ক্লাইমেট চেঞ্জ, ভ্যাক্সিন, পৃথিবী গোল, মানুষ চাঁদে গেছে আরো নানা কিছু আমরা ছোটবেলা থেকে ‘বৈজ্ঞানিক সত্য’ বা হার্ড ট্রুথ হিসেবে জানি, কিন্তু কেউ কেউ তা মানে না। কেন? এরা কি শুধুই কন্সপিরেসি থিওরিস্ট? তর্ক না ভালোবাসা, কী দিয়ে এদের ‘ভালো করে দেওয়া’ যাবে? বিজ্ঞানকে না বলার বৈজ্ঞানিক কারণ কী?
আদ্রিতা কবির
‘এই পোস্টে বিজ্ঞান কোথায়?’ থেকে ‘এটাই সাইন্স’, —সোশাল মিডিয়ার কমেন্ট সেকশনে ঘোরাঘুরি করলে আপনার মনে হবে মানুষের বিজ্ঞানে কঠিন ঈমান আছে। যা কিছু সায়েন্টিফিক তা কিছুই সে বিশ্বাস করে, বাকি সব কিছুকে ‘শু শু’ করে তাড়িয়ে দেয়।
তবে এই ধারণা ভাঙবে ফেসবুকে এক মিলিয়ন মেম্বারের ‘রুকাইয়াহ সাপোর্ট গ্রুপ’ - এ গেলে। কালা জাদু থেকে ফাঁড়া কাটানো, বাটিচালান থেকে ইফ্রিত জ্বীনের খামচি হ্যান কোনো ইস্যু নাই যেইটার ‘সত্যতা’ নিয়ে মানুষ পোস্ট দিচ্ছে না এবং কয়েকশো কমেন্টে বাকিরাও ‘আমার সাথেও হইছে ভাই’ বলছে না।
আবার ফেসবুকের আরেক প্রান্তে আছে ‘ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান’ ওরফে বিসিবির মত গ্রুপ। মেম্বার সংখ্যা সেখানেও নেহাত কম না–আড়াই লাখের বেশি। এখানে সবাই উত্তর খুঁজছে এবং দিচ্ছে। কেন রাতে দেয়ালের ভেতর থেকে টুকটুক শব্দ হয়, কীভাবে গরু ভিগান হয়েও মোটা, মোবাইল নেটওয়ার্ক শরীরের ভেতর দিয়ে চলাচল করার সময় শরীর ছিদ্র হয়ে যায় না কেন ইত্যাদি।
প্রশ্ন হল, এই দুই গ্রুপের মানুষ কি একেবারেই আলাদা? একদল জগতের সব কিছুতে রহস্য খুঁজে পাচ্ছে, আরেকদল যাবতীয় রহস্যের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে? আসলেই কি তাই?
বৈজ্ঞানিক ভাবনায় কি বিশ্বাস নাই? বিশ্বাসে কি বিজ্ঞান নাই? কোনটা সত্য, কোনটা অসত্য - কে কীভাবে বাছাই করে? কেন বারবার আমরা ট্রিগারড হয়ে বলি যে, ‘ভাই একজন শিক্ষিত লোক হয়েও আপনি কীভাবে হ্যানত্যান (ফিল ইন দ্যা গ্যাপ করেন ভূত, প্রেত, ভাগ্য, হোমিওপ্যাথি, প্রেম থেকে শুরু করে যেকোনো ‘অবৈজ্ঞানিক’ ঘটনা বা থিওরি দিয়ে) -এ বিশ্বাস করেন?’
মোটিভেটেড রিজনিং: সত্যের চেয়ে স্বস্তি বড়
সাইকোলজির একটা টার্ম মোটিভেটেড রিজনিং। এইটা বোঝার জন্য আগে মস্তিষ্ক ও মন দুইটা তেলজলের মত সেপারেট জিনিস - এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। র্যাশনালিটি আর ইমোশন কাশ্মিরের মত। বহু লোক এই দুইটার মধ্যে লাইন টানার চেষ্টা করছে বা করে যাচ্ছে কিন্তু তাতে গ্যাঞ্জাম ছাড়া খুব বেশি কিছু হচ্ছে না। এই বিচ্ছেদবাদী লোকদের গুরু ছিলেন ‘আই থিংক দেয়ারফর আই অ্যাম’ খ্যাত রেনে দেকার্তে। ১৭ দশকে তিনি জন্ম দেন বিখ্যাত ‘কার্তেসিয়ান স্প্লিট’-এর যেখানে শরীর আর মন পুরা ভিন্ন দুই জিনিস। শরীর পদার্থ তাই এটা পদার্থবিজ্ঞানের যাবতীয় নিয়ম মেনে চলা সায়েন্টিফিক বস্তু আর মন হইলো অ্যাবস্ট্রাক্ট ফিলোসফিকাল সত্ত্বা। এই প্রথম সেপারেশন থেকে তিনি দ্বিতীয় সেপারেশন আনেন লজিক আর ইমোশনের মধ্যে। লজিককে তিনি দেখেন মনপুরার মত বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ হিসেবে যার কোনো ইমোশনাল বা বায়োলজিকাল আঁতাত নাই।
কিন্তু বাস্তবে এমনটা হয় না। সহজভাবে ভাবেন। আপনি একটা শিকারী প্রাণীর উত্তরসূরী যাকে সারাক্ষণ বায়োলজিকাল চাহিদায় সাড়া দিয়ে খাবারের সন্ধানে যেতে হয় এবং চারপাশে বিপদের মাত্রা মাপতে হয়। এরপর সেই অনুযায়ী বুঝেশুনে ডিসিশন নিতে হয় যে আপনার নেক্সট মুভ কী হবে। আপনার রিজনিং গভীরভাবে প্র্যাগম্যাটিক; বায়োলজি আর এনভায়রমেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোনো বোধিলাভের কারণে প্রাপ্ত অ্যাবস্ট্রাক্ট লজিকাল থিংকিং না। ভাবনা শরীর এবং পরিবেশ থেকে আলগা কিছু না।
ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের পলিটিকাল সায়েন্টিস্ট আর্থার লুপিয়া বলেন, এই যে আদি সারভাইভালের ‘ফ্লাইট অর ফাইট রেসপন্স’ এটা আমরা এখনকার বাস্তবতায় প্রেডেটরদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে না পারলেও, তথ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। ভীতিকর তথ্য যা আমার বা আমার স্পিসির সারভাইভালের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে, যেমন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ পৃথিবী ডুবে যাবে - এমন কিছু দেখলে আমরা এই তথ্যকে প্রেডেটরসম ভাবি। এরপর কেউ ফাইট মোডে গিয়ে গভীরভাবে এই তথ্যে ঈমাণ এনে এক্টিভিজম করে, কেউ ফ্লাইটে গিয়ে ঠিক করে এসব কথা ভুয়া, কিছু ডুববে না, কেউ মরবে না, সব মার্কিন ডেমোক্র্যাটদের কন্সপিরেসি!
বিপদে পড়লে বা বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করলে এভাবে লজিক-ইমোশন-ইমপালসের খিচুড়ি হওয়াই স্বাভাবিক। আর এর সাথেই তৈরি হয় বাহাসের কাঁচামাল ‘বায়াস’।
দ্রুতচিন্তাকরা বনাম ধীইইরেএএ সুউউস্থেএএ চিইইনতাআআ করাআআ
অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ড্যানিয়েল কানম্যানের বিখ্যাত বই ‘থিংকিং ফাস্ট অ্যান্ড স্লো’। বেঙ্গলবইয়ের শেলফ থেকে নীলক্ষেতের ফুটপাথ সবখানে এই বইয়ের দেখা মিলে, ফারাক খালি অরিজিনাল আর বুটলেগ ভার্সনে। এত জনপ্রিয় এই বইয়ের মূল জায়গা হল মানুষ কীভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
এক্কেবারে রিডিউস করে যদি এই প্রশ্নের উত্তর দিই তাহলে দুইভাবে:
১. তাত্তাড়ি: চারিদিকের পরিস্থিতি দেখে তৎক্ষণাৎ যেই ইম্পালস তৈরি হয় সেই ইম্পালসের ভিত্তিতে বা সোজাভাবে বললে ইনটুইটিভলি।
২. স্লোওওওলি: ধর ‘তত্ত্ব’, মার পেরেক– স্টাইলে না গিয়ে কোনো তথ্য বা পরিস্থিতি নিয়ে আস্তেধীরে ভেবে, বারবার ফ্যাক্টচেক করে, সব যুক্তির দু’পাশ দেখে।
প্রথম পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছালে মানুষ বায়াসের দিকে বেশি ঝুঁকে। কারণ সে পরিস্থিতি দেখে যেহেতু গাট ফিলিং অনুসরণ করে তাই সে মূলত কড়া নাড়ে তার পূর্ব অভিজ্ঞতার দুয়ারে। আগে অমুকটা হয়েছিল বা তমুক তথ্য দেখে আমার এমন ফিলিং হয়েছিল কাজেই এইবারও এমনই হবে– এই কনক্লুশনে সে লংজাম্প মারে। এই মেন্টাল শর্টকাট হল প্যাটার্ন রেকগনিশন। এটা অগুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ধরেন আগুনে হাত দিয়ে আপনি আগে ব্যথা পেয়েছেন এটা আপনার মনে আছে, আপনি এটা রিকল করে পরেরবার আগুনে হাত দিবেন না – এটাই প্যাটার্ন রিকগনিশন। কিন্তু ক্রিটিকাল চিন্তায় এটা বাঁধ সাধতে পারে।
নতুন বৈজ্ঞানিক কোনো আবিষ্কার বা রাজনৈতিক আইডিয়া আপনার পরিচিত প্যাটার্নে না পড়লে আপনি তাকে খারিজ করতে পারেন হয় অকার্যকর নাহয় ভয়ানক ভেবে। যেমন, বার্নি স্যান্ডার্স ‘বামঘেঁষা’ শুনেই আপনার মাথায় অ্যালার্ম বাজবে ‘রেড টেরর’-এর। স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল সায়েন্টিস্ট চার্লস টেবার বলেন, ‘আপনি এইভাবে আপনার আগের বিশ্বাসকেই রিস্ট্যাব্লিশ করেন এবং নানারকম খারিজির মাধ্যমে বাহাসে যুক্ত হন।’
আমাদের মস্তিষ্ক কি বিজ্ঞানী নাকি উকিল?
ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং বিখ্যাত লেখক জনাথান হাইড ‘রিজনিং’ এবং ‘র্যাশনালাইজিং’-কে দুটি ভিন্ন জিনিস হিসেবে দেখেন। রিজনিং হলো যুক্তি দিয়ে বিচার করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, র্যাশনালাইজিং হল একটা সিদ্ধান্ত সবকিছু বিচার করার আগেই নিয়ে ফেলা এবং তারপর তাকে জাস্টিফাই করার জন্য যুক্তি প্রডিউস করা।
ধরেন, একজন আওয়ামী লীগের এ টিমের ভক্ত। সে তাদের পোস্ট দেখে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে যাবে না যে অমুকখানে কী ঘটছে বাস্তবে। বরং ভাববে যে তমুক কারণে এটা ঘটে থাকলে তার আওয়ামী বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয় এবং তার লজিক সিস্টেমে চাপ পড়ে না কাজেই নিশ্চয়ই সেটাই ঘটছে যা এ টিম বলছে। এর থেকে জারেক তিয়া ভক্তকূল, ইউসুফ সরকার ফ্যানবয়েজ, সার্ভিস আলমের অনুরাগীগণ, কঠিন রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট– কেউই খুব ব্যতিক্রম না। সবাই নিজের মতামতকে পুনঃস্থাপন করে এবং পলিটিকাল আইডিওলজিকে আরো পাকাপোক্ত করে এমন কথাই শুনতে চায়, এমন লেন্সেই ঘটনাকে দেখতে চায়। এটাই র্যাশনালাইজিং। এভাবেই আমরা তর্কে জেতার চেষ্টা করি। ফলে দুইজন বিপরীত মতের মানুষ তর্ক করা শুরু করলে সেটা কোনোদিকেই আগায় না, দুইজনই র্যাশনালাইজ করে নিজের পজিশনকে।
মোদ্দাকথা, আপনার ব্রেইন ওকালতি করে আপনার চিন্তার পক্ষেই। ‘কনফার্মেশন বায়াস’ বা যা ‘দেখতে চাই তাই দেখি’– দিয়ে সে দেখে গোটা জগতকে। ব্যক্তিগত পরিসরও এর বাইরে কিছু না। আমার বউ আমার উপর চিট করে– ভাবলে আপনি সবখানেই তার চিটিং এর চিহ্ন খুঁজে পাবেন, সে ফোনে কারোর সাথে স্বাভাবিক গলায় কথা বললেও লাগবে সে ফিসফিস করছে, সে নরমাল সময়ে বাসায় আসলেও মনে হবে দেরি করে আসছে, তার পরিচিত পারফিউমকে মনে হবে পুরুষালি ডিওড্রেন্ট। আবার আপনার বউ যদি আসলেই চিট করে কিন্তু আপনি সেটা মনে না করেন তাহলে তার লুকাছুপি আচরণকেও আপনার স্বাভাবিক বলে মনে হবে।
জীবন একটি সামাজিক সিনেমা
ইয়েল ল স্কুলের অধ্যাপক ডান কাহান বলছেন মানুষ কেমন সমাজে বা কালচারে বেড়ে উঠেছে তার ওপরও তার রিজনিং বা বিশ্বাস নির্ভর করে। অবভিয়াস কথা, তবে তাতে এর মাজেজা কমে না। কাহানের হিসাবে মানুষকে দুইবার চিন্তাভাবনার দিক থেকে ভাগ করা যায়। প্রথমবার চিন্তায় ফারাক আসে সে কি ব্যক্তিকেন্দ্রীক সমাজে বড় হয়ে উঠেছে নাকি কমিউনিটেরিয়ান বা কমিউনিটি কেন্দ্রীক সমাজে তার ওপর। দ্বিতীয়বার আমরা মানুষের চিন্তাকে আলাদা করতে পারি সে কি হায়ারার্কিকাল (ক্ষমতার ক্রম মেনে চলা) সমাজে বড় হয়েছে নাকি এজালিটারিয়ান (মেজরিটির কল্যাণবাদী) সমাজে - এর ভিত্তিতে। নিউ ইয়র্কের মত কজমোপলিটানে বড় হওয়া আমেরিকান লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের অনেকে যেমন পড়বে এজালিটারিয়ান ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট ক্যাটাগরিতে। অ্যাবরশন রাইটসের ক্ষেত্রে যেমন তাদের পজিশন ‘হার বডি, হার চয়েস’। মানে ব্যক্তির শরীরে ব্যক্তি বাদে কারোর চয়েস নেই অর্থাৎ ব্যাক্তিকেন্দ্রীক পজিশন আবার এটা সব নারীর জন্য প্রযোজ্য মানে এজালিটেরিয়ান পজিশন। গুজরাটের কট্টোর বিজেপিপন্থী একজন আবার বিশ্বাস করতে পারে যে পুরা ভারতে গরু খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। সে ব্যক্তিকে আলাদা করে দেখে না, পুরা ভারতের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে চায়–অর্থাৎ কমিউনাল। আবার তার বিশ্বাস মাইনরিটিদের খাদ্যাভ্যাস আমলে নেয় না, মানে মেজরিটির ধর্মকে সবার উপরে স্থান দেয়– কাজেই হায়ারার্কিকাল।
এইভাবে চিন্তার প্যাটার্ন তৈরি এবং পাকাপোক্ত হয়। সেটা চ্যালেঞ্জড হলে ঐযে এতক্ষণ যে কাসুন্দী বললাম সেটা হয় – ফাস্ট থিংকিং, কনফারমেশন বায়াস ইত্যাদি।
মিডিয়া ট্রায়াল (অ্যান্ড এরর)
এত সব বায়াসের সুযোগ নিয়ে আপনাকে আপনি যা বুঝতে চান তা-ই বুঝিয়ে ভিউ কামায় মিডিয়া। ফক্স নিউজ বলবে ইসরায়েল ভালো, আল জাজিরা বলবে খারাপের খারাপ। জো রোগান বলবে ক্লাইমেট চেঞ্জ ভুয়া, দ্য গার্ডিয়ান বলবে এরচেয়ে সত্য আর কিছু নাই। আপনি আবার এই মিডিয়াকে এভিডেন্স হিসেবে ধরে ঝগড়া করবেন আরেকজনকের সাথে যে অপোজিট ওপিনিয়ন বিক্রি করা আরেক মিডিয়াগ্রুপকে ফলো করে। সে আপনাকে পাল্টা ‘প্রমাণ’ দেখাবে। আপনারা কেউই জিতবেন না, জিতবে আপনাদের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রোভাইডার এবং মিডিয়া হাউজগুলা (যেগুলো এই লেট ক্যাপিটালিস্ট যুগে এক মালিকেরও হতে পারে)।
এইটা সব যুগেই হতো অবশ্যই আপনি এটা বলতে পারেন। কিন্তু সব যুগে কন্টেন্ট এবং মিডিয়া হাউজের পরিমাণ এত বেশি ছিল না। এখন ইনফরমেশন (পড়ুন মিসইনফরমেশন) ওভারলোডের যুগ। আপনি যেই তথ্য শুনতে চান সেটা আরো রঙচঙ-উস্কানিসমেত ভয়াবহ স্পিডে আপনার দিকে ধাবিত হবে। আপনি দিবেন শেয়ার, করবেন অভ্রপোস্টিং, আপনার নিজ হাতে বাছাই করা ফ্রেন্ডলিস্ট আপনাকে বলবে, সহমত ভাই। ইংরেজিতে লিখলে পাবেন একরকম রিঅ্যাকশন, বাংলায় লিখলে আরেক। সবকিছু আপনি মানুষের অ্যালগরিদমকে মাথায় রেখে ডিজাইন করতে পারবেন। আপনি মিডিয়ার টার্গেট, আবার আপনিই টার্গেটকারি মিডিয়া।
তারপর আপনারই কিছুদিন পর দুঃখ হবে, মানুষ এত বিভক্ত কেন?
