leadT1ad

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক কেন আলাস্কাতেই

আগামীকাল শুক্রবার (১৫ আগস্ট) বহুল আলোচিত বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বৈঠকের উদ্দেশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানো। কিন্তু বৈঠকের জন্য আলাস্কাকে কেন বেছে নিলেন ট্রাম্প? আলাস্কার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সম্পর্কই বা কী।

রুহুল আমিনঢাকা
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক কেন আলাস্কাতেই। স্ট্রিম গ্রাফিক

ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে বসবে পরাশক্তি দুই দেশ। কিন্তু স্থান হিসেবে ট্রাম্প কেন আলাস্কাকেই বেছে নিলেন? পুতিনই বা কেন তাতে রাজি হলেন। এর পেছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক কারণ। আমুদে ট্রাম্পের জন্য আলাস্কাকে বেছে নেওয়া রাশিয়াকে খোঁচা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের সামরিক সক্ষমতা দেখানো একটি সুযোগ। তবে পুতিনের কাছে, সর্বোপরি রুশদের কাছে আলাস্কা এক আক্ষেপের নাম, স্মৃতিবিজড়িত বেদনারও।

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের নেপথ্যে

ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আগামীকাল শুক্রবার (১৫ আগস্ট) বহুল আলোচিত এই বৈঠকে বসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে শেষ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে। বৈঠকটি যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা প্রদেশের অ্যাঙ্কোরেজের এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন যৌথ সামরিক ঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত হবে।

হোয়াইট হাউস কর্মকর্তারা বলছেন, দুই বিশ্ব নেতার মধ্যে বৈঠকের জন্য ঘাঁটিটির প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সন্তোষজনক।

এর আগে চলতি গ্রীষ্মে ট্রাম্পের চেষ্টায় ইউক্রেন-রাশিয়া তিন দফা বৈঠক করেছে। কিন্তু কোনো পক্ষই যুদ্ধবিরতি বা শান্তিচুক্তির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। তাই এবার ট্রাম্প নিজেই বসছেন পুতিনের সঙ্গে।

গত নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই যুদ্ধ শেষ করবেন। আরেকটি কথা তো তিনি বারবারই বলেন, ২০২২ সালে তিনি যদি প্রেসিডেন্ট থাকতেন, তবে রাশিয়াকে ইউক্রেন আক্রমণই করতে দিতেন না।

গত মাসে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে ট্রাম্প বলেন, পুতিনকে নিয়ে তিনি হতাশ। তাঁর এই হতাশা ক্রমশ বাড়ছিল। পরে তিনি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য পুতিনকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। অন্যথায় আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা বলেন। সেই সময়ও পার হয়ে গেছে। শেষে নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে ট্রাম্প ১৫ আগস্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের ঘোষণা দেন।

বৈঠকের আগে অবশ্য ট্রাম্প ফের হুমকি দিয়ে রেখেছেন—বৈঠকে পুতিন যদি ইউক্রেন ‍যুদ্ধ বন্ধে রাজি না হন, তবে তাঁকে ‘কঠোর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলাস্কার কূটনৈতিক গুরুত্ব

আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপশ্চিমের শেষ অঙ্গরাজ্য। এরপর বেরিং প্রণালী। তারপরই রাশিয়ার ভূখণ্ড শুরু। অর্থাৎ বেরি প্রণালী রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে আলাদা করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সহকারী ইউরি উশাকভ সে কথা উল্লেখও করেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া প্রতিবেশী দুটি দেশ। বেরিং প্রণালী দেশ দুটিকে পৃথক করেছে।

উশাকভ বলেন, ‘আমাদের প্রতিনিধিদলকে কেবল বেরিং প্রণালীর ওপর দিয়ে উড়ে যেতে হবে। দুই দেশের নেতাদের এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যাশিত বৈঠকের জন্য জায়গা হিসেবে আলাস্কা বেশ যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হচ্ছে।’

আলাস্কার ম্যাপ। ছবি: সংগৃহীত
আলাস্কার ম্যাপ। ছবি: সংগৃহীত

এর আগে ২০২১ সালে শেষবার আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের ‍কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। সেবার এখানেই জো বাইডেনের নবগঠিত কূটনীতিক এবং জাতীয় নিরাপত্তা দল চীনা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল। ওই বৈঠকের পর চীনারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল এবং মার্কিনিদের বিরুদ্ধে ‘অহংকার ও ভণ্ডামির’ অভিযোগ ‍তুলেছিল। কিন্তু আলাস্কাকে বৈঠকের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়ার পেছনে ঐতিহাসিক কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগত; আর রাশিয়ার জন্য ঐতিহাসিক ও আবেগের জায়গা আলাস্কা।

রাশিয়ার কাছে আলাস্কার ঐতিহাসিক গুরুত্ব

আলাস্কায় পুতিনের এই সফর হবে কোনো রুশ নেতার প্রথম সফর। আলাস্কা একসময় রাশিয়ারই অংশ ছিল। রুশ বার্তা সংস্থা তাসের এক খবরে বলা হয়েছে, ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত আলাস্কা জার সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।

