৮ আগস্ট সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সমগীত’-এর আয়োজনে ‘বিভাজনের সংস্কৃতি বনাম প্রতিরোধের ঐক্য’ শিরোনামের এক আলোচনা সভার বক্তব্যে এই কথাগুলো বলেছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাভিন মুরশিদ। রাজধানীর দৃক পাঠ ভবনে আয়োজিত হয় এ সভায় জাতীয় ঐক্য, নারীর অধিকার, প্রবাসী শ্রমিক, গার্মেন্টসকর্মীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন তিনি। প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী হওয়ায় তাঁর সেই আলোচনা ছাপা হলো এখানে।
নাভিন মুর্শিদ
আমরা প্রায়ই ‘ঐক্য’ শব্দটি শুনি—ঐকমত্য কমিশনের কাছে, রাজনৈতিক মঞ্চে, দলের কাছে, নিজেদের মধ্যেও। জুলাই-পরবর্তী সময়ে বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলি সবাই। জুলাইয়ের ঐক্য ধরে রাখার কথা বলি। কিন্তু খুনের প্রতিবাদ করা তো আসলে ওয়ান-টাইম ঐক্য। এই ঐক্যের দৌড় কত দূর?
ঐক্য কি আসলেই কোনো সমাধান দিচ্ছে? নাকি আজকের বিভাজিত সমাজে বিভেদের ক্ষতকে আরও গভীর করছে? আজকের বাংলাদেশে, যেখানে আমরা আওয়ামী বাইনারির উল্টো দিকে অবস্থান করছি, আমাদের নানা রকম ট্যাগ দিয়ে হেনস্তা, এমনকি হত্যা মামলাও দেওয়া হচ্ছে; অর্থাৎ বিশ্বাসের জায়গা নেই বললেই চলে। এই বাস্তবতায় ঐক্য আসলে কতটা সম্ভব? এই ঐক্য কার স্বার্থে? এর মানেই বা কি? আমার মনে হয়, ‘ঐক্য’ শব্দটি আমরা ব্যবহার করি বটে, তবে কথা বলি ভিন্ন ভাষায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বুঝিবার বা বুঝাইবার’ সমস্যা ও সংকট লেগেই থাকে।
২.
এখানে একটি প্রশ্ন তোলা যাক, সংস্কৃতি আসলে কী?
শিল্পচর্চার জায়গা থেকে সংস্কৃতি হলো ‘কালচার অ্যাজ পারফর্ম্যান্স’। গান, নাচ, নাটক, সাহিত্য, চিত্রকলা, পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী ইত্যাদি। এই সংস্কৃতি আমাদের গর্বের জায়গা। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা এই সংস্কৃতির মাধ্যমেই নিজেদের পরিচয় তুলে ধরি। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সংস্কৃতি অনেক সময়ই মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, থেকেছে; এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাপন থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করে। উদহারণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশে শুধু সিনেমাকে তৈরি করা হয়েছে গরিব মানুষের বিনোদন হিসেবে; এবং সেই অজুহাতে অখাদ্য সিনেমা তৈরি হয়েছে, হয়ও; অবস্থা এমন, যেন গরিবের রুচি খুব খারাপ। ভাবেন, কী শ্রেণি-ঘৃণা থাকলে এমনটা সম্ভব! আমরা ধরেই নিয়েছি, গরিব মানুষ ‘উচ্চপর্যায়ের’ সংস্কৃতি বুঝবে না। আমরা তো জানি কথাটা কত ভুল।
মাস চারেক আগে গুলশানের শাহাবুদ্দিন পার্কে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করলাম আমরা। এখানে বেশির ভাগ মানুষ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন শ্রমিকশ্রেণির। রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গেই তো তাঁরা নাচলেন, গলা মিলালেন, হাততালি দিলেন। তখন আমার মনে হলো, আমরা ওদের দূরে রাখব আর বলব ওরা চায় না, কী অদ্ভুত ব্যাপার! বলব, ওরা কেবল ওয়াজ শুনতে যেতে চায়। ওয়াজ শুনলে কোনোই অসুবিধা নেই, কিন্তু ওয়াজ ছাড়া যদি ওদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা না থাকে, তাহলে তা তো সমস্যার।
এরই উল্টো পিঠে আজ এই যে আমার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনায় একজন লিখে দিল, আমি ‘র’-এর এজেন্ট, আমি নাকি ভুলে গেছি ভারতীয় আধিপত্যের কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। কথা হলো, ভারতীয় আধিপত্য নিয়ে আমারই তো কাজ আছে, কিন্তু সেটা বললে তো আর ‘র’-এর বলা যাবে না (নাকি যাবে?)। কিন্তু এই যে রবীন্দ্রনাথকে ভারতের সঙ্গে মিলিয়ে দিল! রবীন্দ্রনাথও যেন র-এর এজেন্ট! আগে সবাই ছিল ‘আই এস আই’য়ের। এখন ‘র’-এর। তাহলে প্রতিরোধের ঐক্য কীভাবে হবে? যেখানে আমরা অপরপক্ষকে সবসময় খারিজ করে দিতে চাই?
