leadT1ad

সাদা পাথর লুট

সিলেটের পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে টাস্কফোর্স, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করেও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও অপসারণ কার্যক্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে সভায় উল্লেখ করেন খান মো. রেজা–উন–নবী।

সিলেট বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। স্ট্রিম গ্রাফিক

সিলেট বিভাগের পাথরের কোয়ারিগুলো (পাথর, বালু ইত্যাদি উত্তোলনের নির্দিষ্ট স্থান) ইজারা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা–উন–নবী। গত ২৯ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় কোয়ারি ইজারা দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২৯ এপ্রিল বিকেলে মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ অপারেশন-৩ শাখা একটি সভার আয়োজন করে। বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের ১২১ নম্বর কক্ষে এ সভা হয়। সভার একটি নথি স্ট্রিমের হাতে এসেছে।

সভায় সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর, সিলিকাবালু, নুড়িপাথর, সাদামাটি কোয়ারির ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়। তবে অন্যান্য বিষয় ছাপিয়ে পাথর কোয়ারি নিয়েই আলোচনা এগোয়। আলোচনাসভায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; সিলেট বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা–উন–নবী, সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে টাস্কফোর্স, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করেও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও অপসারণ কার্যক্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে সভায় উল্লেখ করেন খান মো. রেজা–উন–নবী। তিনি বলেন, সিলেটে কর্মক্ষেত্র অনুযায়ী ভিন্ন কাজ নেই। ফলে এই এলাকার লোকজন চুরি করে বা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় সরকারি নিয়ম মেনে কোয়ারি ইজারা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন তিনি।

সম্প্রতি সাদাপাথরে নজিরবিহীন লুটপাট শুরু হয়। স্ট্রিম ছবি
সম্প্রতি সাদাপাথরে নজিরবিহীন লুটপাট শুরু হয়। স্ট্রিম ছবি

সভায় রেজা–উন–নবী বলেন, কোয়ারি ইজারা দেওয়া হলে সিলেট বিভাগের বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। পাশাপাশি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কর্তৃক এই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও অপসারণ কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে।

সভায় রেজা–উন–নবী পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও অপসারণ কার্যক্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পৃথক দল গঠন করে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, তদারকি ও কোয়ারি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করেন।

সিলেট বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা–উন–নবীর মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। বিষয় উল্লেখ করে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোন উত্তর দেননি।

আমরা আমাদের চেষ্টা চালিয়েছি, এখনো চালাচ্ছি। কিন্তু জনগণের পক্ষ থেকে সহযোগিতা না এলে আসলে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়

৮০ ভাগ পাথর সরানো হয়েছে

সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের ৫টি জেলায় গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারির সংখ্যা ৫১। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারা দেশের পাথর কোয়ারি ইজারা, খাস কালেকশনসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ করে সিদ্ধান্ত দেয়। এই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয় চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি। ওই দিন পাথর কোয়ারি ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয়ের কমিটির মতামতের ভিত্তিতে পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।

তবে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা যেমন সিলেটের জাফলং, মামলাভুক্ত শাহ-আরেফিন টিলা এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলার পাহাড়ি ঝিরি-ছড়া এলাকার ১০টিসহ মোট ১২টি পাথর কোয়ারির ইজারা কার্যক্রম বন্ধ রাখার কথা বলা হয়। পরে এ সব কোয়ারির বাইরে ৩৬ টি পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা করে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কাগজেকলমে ইজারা কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও বাস্তবে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণ বন্ধ ছিল না। ২০২০ সালে সরকারিভাবে সিলেট এলাকার পাথর উত্তোলন বন্ধের ঘোষণা করা হলেও অবৈধভাবে চুরি করে পাথর উত্তোলন অব্যাহত ছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট

গণঅভ্যুত্থাণে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপির স্থানীয় নেতারা সিলেটের পাথর কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন। ৫ আগস্ট পরবর্তী আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে একদিকে গোপনে চলে পাথর লুট, অন্যদিকে নেতা-কর্মীরা মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করে সরকারিভাবে কোয়ারি খুলে দেওয়ার চাপ দেওয়া শুরু করে।

বুধবার (১৩ আগস্ট) রাতে প্রায় ১২ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। সংগৃহীত ছবি
বুধবার (১৩ আগস্ট) রাতে প্রায় ১২ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। সংগৃহীত ছবি

খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) জানিয়েছে, ২০২০ সালে পাথর কোয়ারি ইজারা বন্ধ করার পর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিএমডি ও জেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণ পাথর জব্দ করা হয়েছে।

বিএমডি জানিয়েছে, চলতি বছর সিলেটের ধোপাজান বালু মিশ্রিত পাথর কোয়ারি থেকে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৬৮২ ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। লোভাছড়া পাথর কোয়ারির প্রায় ১ কোটি ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়।

এর মধ্যেই গত ২৪ জুন সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন হয়। মানববন্ধনে সিলেটের বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপির নেতারা অংশ নেন। স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা বলছেন, নেতাদের এমন ঐকমত্যে এক বছর ধরে চলা লুটপাটে সিলেটের জাফলংসহ অন্যান্য এলাকার অন্তত ৮০ শতাংশ পাথর সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেটের সদস্য সচিব আবদুল করিম চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার স্ট্রিমকে বলেছেন, ‘কাগজে কলমের নিষেধাজ্ঞা আসলে কাজির গরু, কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। নিষেধাজ্ঞার আগে বা পরে সিলেটে কখনোই পাথর তোলা বন্ধ ছিল না। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর পাথর তোলায় ব্যবসায়ীদের বাড়তি চাঁদা গুনতে হচ্ছে পার্থক্য শুধু এটুকুই।’

গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যেই শত কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ওই সভায় অন্যরা যা বলেছেন

২৯ এপ্রিলের সভায় পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া, রতনপুর পাথর কোয়ারি, গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছানাকান্দি পাথর কোয়ারি এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার ইজারা কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন।

সিলেটে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সংগৃহীত ছবি
সিলেটে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সংগৃহীত ছবি

রিজওয়ানা হাসান সিলেট জেলা প্রশাসককে জাফলং পাথর কোয়ারি-সংলগ্ন এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা প্রনয়ণের কথা বলেন।

সভায় ফাওজুল কবির বলেন, পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন, আহরণ ও অপসারণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু পাথর শ্রমিক ও পরিবহণ চালকদের গ্রেপ্তার করলেই চলবে না বরং মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

সভায় সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, পাথর কোয়ারিগুলোর মধ্যে কয়েকটি সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায়। এ সব কোয়ারি থেকে রাতের আঁধারে পাথর উত্তোলন করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত কোয়ারি পর্যন্ত যেতে যেতে পাথর শ্রমিকেরা পালিয়ে যান। ভ্রাম্যমাণ আদালত স্থান ত্যাগ করলে শ্রমিকেরা নতুন উদ্যমে পাথর উত্তোলন শুরু করে। ফলে পাথর উত্তোলন আটকানো কঠিন হয়ে পড়ে।

কাগজে কলমের নিষেধাজ্ঞা আসলে কাজির গরু, কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। নিষেধাজ্ঞার আগে বা পরে সিলেটে কখনোই পাথর তোলা বন্ধ ছিল না। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর পাথর তোলায় ব্যবসায়ীদের বাড়তি চাঁদা গুনতে হচ্ছে পার্থক্য শুধু এটুকুই। আবদুল করিম চৌধুরী, সদস্য সচিব, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), সিলেট

'জনগণের সহযোগিতা ছাড়া পাথর উত্তোলন বন্ধ সম্ভব না'

২৯ এপ্রিলের ওই সভায় আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসংকটের কথা উল্লেখ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, সিলেট বিভাগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কিছুটা কষ্টসাধ্য। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার ফলে সেখানে ফোর্স মোতায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত জনবল পুলিশ বা বিজিবিতে নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকা বিধায় বিজিবিকে সব সময় সীমান্ত এলাকায় টহল কাজেই ব্যস্ত থাকতে হয়। এছাড়া, পুলিশ বিভাগেও কিছুটা জনবল ও লজিস্টিক সংকট রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান স্ট্রিমকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করার চেষ্টা করা এসেছে। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ পাথর উত্তোলনের সুবিধাভোগীরা সরকারি কাজে বারবার বাধা দিয়েছে।

গত ১৪ জুন জাফলং যান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ সময় পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, সিলেটে পাথর তোলার ‍ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। সেদিনই পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরা সিলেটে দুই উপদেষ্টার গাড়ি আটকে বিক্ষোভ করেন।

এ ঘটনা উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা আমাদের চেষ্টা চালিয়েছি, এখনো চালাচ্ছি। কিন্তু জনগণের পক্ষ থেকে সহযোগিতা না এলে আসলে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত