সারা দেশে ৩৫ বছরে ছাত্র-সংসদ নির্বাচন হয়েছে মাত্র একবার
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সংসদ নেতৃত্ব এদেশে বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই নেতৃত্বই জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ছাত্র-সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন তৈরি হয় শঙ্কা? ৩৫ বছরে মাত্র একবার অনুষ্ঠিত হলো ছাত্র-সংসদ নির্বাচন?
সৌমিত জয়দ্বীপ
গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে মাত্র একবার৷ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন – যেটিকে বলা হয় দেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ’ বা ‘মিনি সংসদ’। আইয়ুব ও এরশাদের আমলেও এদেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। অনেক কল্পনা ও কাহিনি থাকলেও সবচেয়ে বড় খবর হলো: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচন হতো!
গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তথাকথিত নির্বাচনী গণতন্ত্রে নিরবচ্ছিন্নভাবে আছে। মাঝে কয়েকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্তর্বর্তী সরকার বাদ দিলে এদেশে সরকার পরিচালনা করেছেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকার৷ গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই করা দুই নেত্রীর মধ্যে খালেদা জিয়া নিজ আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও, শেখ হাসিনা এদেশের রাজনীতিতে তার অবস্থান সর্বৈবভাবে খুইয়েছেন।
তিন-তিনটি যাচ্ছেতাই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে কবর দেওয়া; এরপর চব্বিশের জুলাইয়ে এত মানুষের হত্যাকাণ্ড এবং গণ-অভ্যুত্থানের মুখে বিদেশ পলায়ন—শেখ হাসিনার রাজনীতির এক অর্থে যবনিকাপাত ঘটিয়েছে। অথচ, আশ্চর্যের বিষয় এই যে তার শাসনামলেই এদেশে একবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল!
কথাটি এজন্য বলতে হলো যে, বাংলাদেশে কার্যত কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় তো আরও নেই এবং নব্বইয়ের পর থেকে আসলে কখনই ছিল না। প্রভু মানে সরকারের ইচ্ছাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিপতিশীল অংশ ও প্রশাসনের ইচ্ছা—এই হলো স্বায়ত্তশাসনের চরিত্র ও চেহারা। এই চরিত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত দেড় দশকসহ বিগত ৩৫ বছরে বের হয়ে আসতে পারেনি বলেই তারা হয়ে উঠেছে সরকারের তল্পিবাহক; আর বুদ্ধিবৃত্তিক খুঁটির মাধ্যমে স্বীয় ব্যক্তিস্বার্থে জন্ম দিয়েছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের। ঠিক সে কারণেই সরকার না চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাছের পাতাও নড়েচড়ে না!
২.
কেন এত বছর ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি -- এর কোনো সদুত্তর কখনোই কোনো সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিতে পারেনি। বহুদিন ধরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও প্লাটফর্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও, সেই দাবি বাস্তবায়ন করেনি প্রশাসনগুলো। নানা সময়ে প্রশাসনগুলো অজুহাত হিসেবে বলেছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঝুঁকিপূর্ণ এবং ক্যাম্পাসে রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু এটা যে স্রেফ অজুহাতই, তা না বললেও চলে। সন্ত্রাস করে যারা রক্তপাত ঘটাবে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে তাদের ভোট পাওয়ারই সম্ভাবনা থাকবে না। ভোট পাওয়ার স্বার্থেই তখন সন্ত্রাস ও দখলদারত্ব কমে আসবে ক্যাম্পাসে।
ঠিক এ কারণেই প্রশ্ন জাগে, ২০১৯ সালে রক্তপাতহীন ডাকসু নির্বাচন হওয়ার পর কেন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই নির্বাচন হলো না? সেই সূত্রেও ওই একটি কথাই খাটে—সরকার চায়নি। আর সরকারের এই না চাওয়ার বড় কারণ, রক্তপাতের আশঙ্কা নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের কর্তৃত্ব খোয়ানোর জুজুর ভয়!