৩.
সেদিন দ্রোহযাত্রার একবছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আমরা গান গাইতে দাঁড়ালাম: ‘ধনধান্য পুষ্পভরা...সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি…।’—আবারও জাতীয়বাদী ধারণায় মুক্তি খোঁজা।
পরের গান, ‘সামনে পড়ে আছে বুলেটবিদ্ধ লাশ/ ...রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই নিতে হয়।’ আবারও সেই প্রতিহিংসা, লাশের রাজনীতি। যে কথা লাশ বলেনি, লাশের মুখে সে কথা জোরপূর্বক ঢুকিয়ে দেওয়া। ক্লাস-অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন!
আমরা যাঁরা ভাবি, আমরা এই বাইনারির বাইরে—আমরাও যদি এভাবে ভাবি, তবে মুক্তির পথ তো ঠিক দেখা যায় না। ঐক্য এক্ষেত্রে যেন অন্যপক্ষকে দমন করে তৈরি করার ডাক। কখনো তা দমন-পীড়নকেও বৈধ্যতা দেয়। এ ব্যাপারগুলো আসলে সমস্যাজনক।
সেদিন শিক্ষক নেটওয়ার্কের আলাপে, একজন প্রভাষক খুব সুন্দর একটা ক্রিটিক্যাল অবজারভেশন দিলেন। কিন্তু তার আগে ক্ষমা চেয়ে নিলেন এই ভেবে যে এখানে বড়রা আছেন, তাঁর কথা পাছে বেয়াদবের মতো শোনায়। এই উঁচু-নিচুর হায়ারার্কি আমরাই ভাঙতে পারছি না, নিজেদের মধ্যেও না, ঐক্য তাহলে কীভাবে হবে?
৪.
এখন জীবনযাপনের সংস্কৃতি ‘কালচার অ্যাজ আ ওয়ে অব লাইফ’ নিয়ে দু-চার কথা। বলা যায়, এটিই সংস্কৃতির আসল ও বৃহত্তর রূপ। আমরা কী খাই, কী পরি, কীভাবে কথা বলি, আমাদের বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, পারিবারিক সম্পর্ক—এসব কিছুই জীবনযাপনের সংস্কৃতির অংশ। এই সংস্কৃতি স্থির নয়, প্রতিনিয়ত এটি বদলায়। আর এখানেই আমাদের বিভাজনগুলো সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
‘শুদ্ধ’ বাঙালি সংস্কৃতি কী জিনিস? সেকুলার-বামদের প্রতি এই এক অভিযোগ। ভাষা হোক বা সংগীত, ‘শুদ্ধতা’ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা সংস্কৃতিকে যেমন একরোখা করে দিয়েছে, তেমনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করেছে। ফলে আজকে আমরা দেখছি জীবনযাপন, বিশ্বাস, পোশাকের রাজনীতি—নানা ক্ষেত্রে প্রতিরোধ হিসেবে উঠে আসছে উগ্রবাদ। মেয়েদের ওড়নাও এখন ইস্যু হয়ে ওঠে।
৫.
এবার ঐক্যের সংকট ও ডানপন্থার উত্থান নিয়ে কিছু বলা যাক।
যখন একটি সমাজ এতটা গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে যায়, ‘ঐক্য’ শব্দটি তখন কিন্তু বিপজ্জনকও হয়ে ওঠে। কারণ, তখন ঐক্যের আহ্বানকে মনে হতে পারে, ‘আমার মতো হও, আমার বিশ্বাস মেনে নাও, আমার সংস্কৃতি গ্রহণ করো, তবেই আমরা এক হতে পারব।’ এটি আসলে ঐক্য নয়, আত্মসমর্পণের আহ্বান। ঠিক দ্রোহযাত্রার ওই গানের লাইনের মতো, ‘মুক্তির জন্য এই শেষ যুদ্ধ, শান্তির জন্য এই শেষ যুদ্ধ।’
ইদানীং আবার সবচেয়ে নিচু মানদণ্ডের বিষয়-আশয়ও দেখতে পাই। যেমন ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারীর সংসদীয় আসন নিয়ে যে ঐক্য—যা থেকে আবার ইসলামি দলগুলো বাদ—এমন ঐক্য দিয়ে কী হবে?
