leadT1ad

ইউরোপজুড়ে তীব্র তাপদাহেও কেন এসির ব্যবহার এত কম

ঐতিহাসিকভাবেই গরমের সঙ্গে ভিন্ন উপায়ে লড়াই করে আসছে ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯০ শতাংশ ঘরে এসি আছে। অন্যদিকে, ইউরোপে এই সংখ্যা ২০ শতাংশের মতো। জার্মানিতে এই হার মাত্র ৩ শতাংশ। কিন্তু কেন?

তুফায়েল আহমদ
স্ট্রিম গ্রাফিক

ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ তাপপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত। রেকর্ড তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে বহু মানুষ। শুধু দিনের বেলাতেই নয়, রাতেও গরমের প্রভাব কমছে না। কিছু কিছু জায়গায় রাতের তাপমাত্রাও ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামছে না।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, তাপপ্রবাহে অন্তত আটজন মারা গেছেন। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জারি করা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা।

দিন-রাতের এই তীব্র গরম থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। ইউরোপের ঘরবাড়িতে সাধারণত এসি (শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) থাকে না। মানুষ বাধ্য হয়ে বৈদ্যুতিক ফ্যান চালিয়ে, বরফের প্যাক শরীরে ব্যবহার করে কিংবা ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে শরীর ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে।

ঐতিহাসিকভাবেই গরমের সঙ্গে ভিন্ন উপায়ে লড়াই করে আসছে ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য উন্নত দেশে এসির ব্যবহার খুব স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯০ শতাংশ ঘরে এসি আছে। অন্যদিকে, ইউরোপে এই সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশের মতো। আর কিছু দেশে এই হার আরও কম। ইংল্যান্ডের মতো দেশে মাত্র ৫ শতাংশ বাসাবাড়িতে এসি আছে। এদের অনেকেই আবার পোর্টেবল এসি ব্যবহার করে। জার্মানিতে এই হার আরও কম, মাত্র ৩ শতাংশ।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এক ভয়ঙ্কর, দীর্ঘস্থায়ী ও আগেভাগে শুরু হওয়া তাপদাহ অনুভব করা যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ শুধু অতীতের তুলনায় বেশি, এমন নয়। বরং বছরের নির্দিষ্ট গরমের সময়ের আগে শুরু হয়ে দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। এই অবস্থায় অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ইউরোপের ধনী দেশগুলো এসি ব্যবহারে এতটা পিছিয়ে আছে কেন? বিশেষ করে প্রচণ্ড গরমে মানুষের মৃত্যুর ঘটনার পরও।

এই প্রশ্নের উত্তরের একটা বড় অংশই লুকিয়ে আছে ইতিহাসে। ইউরোপের অনেক দেশে বিশেষ করে উত্তর ইউরোপে আগে তেমন গরম পড়ত না। গ্রীষ্মকাল থাকলেও তা সহনীয় মাত্রায় হত এবং দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ হত না বললেই চলে।

তীব্র গরমে বাসস্ট্যান্ডে হাতপাখা দিয়ে নিজেকে ঠান্ডা রাখছেন এক নারী। মাদ্রিদ, ১ জুলাই ২০২৫ ছবি: এএফপি
তীব্র গরমে বাসস্ট্যান্ডে হাতপাখা দিয়ে নিজেকে ঠান্ডা রাখছেন এক নারী। মাদ্রিদ, ১ জুলাই ২০২৫ ছবি: এএফপি

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার ‘অফিস অব এনার্জি এফিশিয়েন্সি অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ট্রানজিশন’-এর প্রধান ব্রায়ান মাদারওয়ে বলেন, ‘ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে ইউরোপে এসি বিশেষ কোনো প্রয়োজনীয় বস্তু ছিল না। ফলে ইউরোপে এসি ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে ওঠেনি।’

ইউরোপে এসি লাগানো ও চালানো—দুটোই খরচসাপেক্ষ। তাই ইউরোপীয়দের কাছে এসি বিলাসের বস্তু ছাড়া কিছু ছিল না।

ইউরোপে এসির ব্যবহারে আরেকটি বড় বাধা ভবনের নির্মাণশৈলী। দক্ষিণ ইউরোপের কিছু দেশে ঘরবাড়ির দেয়াল থাকে মোটা, জানালা ছোট এবং সূর্যের আলো সহজে ভেতরে ঢুকতে পারে না। এ ছাড়া সহজে বাতাস চলাচল করে ঘরকে ঠান্ডা রাখতে পারে, সেই হিসেবেই তৈরি করা হয় ভবন। ফলে এসব অঞ্চলে এসির তেমন প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু ইউরোপের অন্য দেশগুলোর ঘরবাড়ি তাপসহনীয় করার চিন্তা করে নির্মাণ করা হয়নি।

ব্রায়ান মাদারওয়ে বলেন, ‘অতীতে ইউরোপের লোকেরা গরমে ঘর ঠান্ডা রাখার ব্যাপারে ভাবেনি। এটা একেবারেই সাম্প্রতিক ব্যাপার।’

ইউরোপের অধিকাংশ ভবন অনেক পুরনো। এই ভবনগুলো নির্মিত হয়েছে এসি প্রযুক্তি জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগে। ইংল্যান্ডে এই বছরের জুনে রেকর্ড পরিমাণ গরম পড়েছে। কিন্তু ইংল্যান্ডের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ ঘরবাড়িই ১৯ শ সালের আগে তৈরি হয়েছে।

