leadT1ad

পোশাক নিয়ে বিতর্ক

কেন ‘সমাজ’ বারবার নারীর পোশাক নিয়ে কথা বলে

আমাদের দেশে নারীদের পোশাক নিয়ে কটূক্তি বা কথা বলার চল বেশ পুরোনো। নারীর পোশাক নিয়ে আমাদের সমাজে কারও কারও মধ্যে কেন অস্বস্তি কাজ করে? এ অস্বস্তির পেছনের মনস্তত্ত্বই-বা কী?

ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

নারীর পোশাক নিয়ে আমাদের সমাজে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। নারী কোন পোশাক কীভাবে পরবে, তা সবসময়ই ‘সমাজ’ ঠিক করে দিতে চায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পোশাকসংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন ঘিরে নারীর পোশক-বিতর্ক আবার চাঙা হয়েছে। পরে তা খানিকটা থেমেও গেছে প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করার ফলে। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে মনে হলো, নারীর পোশাক নিয়ে আমাদের সমাজে কারও কারও মধ্যে কেন অস্বস্তি কাজ করে? এ অস্বস্তির পেছনের মনস্তত্ত্বই-বা কী, এ লেখায় সে বিষয়গুলোই খানিকটা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করব।

শুরুতেই দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক।

সেখানে কর্মরত এক নারী কর্মীকে একবার ডেকে পাঠানো হলো। তারপর মানবসম্পদ বিভাগের উপস্থিতিতে তাঁকে জানানো হলো যে তাঁর পোশাক কাজের পরিবেশকে বিঘ্নিত করছে। তিনি যখন বিনীতভাবে জানতে চান, কীভাবে পরিবেশকে বিঘ্নিত করছে তাঁর পোশাক, তখন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জবাব দেওয়া হলো যে পুরুষ সহকর্মীরা কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। বলা ভালো, ওই নারী কর্মী নিয়মিত শাড়ি পরে অফিসে যেতেন।

এবার দ্বিতীয় ঘটনা। একই প্রতিষ্ঠানের আরেক নারীকে ডাকা হয় মানবসম্পদ বিভাগে। এরপর তাঁকে ১৫ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয় পোশাক ‘ঠিক’ করার জন্য। তিনি তাঁর পোশাকের সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে বলা হয়, যে ধরনের পোশাক তিনি পরেন, তা অফিসের পরিবেশের জন্য উপযুক্ত নয়। অন্য সহকর্মীরা তাঁর পোশাকের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, তিনি প্রায় সব ধরনের পোশাক পরেই অফিস করতেন। তবে পশ্চিমা পোশাকেই তাঁকে বেশি দেখা যেত।

এখন আরেকটি ঘটনার কথাও মনে করিয়ে দিই। ২০২২ সালের মে মাস। নরসিংদী থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় রেলস্টেশনে অপেক্ষারত এক তরুণীকে ব্যাপক হেনস্তার শিকার হতে হয়। স্টেশনে বহু মানুষের উপস্থিতিতে স্থানীয় এক মাঝবয়সী নারী ওই তরুণীর পোশাক ‘অশালীন’ বলে কটূক্তি করেন। বাদানুবাদের একপর্যায়ে তরুণীটিকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেন ওই নারী।

এ সময় সেখানে উপস্থিত পুরুষেরাও এগিয়ে আসেন ওই নারীর সমর্থনে। এ ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মামলা হওয়ার পর র‍্যাব গ্রেপ্তার করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের। পরে উচ্চ আদালতে অভিযুক্তদের জামিনের শুনানিতে বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যক্তির পোশাকের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেন।

লুই আলথুসার। সংগৃহীত ছবি
লুই আলথুসার। সংগৃহীত ছবি

এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের প্রশ্ন ছিল, ‘(ওই তরুণী) প্ল্যাটফর্মে আপত্তিকর অবস্থায় ছিল, সিডিতে দেখা যায়। এটি আপনার অধিকার? পোশাকের অধিকার?’ আদালত আরও প্রশ্ন করেন, ‘কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার অধিকার মানুষের নেই? পোশাক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না? যে সমাজে যাবেন, সে সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও একটি বিষয়। ঢাকায় একধরনের পরিবেশ, গ্রামে আরেক ধরনের। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ আগস্ট ২০২২)

অর্থাৎ পোশাক কেবল পোশাক নয়। দেখা যাচ্ছে, উল্লিখিত তিনটি ঘটনাতেই পোশাক ‘সাবজেক্ট’ বা কর্তা হয়ে উঠেছে। আর ব্যক্তি পর্যবসিত হয়েছেন ‘অবজেক্ট’ বা কর্মে। ফলে এখানে কী ঘটল?