ছাত্র সংসদের নেতৃত্বকে এদেশে বরাবরই খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। তাদের হাত ধরে বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে এই নেতৃত্বই জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির সন্ত্রাসবাদী রূপ ও ক্যাম্পাসে সরকারি ছাত্র-সংগঠনের একক আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা তাদের কাছে ছাত্র সংসদের নেতৃত্ব দেওয়ার আলাদা কোনো আবেদন রাখেনি। সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও রাজনীতিবিমুখ করেছে।
এই সুযোগে যখন পাইপলাইন থেকে নির্বাচিত ছাত্রনেতাদের জাতীয় রাজনীতিতে আসা বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছেন অরাজনীতিকেরা—বিশেষত ব্যবসায়ী ও আমলারা। এই দুর্বৃত্তায়ন ঠেকানো যায়নি; ছাত্ররাজনীতি টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির গল্পে ভরপুর হয়ে গেছে, ছাত্র-সংগঠনের নেতারা লাঠিয়াল হয়েছেন দলের এবং দলের বিত্তবান ও ক্ষমতাবান নেতার। টাকার স্বার্থে ছাত্র অধিকারের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে এবং এই প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে দল-উপদলে বেড়েছে পেশিশক্তি দেখানোর ‘মাৎসান্যায়’।
ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে খোদ ছাত্ররাজনীতিই। উদারতাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের আওয়াজ তুলেছেন। অথচ যাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্ররাজনীতি নষ্ট করে ফেলা, তাঁরা অন্তরালে থেকে হাততালি দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। উদারতাবাদীরা এই দুষ্টচক্র নিয়ে একটি কথাও বলেননি।
এ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন করেছিল, এটা আশ্চর্যেরই বিষয়। তবে সরকার, বিশেষত, শেখ হাসিনার ‘সবুজ সংকেত’ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করেছিল, এটা ভাবা পরাবাস্তবতা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিস্ময়কর যে যাঁর হাতে নির্বাচনী ব্যবস্থা একদম ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল, ডাকসু নির্বাচন করার জন্য তিনি কেন সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন! কী ছিল তার উদ্দেশ্য, এ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। ভবিষ্যতের রাজনীতিকে বোঝাপড়ার স্বার্থেই এ জায়গায় অনুসন্ধিৎসুদের আলো ফেলা দরকার।
৩.
আশঙ্কার কথা হলো, আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্রই আর সেই অবস্থায় নেই, যেখানে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চিন্তা ও জ্ঞানের স্বাধীনতা লালনপালনের জন্য সরকারি হুকুমতের বাইরে গিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখার প্রশ্নে নিবেদিত থাকবে।
আশঙ্কার পিঠে সম্ভাবনার কথা হলো, সদ্যই একটি মহাকায় গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। যথারীতি শিক্ষার্থীরাই তাতে নেতৃত্ব দিয়ে কর্তৃত্ববাদকে ছুড়ে ফেলেছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ইতিহাসে এই প্রথম এ মাটিতে ছাত্র সংসদের কোনো ভূমিকা ছাড়াই গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে, যা হাল আমলে নিশ্চিতভাবে বাড়তি মনোযোগের দাবি রাখে।
অথচ, চব্বিশের জুলাইয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে নয় দফা দিয়েছিলেন, সেখানেও অন্যতম ছিল ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি। ছাত্র সংসদ ছাড়াই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিলেও তাঁরা যে ছাত্র সংসদের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, এটা দারুণ ব্যাপার। যদি সত্যিই নির্বাচন হয় এবং প্রক্রিয়া চলমান থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে গণ-অভ্যুত্থানের একটি বড় অর্জন হবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আদায় করা নেওয়া।
আশার কথা এ-ও যে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ ইতিবাচক ভাবনা দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভেতর। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটি—ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যেই বেশ ভালো নড়াচড়া শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশের বাইরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাকি অধিভুক্ত কলেজগুলোও সম্ভবত বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের দিকে তাকিয়ে আছে।
৪.