লাগে না, লাগে না জোড়া?
এখন প্রশ্ন, দুই ভাগ হয়ে যাওয়া মানুষরা কি কখনো একে অপরের পয়েন্ট বুঝবে না? কোনো তর্কেই কি সঠিক তথ্য দিয়ে কাউকে কনভিন্স করা সম্ভব না?
আবার ফেরত যাই ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কাহানের গবেষণায়। একটা এক্সপেরিমেন্টে কাহান আর তার টিম ক্লাইমেট চেঞ্জের বেসিক সাইন্স সমেত দুইটা ফেক নিউজপেপার রিপোর্ট বানায়। শিরোনাম ভিন্ন, রিপোর্টের মালমশলা এক।
শিরোনাম - ১: সায়েন্টিফিক প্যানেলের মতে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবেলার উপায় সব রকম পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা
শিরোনাম - ২: সায়েন্টিফিক প্যানেলের মতে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবেলার উপায় হতে পারে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার
এই দুই শিরোনামের একই রিপোর্ট নিয়ে তারা ভিন্ন ভিন্ন আইডিওলজির নাগরিকদের পড়ালেন যারা এই গবেষণার আদ্যোপান্ত নিয়ে অবহিত না। এই নাগরিকদের মধ্যে হায়ারার্কিকাল ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট কনজারভেটিভ যারা, মোটকথায় যারা ক্ষমতার পক্ষে এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ এক্সিস্ট করে এটা মানতে নারাজ, তারা পর্যন্ত দ্বিতীয় শিরোনামের রিপোর্টটাকে গ্রহণ করল। সেখানে ক্লাইমেট চেঞ্জের বৈজ্ঞানিক কারণকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিল না।
কেন? কারণ এই গ্রুপ যে ওয়ার্ল্ডভিউ ধারণ করে তাকে পুরাপুরি এই শিরোনাম কাউন্টার করে না, বরং কিছুটা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার সর্বরোগের মহাষৌধ– এই ধারণাকে পাকাপোক্ত করা রিপোর্ট দেখে সে ট্রিগার্ড বোধ করে না, তার পুরো চিন্তার ফ্রেমকে এটা ধাক্কা দেয় না। তার আদিম ভয়কে জাগিয়ে তোলে না। গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে একটা ভয়াল বাস্তবতা হিসেবে এখন সে মানতে কিছুটা কম নারাজ কারণ এর সমাধানও উপস্থিত এবং সমাধানটা তার কায়দার সমাধান।
পুরা ব্যাপারটাই ফ্রেমিং।
কাউকে দিয়ে নতুন বা পুরানো সায়েন্টিফিক বা অন্য কোনো তথ্য হজম করাতে চাইলে এমন কন্টেক্সটে সেটা প্রেজেন্ট করতে হবে যেটা তার পরিচিত ও পছন্দের, তার মূল আইডিওলজির অংশ। শুধু এভাবেই ডিফেন্সিভ ইমোশনাল প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
এই যুক্তি শেষ অব্দি টেনে নিলে দাঁড়ায়—কনজারভেটিভরা ক্লাইমেট চেঞ্জ, ভ্যাক্সিন, নারী অধিকার ইত্যাদির আইডিয়া আরো সহজে মেনে নিতে পারে, যদি সেটা কোনো ধর্মীয় বা রক্ষণশীল নেতার কাছ থেকে আসে, যিনি এই আইডিয়াগুলোকে এমন ফ্রেমিং এ সাজান যা তাঁর আইডিওলজির সাথে যায়, এবং যা সাধারণত বিজ্ঞানী বা লিবারেলরা ব্যবহার করেন না।
এখন, তর্কের টিপস অ্যান্ড ট্রিক্স জানার পরও, যদি এত জটিল সামাজিক ও মানসিক জিমন্যাস্টিকস করে তর্কে জিততে ইচ্ছা না করে, তাহলে অস্কার ওয়াইল্ডের মত ভাব নিয়ে বলবেন, শুধুমাত্র ইন্টেলেকচুয়ালি লস্ট বা নির্বোধরাই তর্ক করে!
‘এই পোস্টে বিজ্ঞান কোথায়?’ থেকে ‘এটাই সাইন্স’, —সোশাল মিডিয়ার কমেন্ট সেকশনে ঘোরাঘুরি করলে আপনার মনে হবে মানুষের বিজ্ঞানে কঠিন ঈমান আছে। যা কিছু সায়েন্টিফিক তা কিছুই সে বিশ্বাস করে, বাকি সব কিছুকে ‘শু শু’ করে তাড়িয়ে দেয়।
তবে এই ধারণা ভাঙবে ফেসবুকে এক মিলিয়ন মেম্বারের ‘রুকাইয়াহ সাপোর্ট গ্রুপ’ - এ গেলে। কালা জাদু থেকে ফাঁড়া কাটানো, বাটিচালান থেকে ইফ্রিত জ্বীনের খামচি হ্যান কোনো ইস্যু নাই যেইটার ‘সত্যতা’ নিয়ে মানুষ পোস্ট দিচ্ছে না এবং কয়েকশো কমেন্টে বাকিরাও ‘আমার সাথেও হইছে ভাই’ বলছে না।
আবার ফেসবুকের আরেক প্রান্তে আছে ‘ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান’ ওরফে বিসিবির মত গ্রুপ। মেম্বার সংখ্যা সেখানেও নেহাত কম না–আড়াই লাখের বেশি। এখানে সবাই উত্তর খুঁজছে এবং দিচ্ছে। কেন রাতে দেয়ালের ভেতর থেকে টুকটুক শব্দ হয়, কীভাবে গরু ভিগান হয়েও মোটা, মোবাইল নেটওয়ার্ক শরীরের ভেতর দিয়ে চলাচল করার সময় শরীর ছিদ্র হয়ে যায় না কেন ইত্যাদি।
প্রশ্ন হল, এই দুই গ্রুপের মানুষ কি একেবারেই আলাদা? একদল জগতের সব কিছুতে রহস্য খুঁজে পাচ্ছে, আরেকদল যাবতীয় রহস্যের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে? আসলেই কি তাই?
বৈজ্ঞানিক ভাবনায় কি বিশ্বাস নাই? বিশ্বাসে কি বিজ্ঞান নাই? কোনটা সত্য, কোনটা অসত্য - কে কীভাবে বাছাই করে? কেন বারবার আমরা ট্রিগারড হয়ে বলি যে, ‘ভাই একজন শিক্ষিত লোক হয়েও আপনি কীভাবে হ্যানত্যান (ফিল ইন দ্যা গ্যাপ করেন ভূত, প্রেত, ভাগ্য, হোমিওপ্যাথি, প্রেম থেকে শুরু করে যেকোনো ‘অবৈজ্ঞানিক’ ঘটনা বা থিওরি দিয়ে) -এ বিশ্বাস করেন?’
মোটিভেটেড রিজনিং: সত্যের চেয়ে স্বস্তি বড়
সাইকোলজির একটা টার্ম মোটিভেটেড রিজনিং। এইটা বোঝার জন্য আগে মস্তিষ্ক ও মন দুইটা তেলজলের মত সেপারেট জিনিস - এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। র্যাশনালিটি আর ইমোশন কাশ্মিরের মত। বহু লোক এই দুইটার মধ্যে লাইন টানার চেষ্টা করছে বা করে যাচ্ছে কিন্তু তাতে গ্যাঞ্জাম ছাড়া খুব বেশি কিছু হচ্ছে না। এই বিচ্ছেদবাদী লোকদের গুরু ছিলেন ‘আই থিংক দেয়ারফর আই অ্যাম’ খ্যাত রেনে দেকার্তে। ১৭ দশকে তিনি জন্ম দেন বিখ্যাত ‘কার্তেসিয়ান স্প্লিট’-এর যেখানে শরীর আর মন পুরা ভিন্ন দুই জিনিস। শরীর পদার্থ তাই এটা পদার্থবিজ্ঞানের যাবতীয় নিয়ম মেনে চলা সায়েন্টিফিক বস্তু আর মন হইলো অ্যাবস্ট্রাক্ট ফিলোসফিকাল সত্ত্বা। এই প্রথম সেপারেশন থেকে তিনি দ্বিতীয় সেপারেশন আনেন লজিক আর ইমোশনের মধ্যে। লজিককে তিনি দেখেন মনপুরার মত বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ হিসেবে যার কোনো ইমোশনাল বা বায়োলজিকাল আঁতাত নাই।
কিন্তু বাস্তবে এমনটা হয় না। সহজভাবে ভাবেন। আপনি একটা শিকারী প্রাণীর উত্তরসূরী যাকে সারাক্ষণ বায়োলজিকাল চাহিদায় সাড়া দিয়ে খাবারের সন্ধানে যেতে হয় এবং চারপাশে বিপদের মাত্রা মাপতে হয়। এরপর সেই অনুযায়ী বুঝেশুনে ডিসিশন নিতে হয় যে আপনার নেক্সট মুভ কী হবে। আপনার রিজনিং গভীরভাবে প্র্যাগম্যাটিক; বায়োলজি আর এনভায়রমেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোনো বোধিলাভের কারণে প্রাপ্ত অ্যাবস্ট্রাক্ট লজিকাল থিংকিং না। ভাবনা শরীর এবং পরিবেশ থেকে আলগা কিছু না।
ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের পলিটিকাল সায়েন্টিস্ট আর্থার লুপিয়া বলেন, এই যে আদি সারভাইভালের ‘ফ্লাইট অর ফাইট রেসপন্স’ এটা আমরা এখনকার বাস্তবতায় প্রেডেটরদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে না পারলেও, তথ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। ভীতিকর তথ্য যা আমার বা আমার স্পিসির সারভাইভালের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে, যেমন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ পৃথিবী ডুবে যাবে - এমন কিছু দেখলে আমরা এই তথ্যকে প্রেডেটরসম ভাবি। এরপর কেউ ফাইট মোডে গিয়ে গভীরভাবে এই তথ্যে ঈমাণ এনে এক্টিভিজম করে, কেউ ফ্লাইটে গিয়ে ঠিক করে এসব কথা ভুয়া, কিছু ডুববে না, কেউ মরবে না, সব মার্কিন ডেমোক্র্যাটদের কন্সপিরেসি!