১৮ শতক থেকে আলাস্কাকে উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে রাশিয়া। জার শাসক দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের শাসন পর্যন্ত এটি রাশিয়ার ছিল। পরে ১৮৬৭ সালে এটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে আলাস্কাকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র আলাস্কা কেনার পর যখন এখানে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া যায়, তখন রুশরা এই আলাস্কা বিক্রির চুক্তিকে বোকামি হিসেবে দেখতে শুরু করে। রুশদের মধ্যে এর জন্য অনুশোচনাও আছে।

পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে রুশদের কাছে আলাস্কা হয়ে উঠে স্মৃতিচারণ ও কৌতূকের বিষয়। গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে আলাস্কা নিয়ে একটি গান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ওই গানে রুশদের বোকামি আর আলাস্কার জন্য আর্তনাদ ফুটে ওঠে। গানটির কয়েকটি লাইন ছিল এমন, ‘ডোন্ট প্লে দ্য ফুল, আমেরিকা…গিভ ব্যাক আওয়ার ডিয়ার আলাস্কা ল্যান্ড’।

লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতির অধ্যাপক স্যাম গ্রিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে বৈঠকের স্থান হিসেবে আলাস্কার প্রতীকীকরণ ‘ভয়াবহ’। এটি করা হয়েছে যেন দেখানো যায়, সীমানা পরিবর্তন হতে পারে, ভূমি কেনা-বেচা করা যেতে পারে।’

ট্রাম্পের কাছে আলাস্কার গুরুত্ব

পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের জন্য আলাস্কাকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কিঞ্চিত খোঁচা দেওয়ার মনোভাবও কাজ করেছে। আলাস্কার যে জায়গায় পুতিনের সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় বসবেন, সেটি ‍সামরিক ঘাঁটি। স্নায়ু যুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই সামরিক ঘাঁটির বড় ভূমিকা ছিল। অবশ্য আজকের দিনেও এই ঘাঁটির ভূমিকা ব্যাপক ও বিস্তৃত।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ । সংগৃহীত ছবি
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ । সংগৃহীত ছবি

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, শুক্রবার আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজের এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন যৌথ সামরিক ঘাঁটিতে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। যদিও ঘাঁটিটির অধিকাংশ সামরিক সরঞ্জাম নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। তারপরও ঘাঁটিটিতে এফ-২২ র‌্যাপটর স্টিলথ ফাইটার জেটসহ যুদ্ধ বিমানের বহর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় নিয়মিত ওড়া রুশ উড়োজাহাজ ঠেকানোয় এখনো এই ঘাঁটির উড়োজাহাজ কাজে লাগানো হয়।

২০১০ সালে এলমেনডর্ফ এয়ার ফোর্স বেস এবং আর্মি ফোর্ট রিচার্ডসনকে একিভূত করে এই ঘাঁটি তৈরি করা হয়। দীর্ঘ ইতিহাসজুড়ে এই ঘাঁটিতে অনেক বিমান ছিল এবং সোভিয়েত সামরিক কার্যকলাপ, সম্ভাব্য পারমাণবিক উৎক্ষেপণ শনাক্তে রাডার নজরদারি কাজটি এই ঘাঁটি থেকেই তদারকি করা হয়েছিল। ঘাঁটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ওই সময় এই ঘাঁটির মটো হয়ে উঠেছিল ‘টপ কভার ফর নর্থ আমেরিকা।’

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক সিনিয়র ফেলো বেনজামিন জেনসেন বলেন, ‘দুই নেতার বৈঠকটি আমেরিকার সামরিক এই ঘাঁটিতে হওয়ার কারণে যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ এড়ানো যাবে। এছাড়া তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের নিরাপত্তা পাবে।’

জেনসেন আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য মার্কিন সামরিক শক্তি দেখানোর এটি একটি দারুণ উপায়। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ বা অন্যরা এতে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। ট্রাম্প আশা করছেন, এই বৈঠক ফলপ্রসূ হবে।’

সামরিক ঘাঁটিটি সম্পর্কে যা জানা গেল

স্নায়ুযুদ্ধের সময় এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন যৌথ এই সামরিক ঘাঁটিটি আলাস্কার বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি ছিল। আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজের ৬৪ হাজার একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রস্তুতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুষারাবৃত পাহাড়, বরফাবৃত হ্রদ এবং মনোরম হিমবাহ এই ঘাঁটির চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। শীতকালে এখানে মাইনাস ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রার কারণে কাঁপুনি ধরে। যদিও এখন সেখানে গ্রীষ্মকাল চলছে। আশা করা হচ্ছে দুই নেতার বৈঠকের সময় তাপমাত্রা আরামদায়কই হবে। শুক্রবার সেখানকার তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে থাকবে বলে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।

২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে ঘাঁটিটি পরিদর্শন করেছিলেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের শেষ সীমান্তের এই সেনারা মার্কিন প্রতিরক্ষার সামনের সারিতে কাজ করে।

১৯৪০ সালে নির্মিত এই ঘাঁটিটি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি প্রতিহতে প্রধান কমান্ড পয়েন্ট ছিল। ১৯৫৭ সালে স্নায়ুযুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন এই ঘাঁটিতে ২০০ যুদ্ধ বিমান ছিল।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, এপি ও তাস

Ad 300x250

সম্পর্কিত