এই যদি হয় আশা, তাহলে আশঙ্কার কথা হলো, নির্বাচন কি আদৌ হবে, নাকি এটা স্রেফ আন্তরিক প্রলোভন? এ আশঙ্কার কারণ অমূলক নয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন না করার পেছনে অতীতে কী ধরনের রক্তপাতের অজুহাত প্রশাসনগুলো দিয়েছিল, আমরা তা দেখেছি। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হলে যে ভোট পাওয়ার স্বার্থেই ক্যাম্পাসগুলোতে আধিপত্যবাদীরাও শান্ত থাকে, সেটাও আমরা পাল্টা যুক্তি হিসেবে দেখাতে চেয়েছি।
৫ আগস্টের পর হাতেগোনা কয়েকটি ক্যাম্পাস বাদ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্তই আছে বলা যায়। হলগুলোতে জোরজবরদস্তি ও খবরদারির তেমন খবর নেই। এটা স্বস্তির ব্যাপার। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হওয়ার পাশাপাশি যদি ক্যাম্পাসগুলোও অশান্ত থাকত, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ দশা তৈরি হতো। এমনিতেই অনির্বাচিত, তার ওপর বেশ কিছু দুর্বলতা আছে সরকারের, সারা দেশ নানা সময়েই নানা কারণে উত্তাল হয়ে ওঠে; তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় যদি কেঁপে ওঠে, সামাল দেওয়া মুশকিল বৈকি।
জাতীয় পর্যায়ে চলছে সংস্কার নিয়ে নানান আলোচনা। এসব আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন অভ্যুত্থানের অংশীজনেরা। তবে অংশীজনদের মধ্যে মোটাদাগে দুটি ভাগ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই—সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে? আবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে, জাতীয় নির্বাচন আগে নাকি স্থানীয় নির্বাচন?
এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি স্থানীয় নির্বাচনের আগে বারবারই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে এবং সংস্কারকে চলমান প্রক্রিয়া আখ্যা দিয়ে তারা সংস্কারের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত সরকারকেই প্রমাণ মানছে। অন্যদিকে, আরেকটি বড় অংশ, যাঁর মধ্যে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নতুন দল এনসিপিও আছে, তাঁরা আগে সংস্কার, পরে স্থানীয় নির্বাচন এবং সবশেষে জাতীয় নির্বাচন চায়।
এই দুটি ধারা এক মোহনায় মিলিত হবে বলে মনে হয় না। জাতীয় রাজনীতির এই দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে প্রশাসনগুলো স্বভাবতই চাইবে তাদের স্ব স্ব ক্যাম্পাস নিরুত্তাপ থাকুক। ঠিক সে কারণেই আশঙ্কা আছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে। নির্বাচনের মরীচিকাটি যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফেরি করা যায়, তবে তারা হয়তো এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে এবং এর ইতিবাচক ফল হবে স্বস্তিদায়ক। কিন্তু সত্যিই যদি নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও কোনো টালবাহানা করা হয়, তাহলে গণ-অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ শিক্ষার্থীরা কি তা মানবেন?
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় হতে পারে ফেব্রুয়ারি কিংবা এপ্রিল মাস। আর ডাকসু নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বর, রাকসু ১৫ সেপ্টেম্বর এবং জাকসুর সম্ভাব্য তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর। ডাকসু ও রাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রশাসন এখনও পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হলেও জাকসু নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রতার প্রবণতা। ২০১২-১৩ সালেও জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করেনি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের প্রশাসন। ফলে প্রশাসনের গভীরে কী খেলা চলছে, তা ভালোভাবে বোঝা দরকার।
জাকসুর ক্ষেত্রে বারবার তারিখ পরিবর্তন প্রশাসনের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে হয়তো। কিন্তু সেটা চোখে দেখা যাচ্ছে। বাকিদেরগুলো খোলা চোখে ঠিকঠাক লাগলেও প্রক্রিয়াগুলো আদৌ কি স্বচ্ছ উপায়ে হচ্ছে? নির্বাচন আয়োজনে প্রশাসনগুলো আসলেই কি বদ্ধপরিকর ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? এ বিষয়ে সরকার কোথাও কিছু বলেনি, এটা ভালো দিক। কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কি শেষ পর্যন্ত তারাও জড়িয়ে যাবে?