স্বীয় পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘সাবজেক্ট’ বা কর্তা (ব্যক্তি) চলে গেলেন নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়। অন্যদিকে ‘অবজেক্ট’ বা পোশাক ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ধারণে সক্রিয় নিয়ামক হয়ে উঠল। এখানে আমরা পোশাকের ওপর ‘সমাজ’ নির্মিত এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আরোপ করলাম, যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠল।

পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীর পোশাকের রেয়িফিকেশন ঘটে। এখানে কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, পারিবারিক মূল্যবোধসহ নানা ফ্যালাসি পোশাককে একটি মানব-সৃষ্ট বস্তু থেকে স্বতন্ত্র সত্তায় রূপান্তরিত করে। আর এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রেয়িফিকেশন নামের প্রপঞ্চটি অলক্ষ্যে নারীর জীবনকে শাসনের ক্ষমতাও অর্জন করে।

মা‍র্কসবাদী তত্ত্বে এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘রেয়িফিকেশন’। বাংলায় রেফিকেশনের অর্থ করলে সহজভাবে যা দাঁড়ায়, তা হলো: কোনো কিছুকে জিনিসে পরিণত করা। ইউগোস্লাভিয়ার মা‍র্কসবাদী তাত্ত্বিক গাহো পেট্রোভিক রেয়িফিকেশনকে ১৯৬৫ সালে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাঁর মতে, রেয়িফিকেশন হলো এমন এক বিষয় যার মাধ্যমে মানবিক বৈশিষ্ট্য, সম্পর্ক আর তৎপরতাকে মানবসৃষ্ট বস্তুর বৈশিষ্ট্য, সম্পর্ক এবং তৎপরতায় রূপান্তর করা হয়, নিদেনপক্ষে রূপান্তরের ফলাফল হিসেবে দেখা হয়। এটি মানুষ থেকে স্বতন্ত্র এবং আদি থেকেই স্বতন্ত্র বলে কল্পিত। ফলে মানুষের জীবনকে সে শাসন করে। এছাড়া এই প্রপঞ্চের মধ্যে আরও আছে, মানবসত্তার বস্তুসত্তায় রূপান্তর, যা সব ক্ষেত্রে মানবিক পন্থায় আচরণ তো করেই করে না; বরং অনুসরণ করে বস্তু জগতের আইন। বলা দরকার, এই রেয়িফিকেশন হলো বিচ্ছিন্নতার একটি ‘বিশেষ’ রূপ, যা কট্টরপন্থা ও পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্যরূপে গণ্য।

বলাবাহুল্য, পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীর পোশাকের রেয়িফিকেশন ঘটে। এখানে কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, পারিবারিক মূল্যবোধসহ নানা ফ্যালাসি পোশাককে একটি মানব-সৃষ্ট বস্তু থেকে স্বতন্ত্র সত্তায় রূপান্তরিত করে। আর এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রেয়িফিকেশন নামের প্রপঞ্চটি অলক্ষ্যে নারীর জীবনকে শাসনের ক্ষমতাও অর্জন করে।

শাড়িতে এক নারী শিক্ষার্থী। ছবি: আশরাফুল আলম
শাড়িতে এক নারী শিক্ষার্থী। ছবি: আশরাফুল আলম

শুরুতেই বলেছি, ২১ জুলাই সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পোশাকবিষয়ক একটি নির্দেশনা জারি করেছিল। এখানে নারী কর্মীদের জন্য ছোট হাতা ও ছোট দৈর্ঘ্যের পোশাক ও লেগিংস নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে কর্তৃপক্ষ এক দিনের মধ্যে নির্দেশনাটি প্রত্যাহার করলেও বিষয়টি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

সে প্রশ্নগুলো আলোচনার সুবিধার্থে আমরা এখন ফরাসি তাত্ত্বিক লুই আলথুসারের শরণ নিতে চাই। আলথুসার ‘আইডিওলজিকাল স্টেট অ্যাপারেটাস’ বা মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা বলেছেন। সাধারণত মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে কাজ করে?

এ ব্যবস্থায় প্রধানত প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দমন-পীড়নের পথে না হেঁটেই সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখে ক্ষমতার ওপরের দিকে থাকা গোষ্ঠী। আলথুসারের মতে, একটি সামাজিক শ্রেণি আধিপত্য ধরে রাখতে পারে না, যদি তারা মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্রের উপযুক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না করে।

ব্যাপারটি আরেকটু বিশদে বলা যাক। মানুষ সামাজিক প্রত্যাখ্যান, উপহাস, বহিষ্কার এবং সর্বোপরি বিচ্ছিন্নতার সচেতন ও অবচেতন শঙ্কায় আদর্শিকভাবে অধীন হলে তবেই সম্পন্ন হয় রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। সেই সূত্রে পোশাকের এই রেয়িফিকেশনের মাধ্যমে কি তবে নারীকে অধিকার বঞ্চিত করে অধীন রাখার প্রক্রিয়ারই বাস্তবায়ন ঘটছে?

লেখক : শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস; সাংবাদিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত