জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পার হয়ে গেলো। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এক বছর পূর্ণ করেছে। নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষিত হয়েছে। এই সময়ে এসে আমরা গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণা করছি, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাবনিকাশ করছি। অন্তবর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
অভিনু কিবরিয়া ইসলাম
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পার হয়ে গেলো। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এক বছর পূর্ণ করেছে। নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষিত হয়েছে। এই সময়ে এসে আমরা গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণা করছি, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাবনিকাশ করছি। অন্তবর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
এক বছর পর এসে কেউ এই গণ-অভ্যুত্থানকে ‘বেহাত বিপ্লব’ বলছেন। কেউ বলছেন, সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। কেউ কেউ মব সন্ত্রাস, দক্ষিণপন্থীদের উত্থান, সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তির নানা হস্তক্ষেপের কারণে নানামাত্রিক আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কেউ আবার রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোর কিছু সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ ও ঐকমত্যকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের হিস্যা নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলো একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে। অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচার আবার রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এইসব ডামাডোলে মূল প্রশ্নটিই হারিয়ে যাচ্ছে। এত রক্তপাত, এত আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে গণ-অভ্যুত্থান রচিত হলো, সেই আত্মত্যাগের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটি কি অগ্রসর করা সম্ভব হয়েছে?
এটা ঠিক যে গত বছর জুলাই জাগরণে কোনো একক ইশতেহার দেখে মানুষ রাস্তায় নামেনি। রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী মানুষের নানামাত্রিক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল বটে, কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনের পতনই ছিল আশু লক্ষ্য। জনগণের সামনে ছিল না কোনো বিপ্লবী কর্মসূচি, কোনো মূর্ত রাজনৈতিক এজেন্ডা। মানুষ সাময়িক যে লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছিল, স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী শাসকের পতনের মধ্য দিয়ে তা অর্জিত হয়েছিল।
এমনকি স্বৈরাচারের পতনের পর ক্ষমতা-প্রশ্নের কি হবে, সে-বিষয়ক কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ছাড়াই মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। সে অর্থে মানুষ কোনো রাজনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভর না করে নিজেই সক্রিয় কর্তাসত্তা হয়ে তার আশু লক্ষ্য আদায় করে নিয়েছিল। যাঁরা নেমেছিলেন, তাঁরা ভুল বুঝে নামেননি, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যেই নেমেছিলেন; নামার অর্থ হচ্ছে সেই স্বৈরাচারী শাসকের পতনকে বেগবান করা; তা নিয়ে কোনো সংশয় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ছিল না। কিন্তু শাসকের পতনের পর ক্ষমতায় কারা আসবে, কোন প্রক্রিয়ায় আসবে, কোন পথে আগামীর বাংলাদেশ চলবে, তা নিয়ে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে কোনো পূর্বনির্ধারিত নির্দিষ্ট ঐকমত্য ছিল না বলে মনে হয়।
বছর ঘুরলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই কনসেন্সাস তৈরি হয়নি—হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক হতো। তবে মোটাদাগে গণমানুষের মধ্যে—বিশেষত ছাত্র-তরুণদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী অবস্থান থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল, যার নিদর্শন আমরা পাই বিভিন্ন স্লোগান ও গ্রাফিতিতে। এই বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার কথা রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো সবাই কম বেশি স্বীকার করলেও, সেই ধরনের রাষ্ট্রের মূর্তরূপ কেমন হবে তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ভয়ানক ভিন্নমত আছে। কিছু কিছু মত এতই বিপরীতমুখী যে তাতে আশু সমাধানের কোনো উপায় নেই।
এই ভিন্নমত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, গণতান্ত্রিক সমাজে মতামতের এই বৈচিত্র্য কাম্যও বটে। কিন্তু সংকট হলো, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রয়নের প্রশ্নগুলোর সমাধানের ক্ষেত্রে এই পর্যায়ে এসে জনগণ আর কর্তাসত্তার ভূমিকায় থাকতে পারছে না।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী, সিভিল মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি, দেশি-বিদেশি নানা ইন্টারেস্ট গ্রুপ এখন সক্রিয় তাদের মতো করে জুলাইয়ের বয়ান তৈরি করতে এবং তার মাধ্যমে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় নিজেদের হিস্যা নিশ্চিত করতে। এখানেই আসছে প্রতিবিপ্লব বা বেহাত বিপ্লবের প্রশ্ন। ব্যাপকতর জনগণ কর্তাসত্তা হয়ে উঠে স্বৈরাচারকে ক্ষমতাচ্যুত করল ঠিকই, কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্নে তাদের আকাঙ্ক্ষা বা অভিপ্রায় কি প্রতিফলিত হচ্ছে?