অন্যদিকে, নির্বাচন যদি হয়ই, তাহলে নিষিদ্ধ থাকায় এই প্রথম ছাত্রলীগবিহীন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। সেক্ষেত্রে জনপ্রিয়তার নিক্তিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকার কথা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে যদি ‘স্থানীয় নির্বাচন’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়, তাহলে নির্বাচনকে সাধুবাদ জানানো বিএনপির ছাত্র সংগঠনটিকে ‘আগে জাতীয় নির্বাচন চাই’ দাবি থেকে সরে আসতে হবে। যে কারণে ছাত্রদলের মধ্যেও ছাত্র সংসদ নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস লক্ষ করা যাচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ছাত্রদল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আসবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে এটা এক বিশাল সংশয়চিহ্ন হয়ে উঠতে পারে। আর নিষিদ্ধ থাকায় নির্বাচন ঠেকানোর ব্যাপারে ছাত্রলীগের ভূমিকা কী হবে, সেটিও দুরবিন চোখে লক্ষ রাখতে হবে।
৫.
সেপ্টেম্বরে তিনটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অর্থ হলো হাতে সময় আছে বড়জোর এক মাস। অথচ এতদিনের দাবি পূরণ হওয়ার কাছাকাছি এসেও ক্যাম্পাসগুলোতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খুব বেশি সাড়াশব্দ নেই। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে—যেখানে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ আছে বলে আশা করা যেতে পারে, সেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আশাবাদী হয়েও কেন আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, তা বিস্ময়কর। এটা কি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অনেক সম্ভাবনা জলে ও জ্বলে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মনোজগতে ঠাঁই পাচ্ছে? হতে পারে। তবে যা-ই হোক, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে মাত্র একবার৷ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন – যেটিকে বলা হয় দেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ’ বা ‘মিনি সংসদ’। আইয়ুব ও এরশাদের আমলেও এদেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। অনেক কল্পনা ও কাহিনি থাকলেও সবচেয়ে বড় খবর হলো: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচন হতো!
গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তথাকথিত নির্বাচনী গণতন্ত্রে নিরবচ্ছিন্নভাবে আছে। মাঝে কয়েকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্তর্বর্তী সরকার বাদ দিলে এদেশে সরকার পরিচালনা করেছেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকার৷ গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই করা দুই নেত্রীর মধ্যে খালেদা জিয়া নিজ আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও, শেখ হাসিনা এদেশের রাজনীতিতে তার অবস্থান সর্বৈবভাবে খুইয়েছেন।
তিন-তিনটি যাচ্ছেতাই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে কবর দেওয়া; এরপর চব্বিশের জুলাইয়ে এত মানুষের হত্যাকাণ্ড এবং গণ-অভ্যুত্থানের মুখে বিদেশ পলায়ন—শেখ হাসিনার রাজনীতির এক অর্থে যবনিকাপাত ঘটিয়েছে। অথচ, আশ্চর্যের বিষয় এই যে তার শাসনামলেই এদেশে একবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল!
কথাটি এজন্য বলতে হলো যে, বাংলাদেশে কার্যত কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় তো আরও নেই এবং নব্বইয়ের পর থেকে আসলে কখনই ছিল না। প্রভু মানে সরকারের ইচ্ছাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিপতিশীল অংশ ও প্রশাসনের ইচ্ছা—এই হলো স্বায়ত্তশাসনের চরিত্র ও চেহারা। এই চরিত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত দেড় দশকসহ বিগত ৩৫ বছরে বের হয়ে আসতে পারেনি বলেই তারা হয়ে উঠেছে সরকারের তল্পিবাহক; আর বুদ্ধিবৃত্তিক খুঁটির মাধ্যমে স্বীয় ব্যক্তিস্বার্থে জন্ম দিয়েছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের। ঠিক সে কারণেই সরকার না চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাছের পাতাও নড়েচড়ে না!
২.