অগ্রগতির পথ তো দেখছি না।
বিভাজনের রাজনীতির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমরা আজ এমন সরল-সহজ ঐক্যও দেখি না যে ‘হাসিনা যা করেছে আমরা সেটা করব না’। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, অবস্থা ঠিক আগের মতোই—বিচারব্যবস্থার অপব্যাবহার, দোসর বলে হত্যাযোগ্য বা গ্রেপ্তারযোগ্য করে তোলা, মত প্রকাশে আঘাত।
তবে একটা জায়গায় ঐক্য দেখা যায়, দুঃখের সঙ্গে মানতে হয়: নারী বিদ্বেষের জায়গায়। আগে আরেকটু ধামাচাপা দেওয়া ছিল, এখন প্রকাশ্যেই নারীকে হেনস্তা করা যায়। সব কিছুই জায়েজ। নারীর পোশাক: ওড়না হোক বা টিপ বা বোরখা। স্লাট-শেমিং ও মরাল পুলিশিং। ট্রলিং, সাইবার বুলিং, জনপরিসরে নারীদের গালি দেওয়া, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নিপীড়নকারীদের ক্ষমতায়ন, নিরাপত্তাহীনতা। তালিকা বেশ দীর্ঘ—এবং চলমান।
৬.
তবে আমাদের এই সাংস্কৃতিক বিভাজন আকাশ থেকে পড়েনি। এর পেছনে রয়েছে আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ। অবশ্যই আমাদের এই কারণগুলো স্বীকার করতে হবে। শ্রেণি-রাজনীতি বা ‘ক্লাস-পলিটিক্স’ দেখতে হবে।
আমরা এখন বুঝতে পারছি, দারিদ্র্য দূরীকরণে আমরা ধর্মকে সমাধান হিসেবে ব্যবহার করে আসছি। আমরা আসলে কী আশা করেছিলাম?
আমাদের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর, তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ওপর। গ্রামীণ অঞ্চলে সামাজিক পরিবর্তন দেখেছি—ভাঙা পরিবারের রূপে, রক্ষণশীল আদর্শ আমদানি হওয়ার মাধ্যমে। লালনের গানও আর শুনি না গ্রামে। যাত্রা উঠে গেছে। আমরা শ্রমিকের কাছ থেকে ছিনতাই করে নিয়েছি তাঁদের শ্রম, বিনিময়ে দিয়েছি ধর্ম। গরিব বাচ্চাদের কী হবে? তাঁদের জন্য করে দেওয়া হলো মাদ্রাসা। তারপরই তো এই শ্রেণিকে সুন্দর বাইনারিতে ফেলা যায়। তাদের বলা যায়—জঙ্গি।
৭.
গার্মেন্টসের ওপর দেশ চলে। কিন্তু শ্রমিকের দায়িত্ব কেউ নেয় না। এখানে কাজ করতে আসা মায়েদের বাচ্চা রেখে আসতে হয় গ্রামে। দিনমান খাটতে হয়। এ কারণে মারধর খেতে হয় বাড়িতে। সব মিলিয়ে বিচ্ছিন্ন পরিবার তৈরি করেছি আমরা। নিরাপত্তা দিতে পারিনি। আবার নারীদের যখন নিরাপত্তার কারণে বোরখা পরতে হয়েছে, আমরাই বলেছি, ‘সব ধার্মিক হয়ে গেছে।’ কিন্তু পোশাকের রাজনীতি তো অত সরল নয়।
সাধারণভাবে আমরা কখনো বোঝার চেষ্টা করিনি দেশে রূপান্তরগুলো কেন হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ঠিক এই পরিস্থিতিই টিকিয়ে রাখতে চায়। কারণ, বিভক্ত ও দুর্বল শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ করা সহজ।
যখন দেশের সাধারণ মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, ধর্ম বা সংস্কৃতির নামে তাঁদের উসকে দেওয়া খুব সহজ। আজকের ‘মব’ তারই প্রকৃষ্ট উদহারণ। তাহলে এই গভীর সংকট থেকে আমাদের মুক্তির পথ কী?
