুনর্জন্মপ্রাপ্ত ধর্মীয় নেতা হতে হলে চীনা সরকারের অনুমোদন আবশ্যক। অর্থাৎ, পরবর্তী দালাই লামা নির্বাচনেও চীন হস্তক্ষেপ করতে চায় এবং নিজেদের অনুগত ধর্মীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে চায়।

স্বীকৃতি পাওয়ার ঠিক তিন দিনের মাথায় ১৭ মে ১৯৯৫ তারিখে চীনা কর্তৃপক্ষ ছয় বছর বয়সী পানচেন লামা ও তাঁর পরিবারকে অপহরণ করে। সেই থেকে তিনি নিখোঁজ। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের বহু মানবাধিকার সংস্থা তাঁকে ‘বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্দি’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

দালাই লামা ও পানচেন লামার রাজনৈতিক তাৎপর্য

এখানে শুরুতেই বলে রাখা ভালো, দালাই লামা ও পানচেন লামা—এ দুটি কোনো ব্যক্তি নাম নয়; বরং দুটি ধর্মীয় পদ।

চীনা বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন দালাই লামা। তিব্বতি বৌদ্ধদের বিশ্বাস, বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের মানবরূপ তিনি। বর্তমান চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিং গ্যাৎসো চীনের তিব্বত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তবে ১৯৫৯ সালে চীনা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা প্রতিরোধ সফল না হলে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। তখন থেকেই নির্বাসিত অবস্থায় তিনি স্বাধীন তিব্বতের পক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে তৎকালীন দশম পানচেন লামা চোকি গ্যালৎসেন তিব্বতে থেকে যান। ১৯৮৯ সালে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে।

তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে দালাই লামার মতো আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন পানচেন লামা। দালাই লামার পর তিনিই এ ধর্মের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা। দালাই লামাকে যেমন তিব্বতিরা বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের মানবজন্ম হিসেবে দেখে। তেমনই অমিতাভ বুদ্ধের মানবজন্ম হিসেবে দেখা হয় পানচেন লামাকে।

এই দুই পদের মধ্যে রয়েছে অনন্য এক সম্পর্ক। পানচেন লামার পুনর্জন্মকে স্বীকৃতি দেন দালাই লামা। অপর দিকে, পানচেন লামা পরবর্তী দালাই লামার পুনর্জন্ম নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলে এই দুই পদ শতাব্দী ধরে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৯৫ সালে চতুর্দশ দালাই লামা ছয় বছর বয়সী গেদন চোকি ন্যিমাকে একাদশ পানচেন লামা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এর ঠিক তিন দিনের মাথায়, ১৭ মে ১৯৯৫ তারিখে চীনা কর্তৃপক্ষ গেদন ও তাঁর পরিবারকে অপহরণ করে। সেই থেকে তিনি নিখোঁজ। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের বহু মানবাধিকার সংস্থা তাঁকে 'বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্দী' হিসেবে অভিহিত করেছে। চীনের দাবি তিনি ও তাঁর পরিবার ‘নিরাপদে’ আছেন। তবে গত তিন দশকে তাঁর অবস্থান বা জীবনযাত্রা নিয়ে কোনো তথ্যই প্রকাশ পায়নি।

চীনা সরকার এরপর নিজেদের পছন্দমতো আরেকজন শিশু, গিয়াংচেন নোরবুকে পানচেন লামা হিসেবে ঘোষণা করে। এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি। তিব্বতি জনগণ তাঁকে কোনো দিনও প্রকৃত পানচেন লামা হিসেবে গ্রহণ করেনি। তাঁকে 'চীনের পুতুল পানচেন' হিসেবে বিদ্রূপ করা হয়। এই ঘটনায় বোঝা যায়, চীনের লক্ষ্য হলো ধর্মীয় নেতৃত্বকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা এবং তিব্বতীয় সমাজের সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ঐক্য বিনষ্ট করা।

বিশ্বের বৃহত্তম বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ‘লাগাং গার’ মঠ ২০১৬ সালে চীনা কর্তৃপক্ষ ব্যাপকভাবে ধ্বংস করে। মঠগুলো গুঁড়িয়ে হাজার হাজার সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীকে বিতাড়িত করা হয়।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ‘সফট পাওয়ার’ কৌশল