কেন এত বছর ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি -- এর কোনো সদুত্তর কখনোই কোনো সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিতে পারেনি। বহুদিন ধরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও প্লাটফর্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও, সেই দাবি বাস্তবায়ন করেনি প্রশাসনগুলো। নানা সময়ে প্রশাসনগুলো অজুহাত হিসেবে বলেছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঝুঁকিপূর্ণ এবং ক্যাম্পাসে রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু এটা যে স্রেফ অজুহাতই, তা না বললেও চলে। সন্ত্রাস করে যারা রক্তপাত ঘটাবে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে তাদের ভোট পাওয়ারই সম্ভাবনা থাকবে না। ভোট পাওয়ার স্বার্থেই তখন সন্ত্রাস ও দখলদারত্ব কমে আসবে ক্যাম্পাসে।
ঠিক এ কারণেই প্রশ্ন জাগে, ২০১৯ সালে রক্তপাতহীন ডাকসু নির্বাচন হওয়ার পর কেন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই নির্বাচন হলো না? সেই সূত্রেও ওই একটি কথাই খাটে—সরকার চায়নি। আর সরকারের এই না চাওয়ার বড় কারণ, রক্তপাতের আশঙ্কা নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের কর্তৃত্ব খোয়ানোর জুজুর ভয়!
ছাত্র সংসদের নেতৃত্বকে এদেশে বরাবরই খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। তাদের হাত ধরে বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে এই নেতৃত্বই জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির সন্ত্রাসবাদী রূপ ও ক্যাম্পাসে সরকারি ছাত্র-সংগঠনের একক আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা তাদের কাছে ছাত্র সংসদের নেতৃত্ব দেওয়ার আলাদা কোনো আবেদন রাখেনি। সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও রাজনীতিবিমুখ করেছে।
এই সুযোগে যখন পাইপলাইন থেকে নির্বাচিত ছাত্রনেতাদের জাতীয় রাজনীতিতে আসা বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছেন অরাজনীতিকেরা—বিশেষত ব্যবসায়ী ও আমলারা। এই দুর্বৃত্তায়ন ঠেকানো যায়নি; ছাত্ররাজনীতি টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির গল্পে ভরপুর হয়ে গেছে, ছাত্র-সংগঠনের নেতারা লাঠিয়াল হয়েছেন দলের এবং দলের বিত্তবান ও ক্ষমতাবান নেতার। টাকার স্বার্থে ছাত্র অধিকারের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে এবং এই প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে দল-উপদলে বেড়েছে পেশিশক্তি দেখানোর ‘মাৎসান্যায়’।
ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে খোদ ছাত্ররাজনীতিই। উদারতাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের আওয়াজ তুলেছেন। অথচ যাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্ররাজনীতি নষ্ট করে ফেলা, তাঁরা অন্তরালে থেকে হাততালি দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। উদারতাবাদীরা এই দুষ্টচক্র নিয়ে একটি কথাও বলেননি।
এ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন করেছিল, এটা আশ্চর্যেরই বিষয়। তবে সরকার, বিশেষত, শেখ হাসিনার ‘সবুজ সংকেত’ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করেছিল, এটা ভাবা পরাবাস্তবতা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিস্ময়কর যে যাঁর হাতে নির্বাচনী ব্যবস্থা একদম ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল, ডাকসু নির্বাচন করার জন্য তিনি কেন সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন! কী ছিল তার উদ্দেশ্য, এ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। ভবিষ্যতের রাজনীতিকে বোঝাপড়ার স্বার্থেই এ জায়গায় অনুসন্ধিৎসুদের আলো ফেলা দরকার।
৩.
আশঙ্কার কথা হলো, আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্রই আর সেই অবস্থায় নেই, যেখানে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চিন্তা ও জ্ঞানের স্বাধীনতা লালনপালনের জন্য সরকারি হুকুমতের বাইরে গিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখার প্রশ্নে নিবেদিত থাকবে।
আশঙ্কার পিঠে সম্ভাবনার কথা হলো, সদ্যই একটি মহাকায় গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। যথারীতি শিক্ষার্থীরাই তাতে নেতৃত্ব দিয়ে কর্তৃত্ববাদকে ছুড়ে ফেলেছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ইতিহাসে এই প্রথম এ মাটিতে ছাত্র সংসদের কোনো ভূমিকা ছাড়াই গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে, যা হাল আমলে নিশ্চিতভাবে বাড়তি মনোযোগের দাবি রাখে।
অথচ, চব্বিশের জুলাইয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে নয় দফা দিয়েছিলেন, সেখানেও অন্যতম ছিল ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি। ছাত্র সংসদ ছাড়াই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিলেও তাঁরা যে ছাত্র সংসদের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, এটা দারুণ ব্যাপার। যদি সত্যিই নির্বাচন হয় এবং প্রক্রিয়া চলমান থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে গণ-অভ্যুত্থানের একটি বড় অর্জন হবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আদায় করা নেওয়া।
আশার কথা এ-ও যে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ ইতিবাচক ভাবনা দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভেতর। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটি—ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যেই বেশ ভালো নড়াচড়া শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশের বাইরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাকি অধিভুক্ত কলেজগুলোও সম্ভবত বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের দিকে তাকিয়ে আছে।
৪.