আমাদের রাজনীতিতে নানা মত ও বয়ান হাজির থাকলেও, এই কথা বলা যেতে পারে যে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন সময়ের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশের গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এ যাবৎকালের কোনো ‘সরকার’ সত্যিকারের ‘গণতান্ত্রিক’ উপায়ে দেশকে পরিচালনা করেনি বা করতে পারেনি। বাংলাদেশে নির্বাচিত, অনির্বাচিত, জালিয়াতি করে ‘নির্বাচিত’, সেনাসমর্থিত, সরাসরি সামরিক শাসন, রাষ্ট্রপতিশাসিত, প্রধানমন্ত্রীশাসিত—বিভিন্ন ধরনের সরকার আমরা দেখেছি।
আমাদের সংবিধানেও অনেকবার কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। আর সেসব করা হয়েছে কখনো অধ্যাদেশের মাধ্যমে, কখনো-বা ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। কিন্তু সেই সংশোধনীগুলো জনগণের মতামত, আকাঙ্ক্ষা বা অভিপ্রায়ের প্রকৃত প্রতিফলন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এমনকি গণভোটের নামে যে হ্যাঁ/না ভোট হয়েছিল, তার ফলাফলেই স্পষ্ট যে তাতে সবার মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেনি। আবার দীর্ঘদিন ধরে আমরা ভোটাধিকার বঞ্চিত থাকায়, ভোটাধিকারকেই আমরা অনেকে গণতন্ত্রের সমার্থক মনে করছি।
ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারা গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত তো বটেই, এই ন্যূনতম অধিকারকে নিশ্চিত তো করতেই হবে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে এটিও ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনই গণতন্ত্রের শেষ কথা নয়। অপেক্ষাকৃত ‘ভালো নির্বাচন’-এ বিজয়ী রাজনৈতিক দলও সরকার গঠন করে অগণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে, তা করেছেও। এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই জুলাই-পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় আমরা কতটুকু এগিয়েছি, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার।
গণতন্ত্র মানে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রান্তিক স্বরগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করাও গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রশ্নের সঙ্গে তাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে অন্তত নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে জাতিগত, ধর্মীয়, লিঙ্গীয়, শ্রেণিগত বৈষম্য নিরসনের প্রশ্ন। এই নাগরিক অধিকারকে নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে তুললেই চলে না, বৈষম্য নিরসনের প্রয়োজনে ইতিবাচক বৈষম্যও করতে হয়, প্রান্তস্থিত স্বরগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হয়। এই প্রশ্নকে সামনে না আনতে পারলে সংবিধানের যতই কাটাছেঁড়া করা হোক না কেন, রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোগত পরিচালনার ক্ষেত্রে যতই ঐকমত্য স্থাপিত হোক না কেন, সংবিধানের মূলনীতিতে যাই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করে তোলা সম্ভব নয়।
দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিক শাসনের অনিবার্য অভিঘাতে সমাজদেহে জাতিবাদী ও বৈষম্যমূলক যে বয়ানগুলো বাসা বেঁধেছে, তার বিপরীতে অন্যান্য বয়ান তৈরির কাজ রাষ্ট্র সরাসরি করবে না ঠিকই, কিন্তু সেই বৈষম্যবিরোধী বয়ান যখন সমাজের ভেতর থেকেই গড়ে ওঠে, তখন তার বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অথচ জুলাইয়ের পরেও আমরা দেখেছি জাতিবাদী ও বৈষম্যবাদী বিভিন্ন বয়ানের সমর্থনে এবং পেশিশক্তির জোরে প্রান্তিক স্বরগুলোকে দমন করার চেষ্টার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বরং বর্তমান সরকারের স্টেকহোল্ডার হিসেবে যাদের আমরা দেখছি, তাদের অনেকেই অগণতান্ত্রিক পন্থায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দমনের চেষ্টা করেছেন। যখন বিভিন্ন স্থানে মব সন্ত্রাস চালানো হয়েছে, মাজার ভাঙা হয়েছে, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে হামলা করা হয়েছে, নারীদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে, মোরাল পুলিশিং করা হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে জুলাই-পরবর্তী সরকারের ব্যর্থতা ও ক্ষেত্রবিশেষে উদাসীনতা হতাশাজনক। এই পরিস্থিতির মধ্যেও রাষ্ট্রের ‘সংস্কার’ প্রশ্নটি এই এক বছরে বারবার সামনে এসেছে।
জুলাই-পরবর্তী সময়ে শাসনব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করছে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনাবিষয়ক কিছু আলাপ-আলোচনা যে মানুষের সামনে আসছে তা ইতিবাচকরূপে দেখা যেতে পারে। তবে রাষ্ট্রপরিচালনায় উপরকাঠামোগত কিছু সংস্কারের প্রশ্নেই এই আলাপ সীমাবদ্ধ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান যেহেতু কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ জনগণের সামাজিক বিপ্লব নয়, সুতরাং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল রূপান্তর এই পরিস্থিতিতে সম্ভবপর নয়—সেই বিষয়টিও নিশ্চয়ই বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষই বুঝবেন। কিন্তু রাষ্ট্রের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য যে গণমানুষের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যেসব গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন, সে প্রসঙ্গগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একেবারেই অনুল্লেখিত থেকেছে।
শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন হয়নি, শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ কেমন হওয়া উচিত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে গড়ে তোলা যায়, এ বিষয় উপেক্ষিত থেকেছে। প্রান্তিক মানুষ কীভাবে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে, সে লক্ষ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারের আলোচনা সামনে আসেনি।
শ্রমজীবী মানুষের ন্যূনতম অধিকার ও মজুরি নিশ্চিত করা, ব্যাপকতর জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, কৃষিক্ষেত্রে কৃষকবান্ধব সংস্কার করা, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় আধিপত্যশীল রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক দাদাগিরি ও মোড়লিপনার বিপরীতে জাতীয় স্বার্থে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি আমরা এখনো জানতে পারিনি।
এই বিষয়গুলোকে আলোচনার বাইরে রেখে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর করা সম্ভব কিনা এই আলাপকেও আমরা সামনে আনতে পারিনি। অর্থনৈতিকভাবে, শ্রেণিগতভাবে যখন এক বিশাল জনগোষ্ঠী পিছিয়ে থাকে, রাষ্ট্র যখন ব্যাপকতর জনগোষ্ঠীর নাগরিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না, যখন তাদের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা থাকে না, যখন সকল জনগোষ্ঠীর বিকাশের ন্যূনতম সুযোগ রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে না, তখন উপরিকাঠামোর কিছু সংস্কার করে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর কীভাবে সম্ভব?