প্রথমত, আত্মজিজ্ঞাসা ও অন্তর্ভুক্তি। যারা আমরা নিজেদের ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রগতিশীল বলে দাবি করি, নিজেদের দিকেও আমাদের তাকাতে হবে। আমরা কী আমাদের নিজেদের অজান্তেই বায়াসড? শ্রেণিগত ঘৃণা পোষণ করি? সবাইকে নিয়ে পথ চলার মানসিকতা আমাদের আছে তো?
আগে আমাদের এই সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ইনক্লুসিভ পলিটিক্স নিয়ে কথা বলতে হবে। যদি এ প্রসঙ্গে কথা বলি, তবে এটিও আমাদের ভাবা জরুরি যে আমরা সবাইকে গণনায় নিয়েছি তো?
৮.
আমাদের সংগ্রাম আসলে দ্বিমুখী। আমাদের একই সঙ্গে দুটি লড়াই চালাতে হবে। একদিকে, এখন ডানপন্থার যে দমনমূলক ও বিভেদকামী রাজনীতি, তার বিরুদ্ধে আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে লড়তে হবে। নারীর স্বাধীনতা, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার প্রশ্নে কোনো আপোষ করা চলবে না। অন্যদিকে, যে সাধারণ মানুষ দারিদ্র্য বা রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণে রক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, আমাদের যেতে হবে তাদের কাছেও। সংবেদনশীলতা দিয়ে তাদের সমস্যাগুলো বুঝতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সংহতি গড়ে তুলতে হবে।
সেদিন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জুলাই উদযাপন অনুষ্ঠানে গান হলো, ‘মদিনা’র পথে আমরা, রসুলের পথে—এই থিমে। এর সঙ্গে শুনলাম, ‘মেক সাম ফ*** সাউন্ড’। পুরোটাই একভাবে আরোপিত লেগেছে, একটু কটুও হয়তো। কিন্তু এমন যখন বলছি, তখন আবার এটিও ভাবছি যে এ-ও তো শুদ্ধ সংগীতের প্রতি আমার নিজের বায়াসনেস। কিন্তু রাজনৈতিক জায়গা থেকে যা বোঝা দরকার তা হলো, ধর্মের গান তো এমনই সীমাবদ্ধ হবে, ঠিক যেভাবে জাতীয়তাবাদ সীমাবদ্ধ।
এসবের নিদান হিসেবে আমার যা মনে হয় তা হলো, সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার আসলে মানসম্মত পাবলিক বা সরকারি শিক্ষা। আমাদের সমস্যার মূলে রয়েছে শিক্ষার অভাব ও বৈষম্য। আমরা যদি দেশের প্রতিটি শিশুর জন্য একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক এবং বিনামূল্যে মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি, তবেই দীর্ঘমেয়াদে এই সাংস্কৃতিক বিভাজন দূর করা সম্ভব। একজন শিক্ষিত নাগরিক তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, সে ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝে এবং তাকে ধর্মের নামে বা সংস্কৃতির নামে সহজে বিভ্রান্ত করা যায় না।
কিন্তু শ্রমিকদের ‘পৃথিবীর সবচেয়ে অদক্ষ শ্রমিক’—এমন তকমা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে কেন? মানসম্মত শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ পেলে এই শ্রমিকেরাই দেশের সবচেয়ে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হতে পারেন। একজন শিক্ষিত, সচেতন শ্রমিক শুধু নিজের মজুরির জন্য লড়াই করেন না, তিনি পুরো ব্যবস্থার পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন। আর এই যে ভাবনা, এটি অবশ্যই আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়। আসলে এটিই পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে। তখন ধর্ম বেচে স্বপ্ন বা ভয় কোনটাই আর কাজ করবে না—কোনো পক্ষেই।
লেখক: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক
আমরা প্রায়ই ‘ঐক্য’ শব্দটি শুনি—ঐকমত্য কমিশনের কাছে, রাজনৈতিক মঞ্চে, দলের কাছে, নিজেদের মধ্যেও। জুলাই-পরবর্তী সময়ে বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলি সবাই। জুলাইয়ের ঐক্য ধরে রাখার কথা বলি। কিন্তু খুনের প্রতিবাদ করা তো আসলে ওয়ান-টাইম ঐক্য। এই ঐক্যের দৌড় কত দূর?