এই যদি হয় আশা, তাহলে আশঙ্কার কথা হলো, নির্বাচন কি আদৌ হবে, নাকি এটা স্রেফ আন্তরিক প্রলোভন? এ আশঙ্কার কারণ অমূলক নয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন না করার পেছনে অতীতে কী ধরনের রক্তপাতের অজুহাত প্রশাসনগুলো দিয়েছিল, আমরা তা দেখেছি। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হলে যে ভোট পাওয়ার স্বার্থেই ক্যাম্পাসগুলোতে আধিপত্যবাদীরাও শান্ত থাকে, সেটাও আমরা পাল্টা যুক্তি হিসেবে দেখাতে চেয়েছি।
৫ আগস্টের পর হাতেগোনা কয়েকটি ক্যাম্পাস বাদ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্তই আছে বলা যায়। হলগুলোতে জোরজবরদস্তি ও খবরদারির তেমন খবর নেই। এটা স্বস্তির ব্যাপার। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হওয়ার পাশাপাশি যদি ক্যাম্পাসগুলোও অশান্ত থাকত, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ দশা তৈরি হতো। এমনিতেই অনির্বাচিত, তার ওপর বেশ কিছু দুর্বলতা আছে সরকারের, সারা দেশ নানা সময়েই নানা কারণে উত্তাল হয়ে ওঠে; তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় যদি কেঁপে ওঠে, সামাল দেওয়া মুশকিল বৈকি।
জাতীয় পর্যায়ে চলছে সংস্কার নিয়ে নানান আলোচনা। এসব আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন অভ্যুত্থানের অংশীজনেরা। তবে অংশীজনদের মধ্যে মোটাদাগে দুটি ভাগ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই—সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে? আবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে, জাতীয় নির্বাচন আগে নাকি স্থানীয় নির্বাচন?
এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি স্থানীয় নির্বাচনের আগে বারবারই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে এবং সংস্কারকে চলমান প্রক্রিয়া আখ্যা দিয়ে তারা সংস্কারের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত সরকারকেই প্রমাণ মানছে। অন্যদিকে, আরেকটি বড় অংশ, যাঁর মধ্যে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নতুন দল এনসিপিও আছে, তাঁরা আগে সংস্কার, পরে স্থানীয় নির্বাচন এবং সবশেষে জাতীয় নির্বাচন চায়।
এই দুটি ধারা এক মোহনায় মিলিত হবে বলে মনে হয় না। জাতীয় রাজনীতির এই দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে প্রশাসনগুলো স্বভাবতই চাইবে তাদের স্ব স্ব ক্যাম্পাস নিরুত্তাপ থাকুক। ঠিক সে কারণেই আশঙ্কা আছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে। নির্বাচনের মরীচিকাটি যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফেরি করা যায়, তবে তারা হয়তো এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে এবং এর ইতিবাচক ফল হবে স্বস্তিদায়ক। কিন্তু সত্যিই যদি নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও কোনো টালবাহানা করা হয়, তাহলে গণ-অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ শিক্ষার্থীরা কি তা মানবেন?