অন্তবর্তীকালীন সরকার এই প্রশ্নগুলোর সমাধান করতে পারবে না, তার সেই সুযোগও নেই। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলো যে মোটাদাগে অনুল্লেখিতই থেকে গেলো সে আলাপ আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে তো নয়ই, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের মধ্যেও জোরেসোরে উঠতে দেখলাম না।
সমাজ ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান বৈষম্যগুলোকে বজায় রেখে কিংবা বৈষম্য নিরসনের কর্মসূচিকে সামনে না এনে কেউ যদি প্রত্যাশা করেন যে জনগণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘কর্তাসত্তা’ হয়ে উঠে তার অভিপ্রায় বা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্র গঠনের ‘গাঠনিক ক্ষমতা’র প্রয়োগ ঘটাতে পারবে, তাহলে সেই ভাবনা কতটুকু বাস্তবসম্মত সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
পুরোনো ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণ ‘নতুন বন্দোবস্ত’ করার মতো বিপ্লব বা অভ্যুত্থান বাংলাদেশে হয়নি। সেটা করতে হলে সে ধরনের কর্মসূচিভিত্তিক কার্যক্রমে জনগণের সক্রিয় সমর্থন ও সংগঠিত প্রয়াস প্রয়োজন।
‘নতুন বন্দোবস্ত’ কথাটিকে আমরা যদি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর হিসেবে ব্যাখ্যা করি, তাহলে সেই রূপান্তরের সংগ্রামকে বিজয়ী করতে হলে আমাদের এখনো বহু পথ হাঁটতে হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো এই কাজটি সম্পন্ন করে যেতে পারবে না; তাদের কাছে এ প্রত্যাশা করাও সম্ভব নয়।
এই সরকার কিছু উপরিকাঠামোগত সংস্কার করার ব্যাপারে একটা ঐকমত্য তৈরি করে নির্বাচন দেবে—এরকমই আলামত দেখা যাচ্ছে। এই পর্বে অন্ততপক্ষে ভোটাধিকার এবং ন্যূনতম গণতান্ত্রিক কিছু প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও যদি আমরা সফল হতে পারি, তাহলে সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য প্রকৃত ‘বৈষম্যবিরোধী’ কর্মসূচিকে এখন থেকেই সামনে আনা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সে কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করতে আরও বহুপথ হাঁটতে হবে আমাদের।
লেখক: শিক্ষক, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পার হয়ে গেলো। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এক বছর পূর্ণ করেছে। নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষিত হয়েছে। এই সময়ে এসে আমরা গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণা করছি, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাবনিকাশ করছি। অন্তবর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
এক বছর পর এসে কেউ এই গণ-অভ্যুত্থানকে ‘বেহাত বিপ্লব’ বলছেন। কেউ বলছেন, সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। কেউ কেউ মব সন্ত্রাস, দক্ষিণপন্থীদের উত্থান, সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তির নানা হস্তক্ষেপের কারণে নানামাত্রিক আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কেউ আবার রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোর কিছু সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ ও ঐকমত্যকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের হিস্যা নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলো একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে। অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচার আবার রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এইসব ডামাডোলে মূল প্রশ্নটিই হারিয়ে যাচ্ছে। এত রক্তপাত, এত আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে গণ-অভ্যুত্থান রচিত হলো, সেই আত্মত্যাগের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটি কি অগ্রসর করা সম্ভব হয়েছে?
এটা ঠিক যে গত বছর জুলাই জাগরণে কোনো একক ইশতেহার দেখে মানুষ রাস্তায় নামেনি। রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী মানুষের নানামাত্রিক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল বটে, কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনের পতনই ছিল আশু লক্ষ্য। জনগণের সামনে ছিল না কোনো বিপ্লবী কর্মসূচি, কোনো মূর্ত রাজনৈতিক এজেন্ডা। মানুষ সাময়িক যে লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছিল, স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী শাসকের পতনের মধ্য দিয়ে তা অর্জিত হয়েছিল।