ঐক্য কি আসলেই কোনো সমাধান দিচ্ছে? নাকি আজকের বিভাজিত সমাজে বিভেদের ক্ষতকে আরও গভীর করছে? আজকের বাংলাদেশে, যেখানে আমরা আওয়ামী বাইনারির উল্টো দিকে অবস্থান করছি, আমাদের নানা রকম ট্যাগ দিয়ে হেনস্তা, এমনকি হত্যা মামলাও দেওয়া হচ্ছে; অর্থাৎ বিশ্বাসের জায়গা নেই বললেই চলে। এই বাস্তবতায় ঐক্য আসলে কতটা সম্ভব? এই ঐক্য কার স্বার্থে? এর মানেই বা কি? আমার মনে হয়, ‘ঐক্য’ শব্দটি আমরা ব্যবহার করি বটে, তবে কথা বলি ভিন্ন ভাষায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বুঝিবার বা বুঝাইবার’ সমস্যা ও সংকট লেগেই থাকে।
২.
এখানে একটি প্রশ্ন তোলা যাক, সংস্কৃতি আসলে কী?
শিল্পচর্চার জায়গা থেকে সংস্কৃতি হলো ‘কালচার অ্যাজ পারফর্ম্যান্স’। গান, নাচ, নাটক, সাহিত্য, চিত্রকলা, পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী ইত্যাদি। এই সংস্কৃতি আমাদের গর্বের জায়গা। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা এই সংস্কৃতির মাধ্যমেই নিজেদের পরিচয় তুলে ধরি। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সংস্কৃতি অনেক সময়ই মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, থেকেছে; এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাপন থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করে। উদহারণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশে শুধু সিনেমাকে তৈরি করা হয়েছে গরিব মানুষের বিনোদন হিসেবে; এবং সেই অজুহাতে অখাদ্য সিনেমা তৈরি হয়েছে, হয়ও; অবস্থা এমন, যেন গরিবের রুচি খুব খারাপ। ভাবেন, কী শ্রেণি-ঘৃণা থাকলে এমনটা সম্ভব! আমরা ধরেই নিয়েছি, গরিব মানুষ ‘উচ্চপর্যায়ের’ সংস্কৃতি বুঝবে না। আমরা তো জানি কথাটা কত ভুল।
মাস চারেক আগে গুলশানের শাহাবুদ্দিন পার্কে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করলাম আমরা। এখানে বেশির ভাগ মানুষ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন শ্রমিকশ্রেণির। রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গেই তো তাঁরা নাচলেন, গলা মিলালেন, হাততালি দিলেন। তখন আমার মনে হলো, আমরা ওদের দূরে রাখব আর বলব ওরা চায় না, কী অদ্ভুত ব্যাপার! বলব, ওরা কেবল ওয়াজ শুনতে যেতে চায়। ওয়াজ শুনলে কোনোই অসুবিধা নেই, কিন্তু ওয়াজ ছাড়া যদি ওদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা না থাকে, তাহলে তা তো সমস্যার।
এরই উল্টো পিঠে আজ এই যে আমার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনায় একজন লিখে দিল, আমি ‘র’-এর এজেন্ট, আমি নাকি ভুলে গেছি ভারতীয় আধিপত্যের কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। কথা হলো, ভারতীয় আধিপত্য নিয়ে আমারই তো কাজ আছে, কিন্তু সেটা বললে তো আর ‘র’-এর বলা যাবে না (নাকি যাবে?)। কিন্তু এই যে রবীন্দ্রনাথকে ভারতের সঙ্গে মিলিয়ে দিল! রবীন্দ্রনাথও যেন র-এর এজেন্ট! আগে সবাই ছিল ‘আই এস আই’য়ের। এখন ‘র’-এর। তাহলে প্রতিরোধের ঐক্য কীভাবে হবে? যেখানে আমরা অপরপক্ষকে সবসময় খারিজ করে দিতে চাই?
৩.
সেদিন দ্রোহযাত্রার একবছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আমরা গান গাইতে দাঁড়ালাম: ‘ধনধান্য পুষ্পভরা...সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি…।’—আবারও জাতীয়বাদী ধারণায় মুক্তি খোঁজা।
পরের গান, ‘সামনে পড়ে আছে বুলেটবিদ্ধ লাশ/ ...রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই নিতে হয়।’ আবারও সেই প্রতিহিংসা, লাশের রাজনীতি। যে কথা লাশ বলেনি, লাশের মুখে সে কথা জোরপূর্বক ঢুকিয়ে দেওয়া। ক্লাস-অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন!
আমরা যাঁরা ভাবি, আমরা এই বাইনারির বাইরে—আমরাও যদি এভাবে ভাবি, তবে মুক্তির পথ তো ঠিক দেখা যায় না। ঐক্য এক্ষেত্রে যেন অন্যপক্ষকে দমন করে তৈরি করার ডাক। কখনো তা দমন-পীড়নকেও বৈধ্যতা দেয়। এ ব্যাপারগুলো আসলে সমস্যাজনক।
সেদিন শিক্ষক নেটওয়ার্কের আলাপে, একজন প্রভাষক খুব সুন্দর একটা ক্রিটিক্যাল অবজারভেশন দিলেন। কিন্তু তার আগে ক্ষমা চেয়ে নিলেন এই ভেবে যে এখানে বড়রা আছেন, তাঁর কথা পাছে বেয়াদবের মতো শোনায়। এই উঁচু-নিচুর হায়ারার্কি আমরাই ভাঙতে পারছি না, নিজেদের মধ্যেও না, ঐক্য তাহলে কীভাবে হবে?
৪.
এখন জীবনযাপনের সংস্কৃতি ‘কালচার অ্যাজ আ ওয়ে অব লাইফ’ নিয়ে দু-চার কথা। বলা যায়, এটিই সংস্কৃতির আসল ও বৃহত্তর রূপ। আমরা কী খাই, কী পরি, কীভাবে কথা বলি, আমাদের বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, পারিবারিক সম্পর্ক—এসব কিছুই জীবনযাপনের সংস্কৃতির অংশ। এই সংস্কৃতি স্থির নয়, প্রতিনিয়ত এটি বদলায়। আর এখানেই আমাদের বিভাজনগুলো সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
‘শুদ্ধ’ বাঙালি সংস্কৃতি কী জিনিস? সেকুলার-বামদের প্রতি এই এক অভিযোগ। ভাষা হোক বা সংগীত, ‘শুদ্ধতা’ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা সংস্কৃতিকে যেমন একরোখা করে দিয়েছে, তেমনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করেছে। ফলে আজকে আমরা দেখছি জীবনযাপন, বিশ্বাস, পোশাকের রাজনীতি—নানা ক্ষেত্রে প্রতিরোধ হিসেবে উঠে আসছে উগ্রবাদ। মেয়েদের ওড়নাও এখন ইস্যু হয়ে ওঠে।
৫.
এবার ঐক্যের সংকট ও ডানপন্থার উত্থান নিয়ে কিছু বলা যাক।
যখন একটি সমাজ এতটা গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে যায়, ‘ঐক্য’ শব্দটি তখন কিন্তু বিপজ্জনকও হয়ে ওঠে। কারণ, তখন ঐক্যের আহ্বানকে মনে হতে পারে, ‘আমার মতো হও, আমার বিশ্বাস মেনে নাও, আমার সংস্কৃতি গ্রহণ করো, তবেই আমরা এক হতে পারব।’ এটি আসলে ঐক্য নয়, আত্মসমর্পণের আহ্বান। ঠিক দ্রোহযাত্রার ওই গানের লাইনের মতো, ‘মুক্তির জন্য এই শেষ যুদ্ধ, শান্তির জন্য এই শেষ যুদ্ধ।’
ইদানীং আবার সবচেয়ে নিচু মানদণ্ডের বিষয়-আশয়ও দেখতে পাই। যেমন ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারীর সংসদীয় আসন নিয়ে যে ঐক্য—যা থেকে আবার ইসলামি দলগুলো বাদ—এমন ঐক্য দিয়ে কী হবে?
অগ্রগতির পথ তো দেখছি না।
বিভাজনের রাজনীতির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমরা আজ এমন সরল-সহজ ঐক্যও দেখি না যে ‘হাসিনা যা করেছে আমরা সেটা করব না’। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, অবস্থা ঠিক আগের মতোই—বিচারব্যবস্থার অপব্যাবহার, দোসর বলে হত্যাযোগ্য বা গ্রেপ্তারযোগ্য করে তোলা, মত প্রকাশে আঘাত।
তবে একটা জায়গায় ঐক্য দেখা যায়, দুঃখের সঙ্গে মানতে হয়: নারী বিদ্বেষের জায়গায়। আগে আরেকটু ধামাচাপা দেওয়া ছিল, এখন প্রকাশ্যেই নারীকে হেনস্তা করা যায়। সব কিছুই জায়েজ। নারীর পোশাক: ওড়না হোক বা টিপ বা বোরখা। স্লাট-শেমিং ও মরাল পুলিশিং। ট্রলিং, সাইবার বুলিং, জনপরিসরে নারীদের গালি দেওয়া, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নিপীড়নকারীদের ক্ষমতায়ন, নিরাপত্তাহীনতা। তালিকা বেশ দীর্ঘ—এবং চলমান।
৬.