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় হতে পারে ফেব্রুয়ারি কিংবা এপ্রিল মাস। আর ডাকসু নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বর, রাকসু ১৫ সেপ্টেম্বর এবং জাকসুর সম্ভাব্য তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর। ডাকসু ও রাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রশাসন এখনও পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হলেও জাকসু নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রতার প্রবণতা। ২০১২-১৩ সালেও জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করেনি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের প্রশাসন। ফলে প্রশাসনের গভীরে কী খেলা চলছে, তা ভালোভাবে বোঝা দরকার।
জাকসুর ক্ষেত্রে বারবার তারিখ পরিবর্তন প্রশাসনের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে হয়তো। কিন্তু সেটা চোখে দেখা যাচ্ছে। বাকিদেরগুলো খোলা চোখে ঠিকঠাক লাগলেও প্রক্রিয়াগুলো আদৌ কি স্বচ্ছ উপায়ে হচ্ছে? নির্বাচন আয়োজনে প্রশাসনগুলো আসলেই কি বদ্ধপরিকর ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? এ বিষয়ে সরকার কোথাও কিছু বলেনি, এটা ভালো দিক। কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কি শেষ পর্যন্ত তারাও জড়িয়ে যাবে?
অন্যদিকে, নির্বাচন যদি হয়ই, তাহলে নিষিদ্ধ থাকায় এই প্রথম ছাত্রলীগবিহীন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। সেক্ষেত্রে জনপ্রিয়তার নিক্তিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকার কথা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে যদি ‘স্থানীয় নির্বাচন’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়, তাহলে নির্বাচনকে সাধুবাদ জানানো বিএনপির ছাত্র সংগঠনটিকে ‘আগে জাতীয় নির্বাচন চাই’ দাবি থেকে সরে আসতে হবে। যে কারণে ছাত্রদলের মধ্যেও ছাত্র সংসদ নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস লক্ষ করা যাচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ছাত্রদল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আসবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে এটা এক বিশাল সংশয়চিহ্ন হয়ে উঠতে পারে। আর নিষিদ্ধ থাকায় নির্বাচন ঠেকানোর ব্যাপারে ছাত্রলীগের ভূমিকা কী হবে, সেটিও দুরবিন চোখে লক্ষ রাখতে হবে।
৫.
সেপ্টেম্বরে তিনটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অর্থ হলো হাতে সময় আছে বড়জোর এক মাস। অথচ এতদিনের দাবি পূরণ হওয়ার কাছাকাছি এসেও ক্যাম্পাসগুলোতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খুব বেশি সাড়াশব্দ নেই। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে—যেখানে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ আছে বলে আশা করা যেতে পারে, সেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আশাবাদী হয়েও কেন আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, তা বিস্ময়কর। এটা কি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অনেক সম্ভাবনা জলে ও জ্বলে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মনোজগতে ঠাঁই পাচ্ছে? হতে পারে। তবে যা-ই হোক, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাঁদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তাঁরা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাতচল্লিশের সেই দেশভাগ বা পার্টিশনের প্রভাব এখনো বহন করে চলেছি আমরা। একে কোনো একরৈখিক বয়ানে বেঁধে ফেলা দুষ্কর।
৬ ঘণ্টা আগেনব্বইয়ের ক্লান্তি কিংবা বার্ধক্য-জরায় যতীন স্যার কখনোই নিঃসঙ্গতায় ছিলেন না। বাংলার প্রাকৃতজনের দার্শনিক জ্ঞান ও শান্তির দ্রোণাচার্য যতীন সরকার জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাতপাই, রামকৃষ্ণ রোডের 'বানপ্রস্থ' নামের বাড়িতে মানুষের সান্নিধ্যেই থাকতেন।
১ দিন আগেতারেক মাসুদ নামটি খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ কাজ নয়। আমি তাঁর ছাত্র, অনুসারী, সহযোগী বা উত্তরসূরি হলেও অন্য অনেকের মতোই আমিও তাঁকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম। কিন্তু এই ভাই ডাকার অভ্যস্ততা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এত গভীরে প্রোত্থিত যে আনুষ্ঠানিক কারণেও শুধু নামটি উচ্চারণে আমার অস্বস্তি হয়।
১ দিন আগেমাত্র ২৮ বছরের তরুণ ছিলেন আল-জাজিরার ফিলিস্তিনি প্রতিবেদক আনাস আল শরীফ। স্পষ্টতার সঙ্গে তুলে ধরতেন ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার অমানবিক রূপ। তাঁর প্রতিবেদনে প্রাণহীন শুষ্ক তথ্য ছাড়িয়ে উঠে আসত অবরুদ্ধ জীবনের নিখাদ ও অনাবৃত প্রতিচ্ছবি।
২ দিন আগে