বিপদে পড়লে বা বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করলে এভাবে লজিক-ইমোশন-ইমপালসের খিচুড়ি হওয়াই স্বাভাবিক। আর এর সাথেই তৈরি হয় বাহাসের কাঁচামাল ‘বায়াস’।
দ্রুতচিন্তাকরা বনাম ধীইইরেএএ সুউউস্থেএএ চিইইনতাআআ করাআআ
অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ড্যানিয়েল কানম্যানের বিখ্যাত বই ‘থিংকিং ফাস্ট অ্যান্ড স্লো’। বেঙ্গলবইয়ের শেলফ থেকে নীলক্ষেতের ফুটপাথ সবখানে এই বইয়ের দেখা মিলে, ফারাক খালি অরিজিনাল আর বুটলেগ ভার্সনে। এত জনপ্রিয় এই বইয়ের মূল জায়গা হল মানুষ কীভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
এক্কেবারে রিডিউস করে যদি এই প্রশ্নের উত্তর দিই তাহলে দুইভাবে:
১. তাত্তাড়ি: চারিদিকের পরিস্থিতি দেখে তৎক্ষণাৎ যেই ইম্পালস তৈরি হয় সেই ইম্পালসের ভিত্তিতে বা সোজাভাবে বললে ইনটুইটিভলি।
২. স্লোওওওলি: ধর ‘তত্ত্ব’, মার পেরেক– স্টাইলে না গিয়ে কোনো তথ্য বা পরিস্থিতি নিয়ে আস্তেধীরে ভেবে, বারবার ফ্যাক্টচেক করে, সব যুক্তির দু’পাশ দেখে।
প্রথম পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছালে মানুষ বায়াসের দিকে বেশি ঝুঁকে। কারণ সে পরিস্থিতি দেখে যেহেতু গাট ফিলিং অনুসরণ করে তাই সে মূলত কড়া নাড়ে তার পূর্ব অভিজ্ঞতার দুয়ারে। আগে অমুকটা হয়েছিল বা তমুক তথ্য দেখে আমার এমন ফিলিং হয়েছিল কাজেই এইবারও এমনই হবে– এই কনক্লুশনে সে লংজাম্প মারে। এই মেন্টাল শর্টকাট হল প্যাটার্ন রেকগনিশন। এটা অগুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ধরেন আগুনে হাত দিয়ে আপনি আগে ব্যথা পেয়েছেন এটা আপনার মনে আছে, আপনি এটা রিকল করে পরেরবার আগুনে হাত দিবেন না – এটাই প্যাটার্ন রিকগনিশন। কিন্তু ক্রিটিকাল চিন্তায় এটা বাঁধ সাধতে পারে।
নতুন বৈজ্ঞানিক কোনো আবিষ্কার বা রাজনৈতিক আইডিয়া আপনার পরিচিত প্যাটার্নে না পড়লে আপনি তাকে খারিজ করতে পারেন হয় অকার্যকর নাহয় ভয়ানক ভেবে। যেমন, বার্নি স্যান্ডার্স ‘বামঘেঁষা’ শুনেই আপনার মাথায় অ্যালার্ম বাজবে ‘রেড টেরর’-এর। স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল সায়েন্টিস্ট চার্লস টেবার বলেন, ‘আপনি এইভাবে আপনার আগের বিশ্বাসকেই রিস্ট্যাব্লিশ করেন এবং নানারকম খারিজির মাধ্যমে বাহাসে যুক্ত হন।’
আমাদের মস্তিষ্ক কি বিজ্ঞানী নাকি উকিল?
ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং বিখ্যাত লেখক জনাথান হাইড ‘রিজনিং’ এবং ‘র্যাশনালাইজিং’-কে দুটি ভিন্ন জিনিস হিসেবে দেখেন। রিজনিং হলো যুক্তি দিয়ে বিচার করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, র্যাশনালাইজিং হল একটা সিদ্ধান্ত সবকিছু বিচার করার আগেই নিয়ে ফেলা এবং তারপর তাকে জাস্টিফাই করার জন্য যুক্তি প্রডিউস করা।
ধরেন, একজন আওয়ামী লীগের এ টিমের ভক্ত। সে তাদের পোস্ট দেখে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে যাবে না যে অমুকখানে কী ঘটছে বাস্তবে। বরং ভাববে যে তমুক কারণে এটা ঘটে থাকলে তার আওয়ামী বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয় এবং তার লজিক সিস্টেমে চাপ পড়ে না কাজেই নিশ্চয়ই সেটাই ঘটছে যা এ টিম বলছে। এর থেকে জারেক তিয়া ভক্তকূল, ইউসুফ সরকার ফ্যানবয়েজ, সার্ভিস আলমের অনুরাগীগণ, কঠিন রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট– কেউই খুব ব্যতিক্রম না। সবাই নিজের মতামতকে পুনঃস্থাপন করে এবং পলিটিকাল আইডিওলজিকে আরো পাকাপোক্ত করে এমন কথাই শুনতে চায়, এমন লেন্সেই ঘটনাকে দেখতে চায়। এটাই র্যাশনালাইজিং। এভাবেই আমরা তর্কে জেতার চেষ্টা করি। ফলে দুইজন বিপরীত মতের মানুষ তর্ক করা শুরু করলে সেটা কোনোদিকেই আগায় না, দুইজনই র্যাশনালাইজ করে নিজের পজিশনকে।
মোদ্দাকথা, আপনার ব্রেইন ওকালতি করে আপনার চিন্তার পক্ষেই। ‘কনফার্মেশন বায়াস’ বা যা ‘দেখতে চাই তাই দেখি’– দিয়ে সে দেখে গোটা জগতকে। ব্যক্তিগত পরিসরও এর বাইরে কিছু না। আমার বউ আমার উপর চিট করে– ভাবলে আপনি সবখানেই তার চিটিং এর চিহ্ন খুঁজে পাবেন, সে ফোনে কারোর সাথে স্বাভাবিক গলায় কথা বললেও লাগবে সে ফিসফিস করছে, সে নরমাল সময়ে বাসায় আসলেও মনে হবে দেরি করে আসছে, তার পরিচিত পারফিউমকে মনে হবে পুরুষালি ডিওড্রেন্ট। আবার আপনার বউ যদি আসলেই চিট করে কিন্তু আপনি সেটা মনে না করেন তাহলে তার লুকাছুপি আচরণকেও আপনার স্বাভাবিক বলে মনে হবে।
জীবন একটি সামাজিক সিনেমা
ইয়েল ল স্কুলের অধ্যাপক ডান কাহান বলছেন মানুষ কেমন সমাজে বা কালচারে বেড়ে উঠেছে তার ওপরও তার রিজনিং বা বিশ্বাস নির্ভর করে। অবভিয়াস কথা, তবে তাতে এর মাজেজা কমে না। কাহানের হিসাবে মানুষকে দুইবার চিন্তাভাবনার দিক থেকে ভাগ করা যায়। প্রথমবার চিন্তায় ফারাক আসে সে কি ব্যক্তিকেন্দ্রীক সমাজে বড় হয়ে উঠেছে নাকি কমিউনিটেরিয়ান বা কমিউনিটি কেন্দ্রীক সমাজে তার ওপর। দ্বিতীয়বার আমরা মানুষের চিন্তাকে আলাদা করতে পারি সে কি হায়ারার্কিকাল (ক্ষমতার ক্রম মেনে চলা) সমাজে বড় হয়েছে নাকি এজালিটারিয়ান (মেজরিটির কল্যাণবাদী) সমাজে - এর ভিত্তিতে। নিউ ইয়র্কের মত কজমোপলিটানে বড় হওয়া আমেরিকান লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের অনেকে যেমন পড়বে এজালিটারিয়ান ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট ক্যাটাগরিতে। অ্যাবরশন রাইটসের ক্ষেত্রে যেমন তাদের পজিশন ‘হার বডি, হার চয়েস’। মানে ব্যক্তির শরীরে ব্যক্তি বাদে কারোর চয়েস নেই অর্থাৎ ব্যাক্তিকেন্দ্রীক পজিশন আবার এটা সব নারীর জন্য প্রযোজ্য মানে এজালিটেরিয়ান পজিশন। গুজরাটের কট্টোর বিজেপিপন্থী একজন আবার বিশ্বাস করতে পারে যে পুরা ভারতে গরু খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। সে ব্যক্তিকে আলাদা করে দেখে না, পুরা ভারতের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে চায়–অর্থাৎ কমিউনাল। আবার তার বিশ্বাস মাইনরিটিদের খাদ্যাভ্যাস আমলে নেয় না, মানে মেজরিটির ধর্মকে সবার উপরে স্থান দেয়– কাজেই হায়ারার্কিকাল।
এইভাবে চিন্তার প্যাটার্ন তৈরি এবং পাকাপোক্ত হয়। সেটা চ্যালেঞ্জড হলে ঐযে এতক্ষণ যে কাসুন্দী বললাম সেটা হয় – ফাস্ট থিংকিং, কনফারমেশন বায়াস ইত্যাদি।
মিডিয়া ট্রায়াল (অ্যান্ড এরর)
এত সব বায়াসের সুযোগ নিয়ে আপনাকে আপনি যা বুঝতে চান তা-ই বুঝিয়ে ভিউ কামায় মিডিয়া। ফক্স নিউজ বলবে ইসরায়েল ভালো, আল জাজিরা বলবে খারাপের খারাপ। জো রোগান বলবে ক্লাইমেট চেঞ্জ ভুয়া, দ্য গার্ডিয়ান বলবে এরচেয়ে সত্য আর কিছু নাই। আপনি আবার এই মিডিয়াকে এভিডেন্স হিসেবে ধরে ঝগড়া করবেন আরেকজনকের সাথে যে অপোজিট ওপিনিয়ন বিক্রি করা আরেক মিডিয়াগ্রুপকে ফলো করে। সে আপনাকে পাল্টা ‘প্রমাণ’ দেখাবে। আপনারা কেউই জিতবেন না, জিতবে আপনাদের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রোভাইডার এবং মিডিয়া হাউজগুলা (যেগুলো এই লেট ক্যাপিটালিস্ট যুগে এক মালিকেরও হতে পারে)।
এইটা সব যুগেই হতো অবশ্যই আপনি এটা বলতে পারেন। কিন্তু সব যুগে কন্টেন্ট এবং মিডিয়া হাউজের পরিমাণ এত বেশি ছিল না। এখন ইনফরমেশন (পড়ুন মিসইনফরমেশন) ওভারলোডের যুগ। আপনি যেই তথ্য শুনতে চান সেটা আরো রঙচঙ-উস্কানিসমেত ভয়াবহ স্পিডে আপনার দিকে ধাবিত হবে। আপনি দিবেন শেয়ার, করবেন অভ্রপোস্টিং, আপনার নিজ হাতে বাছাই করা ফ্রেন্ডলিস্ট আপনাকে বলবে, সহমত ভাই। ইংরেজিতে লিখলে পাবেন একরকম রিঅ্যাকশন, বাংলায় লিখলে আরেক। সবকিছু আপনি মানুষের অ্যালগরিদমকে মাথায় রেখে ডিজাইন করতে পারবেন। আপনি মিডিয়ার টার্গেট, আবার আপনিই টার্গেটকারি মিডিয়া।
তারপর আপনারই কিছুদিন পর দুঃখ হবে, মানুষ এত বিভক্ত কেন?