এমনকি স্বৈরাচারের পতনের পর ক্ষমতা-প্রশ্নের কি হবে, সে-বিষয়ক কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ছাড়াই মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। সে অর্থে মানুষ কোনো রাজনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভর না করে নিজেই সক্রিয় কর্তাসত্তা হয়ে তার আশু লক্ষ্য আদায় করে নিয়েছিল। যাঁরা নেমেছিলেন, তাঁরা ভুল বুঝে নামেননি, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যেই নেমেছিলেন; নামার অর্থ হচ্ছে সেই স্বৈরাচারী শাসকের পতনকে বেগবান করা; তা নিয়ে কোনো সংশয় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ছিল না। কিন্তু শাসকের পতনের পর ক্ষমতায় কারা আসবে, কোন প্রক্রিয়ায় আসবে, কোন পথে আগামীর বাংলাদেশ চলবে, তা নিয়ে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে কোনো পূর্বনির্ধারিত নির্দিষ্ট ঐকমত্য ছিল না বলে মনে হয়।
বছর ঘুরলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই কনসেন্সাস তৈরি হয়নি—হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক হতো। তবে মোটাদাগে গণমানুষের মধ্যে—বিশেষত ছাত্র-তরুণদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী অবস্থান থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল, যার নিদর্শন আমরা পাই বিভিন্ন স্লোগান ও গ্রাফিতিতে। এই বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার কথা রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো সবাই কম বেশি স্বীকার করলেও, সেই ধরনের রাষ্ট্রের মূর্তরূপ কেমন হবে তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ভয়ানক ভিন্নমত আছে। কিছু কিছু মত এতই বিপরীতমুখী যে তাতে আশু সমাধানের কোনো উপায় নেই।
এই ভিন্নমত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, গণতান্ত্রিক সমাজে মতামতের এই বৈচিত্র্য কাম্যও বটে। কিন্তু সংকট হলো, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রয়নের প্রশ্নগুলোর সমাধানের ক্ষেত্রে এই পর্যায়ে এসে জনগণ আর কর্তাসত্তার ভূমিকায় থাকতে পারছে না।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী, সিভিল মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি, দেশি-বিদেশি নানা ইন্টারেস্ট গ্রুপ এখন সক্রিয় তাদের মতো করে জুলাইয়ের বয়ান তৈরি করতে এবং তার মাধ্যমে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় নিজেদের হিস্যা নিশ্চিত করতে। এখানেই আসছে প্রতিবিপ্লব বা বেহাত বিপ্লবের প্রশ্ন। ব্যাপকতর জনগণ কর্তাসত্তা হয়ে উঠে স্বৈরাচারকে ক্ষমতাচ্যুত করল ঠিকই, কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্নে তাদের আকাঙ্ক্ষা বা অভিপ্রায় কি প্রতিফলিত হচ্ছে?
আমাদের রাজনীতিতে নানা মত ও বয়ান হাজির থাকলেও, এই কথা বলা যেতে পারে যে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন সময়ের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশের গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এ যাবৎকালের কোনো ‘সরকার’ সত্যিকারের ‘গণতান্ত্রিক’ উপায়ে দেশকে পরিচালনা করেনি বা করতে পারেনি। বাংলাদেশে নির্বাচিত, অনির্বাচিত, জালিয়াতি করে ‘নির্বাচিত’, সেনাসমর্থিত, সরাসরি সামরিক শাসন, রাষ্ট্রপতিশাসিত, প্রধানমন্ত্রীশাসিত—বিভিন্ন ধরনের সরকার আমরা দেখেছি।
আমাদের সংবিধানেও অনেকবার কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। আর সেসব করা হয়েছে কখনো অধ্যাদেশের মাধ্যমে, কখনো-বা ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। কিন্তু সেই সংশোধনীগুলো জনগণের মতামত, আকাঙ্ক্ষা বা অভিপ্রায়ের প্রকৃত প্রতিফলন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এমনকি গণভোটের নামে যে হ্যাঁ/না ভোট হয়েছিল, তার ফলাফলেই স্পষ্ট যে তাতে সবার মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেনি। আবার দীর্ঘদিন ধরে আমরা ভোটাধিকার বঞ্চিত থাকায়, ভোটাধিকারকেই আমরা অনেকে গণতন্ত্রের সমার্থক মনে করছি।
ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারা গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত তো বটেই, এই ন্যূনতম অধিকারকে নিশ্চিত তো করতেই হবে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে এটিও ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনই গণতন্ত্রের শেষ কথা নয়। অপেক্ষাকৃত ‘ভালো নির্বাচন’-এ বিজয়ী রাজনৈতিক দলও সরকার গঠন করে অগণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে, তা করেছেও। এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই জুলাই-পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় আমরা কতটুকু এগিয়েছি, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার।