মাদারওয়ে বলেন, এই ধরনের পুরনো ঘরে এসি বসানো কঠিন। তবে একেবারে অসম্ভব নয়।

ভবনের বাইরের দৃশ্য দেখতে খারাপ লাগবে বলে অনেক সময় আমাদের আবেদন বাতিল হয়ে যায়। বিশেষ করে সংরক্ষিত এলাকা বা ঐতিহাসিক ভবনের ক্ষেত্রে এমনটা হয়। -যুক্তরাজ্যের ‘এয়ার কন্ডিশনিং কোম্পানি’র পরিচালক রিচার্ড স্যামন

এসি ব্যবহারে আরেকটা সমস্যা হচ্ছে প্রশাসনিক বিধিনিষেধ। যুক্তরাজ্যের ‘এয়ার কন্ডিশনিং কোম্পানি’র পরিচালক রিচার্ড স্যামন বলেন, ভবনের বাইরের দৃশ্য দেখতে খারাপ লাগবে বলে অনেক সময় তাঁদের আবেদন বাতিল হয়ে যায়। বিশেষ করে সংরক্ষিত এলাকা বা ঐতিহাসিক ভবনের ক্ষেত্রে এমনটা হয়।

এ ছাড়াও রয়েছে নীতিগত বাধা। ইউরোপ ২০৫০ সালের মধ্যে ‘কার্বন নিরপেক্ষ’ হওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এসি ব্যবহারের হার বাড়লে এই লক্ষ্য পূরণে সমস্যা তৈরি হবে। এসি যে শুধু প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ করে এমন নয় বরং ঘরের বাইরে গরম ছড়িয়ে দেয়। প্যারিসে এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসির অতিরিক্ত ব্যবহার আশেপাশের পরিবেশে ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

এই সমস্যা ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে আরও ভয়াবহ। কিছু দেশ আইন করে এসি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ২০২২ সালে শক্তি সাশ্রয়ের জন্য স্পেন ঘোষণা দেয়, সরকারি অফিস ও জনপরিসরে এসির তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা যাবে না।

ইংল্যান্ডের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ ঘরবাড়িই ১৯০০ সালের আগে তৈরি। ছবি: সংগৃহীত
ইংল্যান্ডের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ ঘরবাড়িই ১৯০০ সালের আগে তৈরি। ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর একটি। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ইউরোপ দ্বিগুণ গতিতে উষ্ণ হয়ে উঠছে। সমাধান হিসেবে একদিকে রয়েছে এসি ব্যবহারের স্বল্পকালীন স্বস্তি, অন্যদিকে আছে এসি ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ক্ষতি। ইউরোপের দেশগুলো পড়েছে এক কঠিন দ্বিধায়। যুক্তরাজ্যের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের পরিচালক ইয়েতুন্ডে আবদুল বলেন, ‘আমাদের বাড়িগুলোকে শুধু শীত থেকে নয় বরং নতুন বাস্তবতায় ভয়াবহ গরম থেকেও সুরক্ষা দিতে হবে।’

এর মধ্যেই এসির ব্যবহার ইউরোপে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপে এসির সংখ্যা ২ কোটি ৭৫ লাখে পৌঁছাবে। রিচার্ড স্যামন বলেন, গত পাঁচ বছরে আমাদের কাছে বাসাবাড়িতে এসি লাগানোর উপযোগিতা-সংক্রান্ত অনুসন্ধানের অনুরোধ তিনগুণ বেড়েছে । এই তাপপ্রবাহ এসির চাহিদা আকাশে তুলে দিয়েছে। রাত তিনটায়ও মানুষ গরমে সেদ্ধ হচ্ছে।’

কিছু রাজনীতিবিদ এসি ব্যবহারের পক্ষে আওয়াজ তুলে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার তালে রয়েছেন। ফ্রান্সের ডানপন্থী নেত্রী মারিন লু পেন বড় শীতাতপব্যবস্থা নির্মাণ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি ফরাসি অভিজাতদের সমালোচনা করে বলেন, ‘তাঁরা সাধারণ মানুষকে বিকল্প উপায় খুঁজতে বলেন। নিজেরা এসি গাড়িতে চড়েন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে আরামে কাজ করেন।’

তবে বিশেষজ্ঞেরা সতর্ক করে বলছেন, এসি সাময়িক স্বস্তি দিলেও বেশি শক্তি খরচ করে। আর সেই শক্তির বড় অংশ আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাধিকা খোসলা বলেন, 'এই ধরনের এসি ব্যবহার গ্রিনহাউস গ্যাস বাড়ায়। ফলে চারপাশ আরও গরম হয়, মানুষ আরও বেশি এসি ব্যবহার করে। এতে একটি দুষ্টচক্র তৈরি হয়।’

ব্রায়ান মাদারওয়ে বলেন, ‘গরম বাড়ছে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে এসি নিয়ে ইউরোপীয়দের ভাবনা বদলাচ্ছে। তবে এসির মান, দক্ষতা ও শক্তি সাশ্রয় নিয়ে কঠিন নীতিমালা থাকা উচিত।’

(মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন অবলম্বনে তুফায়েল আহমদ)

Ad 300x250

সম্পর্কিত