তবে আমাদের এই সাংস্কৃতিক বিভাজন আকাশ থেকে পড়েনি। এর পেছনে রয়েছে আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ। অবশ্যই আমাদের এই কারণগুলো স্বীকার করতে হবে। শ্রেণি-রাজনীতি বা ‘ক্লাস-পলিটিক্স’ দেখতে হবে।
আমরা এখন বুঝতে পারছি, দারিদ্র্য দূরীকরণে আমরা ধর্মকে সমাধান হিসেবে ব্যবহার করে আসছি। আমরা আসলে কী আশা করেছিলাম?
আমাদের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর, তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ওপর। গ্রামীণ অঞ্চলে সামাজিক পরিবর্তন দেখেছি—ভাঙা পরিবারের রূপে, রক্ষণশীল আদর্শ আমদানি হওয়ার মাধ্যমে। লালনের গানও আর শুনি না গ্রামে। যাত্রা উঠে গেছে। আমরা শ্রমিকের কাছ থেকে ছিনতাই করে নিয়েছি তাঁদের শ্রম, বিনিময়ে দিয়েছি ধর্ম। গরিব বাচ্চাদের কী হবে? তাঁদের জন্য করে দেওয়া হলো মাদ্রাসা। তারপরই তো এই শ্রেণিকে সুন্দর বাইনারিতে ফেলা যায়। তাদের বলা যায়—জঙ্গি।
৭.
গার্মেন্টসের ওপর দেশ চলে। কিন্তু শ্রমিকের দায়িত্ব কেউ নেয় না। এখানে কাজ করতে আসা মায়েদের বাচ্চা রেখে আসতে হয় গ্রামে। দিনমান খাটতে হয়। এ কারণে মারধর খেতে হয় বাড়িতে। সব মিলিয়ে বিচ্ছিন্ন পরিবার তৈরি করেছি আমরা। নিরাপত্তা দিতে পারিনি। আবার নারীদের যখন নিরাপত্তার কারণে বোরখা পরতে হয়েছে, আমরাই বলেছি, ‘সব ধার্মিক হয়ে গেছে।’ কিন্তু পোশাকের রাজনীতি তো অত সরল নয়।
সাধারণভাবে আমরা কখনো বোঝার চেষ্টা করিনি দেশে রূপান্তরগুলো কেন হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ঠিক এই পরিস্থিতিই টিকিয়ে রাখতে চায়। কারণ, বিভক্ত ও দুর্বল শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ করা সহজ।
যখন দেশের সাধারণ মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, ধর্ম বা সংস্কৃতির নামে তাঁদের উসকে দেওয়া খুব সহজ। আজকের ‘মব’ তারই প্রকৃষ্ট উদহারণ। তাহলে এই গভীর সংকট থেকে আমাদের মুক্তির পথ কী?
প্রথমত, আত্মজিজ্ঞাসা ও অন্তর্ভুক্তি। যারা আমরা নিজেদের ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রগতিশীল বলে দাবি করি, নিজেদের দিকেও আমাদের তাকাতে হবে। আমরা কী আমাদের নিজেদের অজান্তেই বায়াসড? শ্রেণিগত ঘৃণা পোষণ করি? সবাইকে নিয়ে পথ চলার মানসিকতা আমাদের আছে তো?
আগে আমাদের এই সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ইনক্লুসিভ পলিটিক্স নিয়ে কথা বলতে হবে। যদি এ প্রসঙ্গে কথা বলি, তবে এটিও আমাদের ভাবা জরুরি যে আমরা সবাইকে গণনায় নিয়েছি তো?
৮.