গণতন্ত্র মানে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রান্তিক স্বরগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করাও গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রশ্নের সঙ্গে তাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে অন্তত নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে জাতিগত, ধর্মীয়, লিঙ্গীয়, শ্রেণিগত বৈষম্য নিরসনের প্রশ্ন। এই নাগরিক অধিকারকে নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে তুললেই চলে না, বৈষম্য নিরসনের প্রয়োজনে ইতিবাচক বৈষম্যও করতে হয়, প্রান্তস্থিত স্বরগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হয়। এই প্রশ্নকে সামনে না আনতে পারলে সংবিধানের যতই কাটাছেঁড়া করা হোক না কেন, রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোগত পরিচালনার ক্ষেত্রে যতই ঐকমত্য স্থাপিত হোক না কেন, সংবিধানের মূলনীতিতে যাই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করে তোলা সম্ভব নয়।
দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিক শাসনের অনিবার্য অভিঘাতে সমাজদেহে জাতিবাদী ও বৈষম্যমূলক যে বয়ানগুলো বাসা বেঁধেছে, তার বিপরীতে অন্যান্য বয়ান তৈরির কাজ রাষ্ট্র সরাসরি করবে না ঠিকই, কিন্তু সেই বৈষম্যবিরোধী বয়ান যখন সমাজের ভেতর থেকেই গড়ে ওঠে, তখন তার বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অথচ জুলাইয়ের পরেও আমরা দেখেছি জাতিবাদী ও বৈষম্যবাদী বিভিন্ন বয়ানের সমর্থনে এবং পেশিশক্তির জোরে প্রান্তিক স্বরগুলোকে দমন করার চেষ্টার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বরং বর্তমান সরকারের স্টেকহোল্ডার হিসেবে যাদের আমরা দেখছি, তাদের অনেকেই অগণতান্ত্রিক পন্থায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দমনের চেষ্টা করেছেন। যখন বিভিন্ন স্থানে মব সন্ত্রাস চালানো হয়েছে, মাজার ভাঙা হয়েছে, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে হামলা করা হয়েছে, নারীদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে, মোরাল পুলিশিং করা হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে জুলাই-পরবর্তী সরকারের ব্যর্থতা ও ক্ষেত্রবিশেষে উদাসীনতা হতাশাজনক। এই পরিস্থিতির মধ্যেও রাষ্ট্রের ‘সংস্কার’ প্রশ্নটি এই এক বছরে বারবার সামনে এসেছে।
জুলাই-পরবর্তী সময়ে শাসনব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করছে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনাবিষয়ক কিছু আলাপ-আলোচনা যে মানুষের সামনে আসছে তা ইতিবাচকরূপে দেখা যেতে পারে। তবে রাষ্ট্রপরিচালনায় উপরকাঠামোগত কিছু সংস্কারের প্রশ্নেই এই আলাপ সীমাবদ্ধ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান যেহেতু কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ জনগণের সামাজিক বিপ্লব নয়, সুতরাং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল রূপান্তর এই পরিস্থিতিতে সম্ভবপর নয়—সেই বিষয়টিও নিশ্চয়ই বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষই বুঝবেন। কিন্তু রাষ্ট্রের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য যে গণমানুষের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যেসব গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন, সে প্রসঙ্গগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একেবারেই অনুল্লেখিত থেকেছে।
শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন হয়নি, শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ কেমন হওয়া উচিত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে গড়ে তোলা যায়, এ বিষয় উপেক্ষিত থেকেছে। প্রান্তিক মানুষ কীভাবে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে, সে লক্ষ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারের আলোচনা সামনে আসেনি।
শ্রমজীবী মানুষের ন্যূনতম অধিকার ও মজুরি নিশ্চিত করা, ব্যাপকতর জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, কৃষিক্ষেত্রে কৃষকবান্ধব সংস্কার করা, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় আধিপত্যশীল রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক দাদাগিরি ও মোড়লিপনার বিপরীতে জাতীয় স্বার্থে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি আমরা এখনো জানতে পারিনি।
এই বিষয়গুলোকে আলোচনার বাইরে রেখে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর করা সম্ভব কিনা এই আলাপকেও আমরা সামনে আনতে পারিনি। অর্থনৈতিকভাবে, শ্রেণিগতভাবে যখন এক বিশাল জনগোষ্ঠী পিছিয়ে থাকে, রাষ্ট্র যখন ব্যাপকতর জনগোষ্ঠীর নাগরিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না, যখন তাদের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা থাকে না, যখন সকল জনগোষ্ঠীর বিকাশের ন্যূনতম সুযোগ রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে না, তখন উপরিকাঠামোর কিছু সংস্কার করে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর কীভাবে সম্ভব?