বর্তমানে চীন ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। মাও সে তুংয়ের আমলে যেভাবে ধর্মকে ‘বিষ’ হিসেবে দেখা হতো, সেখান থেকে আজকের চীন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিব্বতি গবেষক ও স্বাধীন তিব্বত আন্দোলনের সমর্থক ড. রিনজিন দোর্জের মতে চীন বৌদ্ধ ধর্মে বিপুল বিনিয়োগ করছে। বিশেষ করে ‘নানহাই বৌদ্ধ একাডেমি’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা নিজেদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গড়ে তোলার মাধ্যমে ঐতিহ্য ‘তৈরি’র চেষ্টা করছে।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চীন তিব্বতের জনগণকে নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। এ উদ্দেশ্যে চীন ধর্মীয় শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ধর্মীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। গিয়াংচেন নোরবুকে এগিয়ে নিয়ে আসাও এরই অংশ।

চীনের ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণের আরেকটি আলোচিত দৃষ্টান্ত হচ্ছে সিচুয়ান প্রদেশের ‘লারাং গার’ বৌদ্ধ একাডেমি। বিশ্বের বৃহত্তম বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে চীনা কর্তৃপক্ষ ব্যাপকভাবে ধ্বংস করে। মঠগুলো গুঁড়িয়ে হাজার হাজার সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীকে বিতাড়িত করা হয়েছে। চীনের দাবি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের খাতিরে এ সিদ্ধান্ত। তবে বাস্তবে এটি ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের প্রচেষ্টা।

তিব্বতের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ‘ফ্রি টিবেট মুভমেন্ট’—এ ধ্বংসযজ্ঞের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই ঘটনায় বোঝা যায়, চীনের লক্ষ্য ধর্মের সামাজিক ভিত্তি ধ্বংস করা। তিব্বতীয় জনগণের আত্মপরিচয় দুর্বল করে তাদের ‘প্রকৃত চৈনিক’ করে তুলতে চায় কমিউনিস্ট সরকার।

দালাই লামার নতুন কৌশল

এ পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিং গ্যাৎসো পুনর্জন্ম নিয়ে বলেছেন, তাঁর পুনর্জন্মের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ‘গাদেন ফোড্রাং ট্রাস্ট’। তিনি আরও বলছেন, তিনি এবার জন্ম নেবেন তিব্বতের বাইরে। ভারতে বা অন্য কোনো দেশে তাঁর পুনর্জন্ম হতে পারে। এতে করে চীন সরকারের ধর্মীয় নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণের কৌশল ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে।

দালাই লামা বারবার বলেছেন, যদি তিব্বতে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ফিরে না আসে, তাহলে তিনি সেখানে পুনর্জন্ম নেবেন না। এই অবস্থান তাঁকে তিব্বতের জনগণের মধ্যে আরও জনপ্রিয় করেছে।

দুই দালাই লামার সম্ভাবনা: ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

দালাই লামার এই কৌশল চীনের পরিকল্পনায় বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। তবুও চীন তাদের পরিকল্পনা থেকে পিছু হটবে না। ভবিষ্যতে হয়তো দুজন দালাই লামা দেখা যাবে—যার একজন চীন অনুমোদিত, আরেকজন তিব্বতি জনগণ এবং নির্বাসিত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত। সে লক্ষ্যে চীন সরকার আগেই পানচেন লামা নির্বাচন করে রেখেছে। চীনপন্থী এই লামা কমিউনিস্ট সরকারের মর্জিমাফিক কোনো শিশুকে দালাই লামা বলে স্বীকৃতি দেবেন বলেই মনে করে চীন সরকার। এ সমান্তরাল নেতৃত্ব তিব্বতি সমাজে বিভাজন তৈরি করতে পারে।

তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ দুই পদ দালাই লামা ও পানচেন লামার পারস্পরিক নির্ভরতা তিব্বতি ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার অটুট ভিত্তি। চীনের রাজনৈতিক কৌশল এ ঐতিহ্যকে নিয়ন্ত্রণে এনে তিব্বতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে দালাই লামা তাঁর পুনর্জন্মের ঘোষণা দিয়ে চীনের নিয়ন্ত্রণের পথ রুদ্ধ করতে চেয়েছেন। গেদন চোকি ন্যিমার অপহরণ, পানচেন লামার নির্বাচন বিতর্ক এবং দুই দালাই লামার সম্ভাবনা—সব মিলিয়ে তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম আজ এক কঠিন যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।

এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তিব্বতি জনগণের ঐক্য, তাঁদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চেতনা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনই নির্ধারণ করবে তিব্বতের ভবিষ্যৎ। তারা কি পারবে নিজেদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি বজায় রাখতে, নাকি চীনা রাষ্ট্রযন্ত্রের আধিপত্যের কাছে হার মানবে?

Ad 300x250

সম্পর্কিত