আমাদের সংগ্রাম আসলে দ্বিমুখী। আমাদের একই সঙ্গে দুটি লড়াই চালাতে হবে। একদিকে, এখন ডানপন্থার যে দমনমূলক ও বিভেদকামী রাজনীতি, তার বিরুদ্ধে আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে লড়তে হবে। নারীর স্বাধীনতা, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার প্রশ্নে কোনো আপোষ করা চলবে না। অন্যদিকে, যে সাধারণ মানুষ দারিদ্র্য বা রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণে রক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, আমাদের যেতে হবে তাদের কাছেও। সংবেদনশীলতা দিয়ে তাদের সমস্যাগুলো বুঝতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সংহতি গড়ে তুলতে হবে।
সেদিন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জুলাই উদযাপন অনুষ্ঠানে গান হলো, ‘মদিনা’র পথে আমরা, রসুলের পথে—এই থিমে। এর সঙ্গে শুনলাম, ‘মেক সাম ফ*** সাউন্ড’। পুরোটাই একভাবে আরোপিত লেগেছে, একটু কটুও হয়তো। কিন্তু এমন যখন বলছি, তখন আবার এটিও ভাবছি যে এ-ও তো শুদ্ধ সংগীতের প্রতি আমার নিজের বায়াসনেস। কিন্তু রাজনৈতিক জায়গা থেকে যা বোঝা দরকার তা হলো, ধর্মের গান তো এমনই সীমাবদ্ধ হবে, ঠিক যেভাবে জাতীয়তাবাদ সীমাবদ্ধ।
এসবের নিদান হিসেবে আমার যা মনে হয় তা হলো, সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার আসলে মানসম্মত পাবলিক বা সরকারি শিক্ষা। আমাদের সমস্যার মূলে রয়েছে শিক্ষার অভাব ও বৈষম্য। আমরা যদি দেশের প্রতিটি শিশুর জন্য একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক এবং বিনামূল্যে মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি, তবেই দীর্ঘমেয়াদে এই সাংস্কৃতিক বিভাজন দূর করা সম্ভব। একজন শিক্ষিত নাগরিক তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, সে ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝে এবং তাকে ধর্মের নামে বা সংস্কৃতির নামে সহজে বিভ্রান্ত করা যায় না।
কিন্তু শ্রমিকদের ‘পৃথিবীর সবচেয়ে অদক্ষ শ্রমিক’—এমন তকমা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে কেন? মানসম্মত শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ পেলে এই শ্রমিকেরাই দেশের সবচেয়ে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হতে পারেন। একজন শিক্ষিত, সচেতন শ্রমিক শুধু নিজের মজুরির জন্য লড়াই করেন না, তিনি পুরো ব্যবস্থার পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন। আর এই যে ভাবনা, এটি অবশ্যই আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়। আসলে এটিই পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে। তখন ধর্ম বেচে স্বপ্ন বা ভয় কোনটাই আর কাজ করবে না—কোনো পক্ষেই।
লেখক: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাঁদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তাঁরা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাতচল্লিশের সেই দেশভাগ বা পার্টিশনের প্রভাব এখনো বহন করে চলেছি আমরা। একে কোনো একরৈখিক বয়ানে বেঁধে ফেলা দুষ্কর।
৬ ঘণ্টা আগেনব্বইয়ের ক্লান্তি কিংবা বার্ধক্য-জরায় যতীন স্যার কখনোই নিঃসঙ্গতায় ছিলেন না। বাংলার প্রাকৃতজনের দার্শনিক জ্ঞান ও শান্তির দ্রোণাচার্য যতীন সরকার জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাতপাই, রামকৃষ্ণ রোডের 'বানপ্রস্থ' নামের বাড়িতে মানুষের সান্নিধ্যেই থাকতেন।
১ দিন আগেতারেক মাসুদ নামটি খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ কাজ নয়। আমি তাঁর ছাত্র, অনুসারী, সহযোগী বা উত্তরসূরি হলেও অন্য অনেকের মতোই আমিও তাঁকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম। কিন্তু এই ভাই ডাকার অভ্যস্ততা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এত গভীরে প্রোত্থিত যে আনুষ্ঠানিক কারণেও শুধু নামটি উচ্চারণে আমার অস্বস্তি হয়।
১ দিন আগেমাত্র ২৮ বছরের তরুণ ছিলেন আল-জাজিরার ফিলিস্তিনি প্রতিবেদক আনাস আল শরীফ। স্পষ্টতার সঙ্গে তুলে ধরতেন ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার অমানবিক রূপ। তাঁর প্রতিবেদনে প্রাণহীন শুষ্ক তথ্য ছাড়িয়ে উঠে আসত অবরুদ্ধ জীবনের নিখাদ ও অনাবৃত প্রতিচ্ছবি।
২ দিন আগে