অন্তবর্তীকালীন সরকার এই প্রশ্নগুলোর সমাধান করতে পারবে না, তার সেই সুযোগও নেই। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলো যে মোটাদাগে অনুল্লেখিতই থেকে গেলো সে আলাপ আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে তো নয়ই, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের মধ্যেও জোরেসোরে উঠতে দেখলাম না।
সমাজ ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান বৈষম্যগুলোকে বজায় রেখে কিংবা বৈষম্য নিরসনের কর্মসূচিকে সামনে না এনে কেউ যদি প্রত্যাশা করেন যে জনগণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘কর্তাসত্তা’ হয়ে উঠে তার অভিপ্রায় বা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্র গঠনের ‘গাঠনিক ক্ষমতা’র প্রয়োগ ঘটাতে পারবে, তাহলে সেই ভাবনা কতটুকু বাস্তবসম্মত সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
পুরোনো ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণ ‘নতুন বন্দোবস্ত’ করার মতো বিপ্লব বা অভ্যুত্থান বাংলাদেশে হয়নি। সেটা করতে হলে সে ধরনের কর্মসূচিভিত্তিক কার্যক্রমে জনগণের সক্রিয় সমর্থন ও সংগঠিত প্রয়াস প্রয়োজন।
‘নতুন বন্দোবস্ত’ কথাটিকে আমরা যদি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর হিসেবে ব্যাখ্যা করি, তাহলে সেই রূপান্তরের সংগ্রামকে বিজয়ী করতে হলে আমাদের এখনো বহু পথ হাঁটতে হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো এই কাজটি সম্পন্ন করে যেতে পারবে না; তাদের কাছে এ প্রত্যাশা করাও সম্ভব নয়।
এই সরকার কিছু উপরিকাঠামোগত সংস্কার করার ব্যাপারে একটা ঐকমত্য তৈরি করে নির্বাচন দেবে—এরকমই আলামত দেখা যাচ্ছে। এই পর্বে অন্ততপক্ষে ভোটাধিকার এবং ন্যূনতম গণতান্ত্রিক কিছু প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও যদি আমরা সফল হতে পারি, তাহলে সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য প্রকৃত ‘বৈষম্যবিরোধী’ কর্মসূচিকে এখন থেকেই সামনে আনা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সে কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করতে আরও বহুপথ হাঁটতে হবে আমাদের।
লেখক: শিক্ষক, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাঁদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তাঁরা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাতচল্লিশের সেই দেশভাগ বা পার্টিশনের প্রভাব এখনো বহন করে চলেছি আমরা। একে কোনো একরৈখিক বয়ানে বেঁধে ফেলা দুষ্কর।
৬ ঘণ্টা আগেনব্বইয়ের ক্লান্তি কিংবা বার্ধক্য-জরায় যতীন স্যার কখনোই নিঃসঙ্গতায় ছিলেন না। বাংলার প্রাকৃতজনের দার্শনিক জ্ঞান ও শান্তির দ্রোণাচার্য যতীন সরকার জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাতপাই, রামকৃষ্ণ রোডের 'বানপ্রস্থ' নামের বাড়িতে মানুষের সান্নিধ্যেই থাকতেন।
১ দিন আগেতারেক মাসুদ নামটি খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ কাজ নয়। আমি তাঁর ছাত্র, অনুসারী, সহযোগী বা উত্তরসূরি হলেও অন্য অনেকের মতোই আমিও তাঁকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম। কিন্তু এই ভাই ডাকার অভ্যস্ততা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এত গভীরে প্রোত্থিত যে আনুষ্ঠানিক কারণেও শুধু নামটি উচ্চারণে আমার অস্বস্তি হয়।
১ দিন আগেমাত্র ২৮ বছরের তরুণ ছিলেন আল-জাজিরার ফিলিস্তিনি প্রতিবেদক আনাস আল শরীফ। স্পষ্টতার সঙ্গে তুলে ধরতেন ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার অমানবিক রূপ। তাঁর প্রতিবেদনে প্রাণহীন শুষ্ক তথ্য ছাড়িয়ে উঠে আসত অবরুদ্ধ জীবনের নিখাদ ও অনাবৃত প্রতিচ্ছবি।
২ দিন আগে