লাগে না, লাগে না জোড়া?
এখন প্রশ্ন, দুই ভাগ হয়ে যাওয়া মানুষরা কি কখনো একে অপরের পয়েন্ট বুঝবে না? কোনো তর্কেই কি সঠিক তথ্য দিয়ে কাউকে কনভিন্স করা সম্ভব না?
আবার ফেরত যাই ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কাহানের গবেষণায়। একটা এক্সপেরিমেন্টে কাহান আর তার টিম ক্লাইমেট চেঞ্জের বেসিক সাইন্স সমেত দুইটা ফেক নিউজপেপার রিপোর্ট বানায়। শিরোনাম ভিন্ন, রিপোর্টের মালমশলা এক।
শিরোনাম - ১: সায়েন্টিফিক প্যানেলের মতে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবেলার উপায় সব রকম পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা
শিরোনাম - ২: সায়েন্টিফিক প্যানেলের মতে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবেলার উপায় হতে পারে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার
এই দুই শিরোনামের একই রিপোর্ট নিয়ে তারা ভিন্ন ভিন্ন আইডিওলজির নাগরিকদের পড়ালেন যারা এই গবেষণার আদ্যোপান্ত নিয়ে অবহিত না। এই নাগরিকদের মধ্যে হায়ারার্কিকাল ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট কনজারভেটিভ যারা, মোটকথায় যারা ক্ষমতার পক্ষে এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ এক্সিস্ট করে এটা মানতে নারাজ, তারা পর্যন্ত দ্বিতীয় শিরোনামের রিপোর্টটাকে গ্রহণ করল। সেখানে ক্লাইমেট চেঞ্জের বৈজ্ঞানিক কারণকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিল না।
কেন? কারণ এই গ্রুপ যে ওয়ার্ল্ডভিউ ধারণ করে তাকে পুরাপুরি এই শিরোনাম কাউন্টার করে না, বরং কিছুটা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার সর্বরোগের মহাষৌধ– এই ধারণাকে পাকাপোক্ত করা রিপোর্ট দেখে সে ট্রিগার্ড বোধ করে না, তার পুরো চিন্তার ফ্রেমকে এটা ধাক্কা দেয় না। তার আদিম ভয়কে জাগিয়ে তোলে না। গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে একটা ভয়াল বাস্তবতা হিসেবে এখন সে মানতে কিছুটা কম নারাজ কারণ এর সমাধানও উপস্থিত এবং সমাধানটা তার কায়দার সমাধান।
পুরা ব্যাপারটাই ফ্রেমিং।
কাউকে দিয়ে নতুন বা পুরানো সায়েন্টিফিক বা অন্য কোনো তথ্য হজম করাতে চাইলে এমন কন্টেক্সটে সেটা প্রেজেন্ট করতে হবে যেটা তার পরিচিত ও পছন্দের, তার মূল আইডিওলজির অংশ। শুধু এভাবেই ডিফেন্সিভ ইমোশনাল প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
এই যুক্তি শেষ অব্দি টেনে নিলে দাঁড়ায়—কনজারভেটিভরা ক্লাইমেট চেঞ্জ, ভ্যাক্সিন, নারী অধিকার ইত্যাদির আইডিয়া আরো সহজে মেনে নিতে পারে, যদি সেটা কোনো ধর্মীয় বা রক্ষণশীল নেতার কাছ থেকে আসে, যিনি এই আইডিয়াগুলোকে এমন ফ্রেমিং এ সাজান যা তাঁর আইডিওলজির সাথে যায়, এবং যা সাধারণত বিজ্ঞানী বা লিবারেলরা ব্যবহার করেন না।
এখন, তর্কের টিপস অ্যান্ড ট্রিক্স জানার পরও, যদি এত জটিল সামাজিক ও মানসিক জিমন্যাস্টিকস করে তর্কে জিততে ইচ্ছা না করে, তাহলে অস্কার ওয়াইল্ডের মত ভাব নিয়ে বলবেন, শুধুমাত্র ইন্টেলেকচুয়ালি লস্ট বা নির্বোধরাই তর্ক করে!
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। সেখানে দুই দেশের সরকার প্রধান জনশক্তি রপ্তানি, জ্বালানি সহযোগিতা, শিক্ষা, পর্যটন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
১ দিন আগেইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে বসবে পরাশক্তি দুই দেশ। কিন্তু স্থান হিসেবে ট্রাম্প কেন আলাস্কাকেই বেছে নিলেন?
২ দিন আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত সোমবার (১১ আগস্ট) মালয়েশিয়ায় যান। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই সফরের মূল লক্ষ্য অভিবাসন সহজ করা এবং বিনিয়োগ নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন করা।
৩ দিন আগেগত ২২ এপ্রিল ভারতের জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার হয়। ওই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয় ভারত। পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছিল।
৩ দিন আগে