leadT1ad

ফিরে দেখা ২৯ জুলাই

‘জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না’ এবং লাল রং ধারণের ঘোষণা

২৯ জুলাই ২০২৪। এদিন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। একই সঙ্গে বিক্ষোভে নিহতদের স্মরণে পরদিন অর্থাৎ ৩০ জুলাই দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দেয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এই শোক কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে মুখে লাল কাপড় বাঁধার ঘোষণা দেয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোয় ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে জন্ম নিয়েছে কত না সত্য গল্প। সেসব দিনে ফিরে দেখা।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৩: ২৬
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ। ২৯ জুলাই ২০২৪। স্ট্রিম ছবি

অনেক্ষণ ধরে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন মোহাম্মদ সিফাত (৩১)। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। বারবার রিফ্রেশ বাটন চাপছেন। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে একটা ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শুধু ওই চেষ্টাই সার।

সেদিন ২৯ জুলাই। আগের দিন মোবাইল ইন্টারনেট চালু করেছে সরকার। যদিও জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ আছে। কিন্তু সিফাত কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকতে চাইছেন না। রাজধানীর খিলগাঁও নিবাসী এই যুবক ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করেন। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বাজে অবস্থা দেখে ভেবেছিলেন মোবাইল ইন্টারনেট এলে হয়তো কাজ কিছুটা এগোতে পারবেন। কিন্তু মোবাইল ইন্টারনেটের অবস্থাও তথৈবচ। সাধারণ একটা গুগল সার্চেও কখনো কখনো মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে।

এর একদিন আগে তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি। বরং ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ও কেবল পুড়িয়ে দেওয়ায় ইন্টারনেট বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তবে তাঁর এ কথার সঙ্গে দ্বিমত করেন ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞরা।

জামায়াত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত

২৯ তারিখ গণভবনে বৈঠকে বসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট। বৈঠকের সভাপতি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, জঙ্গি হামলার মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করছে জামায়াত-শিবির। সম্প্রতি তারা দেশকে ‘অস্থিতিশীল’ করে তোলায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

‘জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের মুক্তি ও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে এদিন হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা।

এই রিটের ওপর শুনানির এক পর্যায়ে তৎকালীন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, নিরাপত্তার জন্যই সমন্বয়কদের ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) হেফাজতে রেখেছে। গণমাধ্যমে দেখা গেছে, তাঁরা কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার খাচ্ছেন।

গত বছর ২৯ জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ। স্ট্রিম ছবি
গত বছর ২৯ জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ। স্ট্রিম ছবি

তখন রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘কাউকে আটক করে ডিবি অফিসে নিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছেন, সেসবের ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানান মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি কি জাতির সাথে মশকরা নয়? এটি আপনাদের কে করতে বলেছে? ডিবি অফিসে যাকে ধরে নিয়ে যান, তাকেই খাবার টেবিলে বসান। এভাবে জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না।’

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ শুনানি হয়।

শুনানিতে রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের নামে যা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। রাতে ব্লকরেইড দেওয়া হচ্ছে। ছাত্র আছে কি না, খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ছাত্র থাকলে মুঠোফোন চেক করে। কিন্তু এটা কোন আইনে আছে?’

আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘ছয়জনকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কাউকে নিরাপত্তার স্বার্থে তুলে নেওয়া যায় না। তাঁদেরকে যেন মুক্তি দেওয়া হয় অথবা আদালতের সামনে হাজির করা হয়।’

‘ডিবিতে জোর করে বিবৃতি নেওয়া হয় না’

এদিন দুপুর নাগাদ ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দাবি করেন, জোর করে সমন্বয়কদের থেকে বক্তব্য আদায় করা হয়নি।

হারুন অর রশীদ বলেন, ‘ডিবি একটি আস্থার জায়গা। কাউকে জোর করে সেখানে রাখা হয় না, কারো ওপর অন্যায় অত্যাচার করা হয় না, জোর করে কোনো বিবৃতি নেওয়া হয় না। আমি মনে করি তাঁরা রিয়েলাইজ (অনুধাবন) করেছে। তাঁরা আমাদের কাছে লিখিতভাবে বলেছে যে সরকার তাঁদের দাবি পুরোটাই মেনে নিয়েছে এবং সেই কারণেই তাঁদের যে আন্দোলন, তাঁরা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।’

হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের কবে ছেড়ে দেওয়া হবে সে প্রসঙ্গে হারুন বলেন, ‘আমরা মনে করি তারা শীঘ্রই তাঁদের পরিবারের কাছে চলে যাবে। আমরা তাদের সিকিউরিটির (নিরাপত্তা) বিষয়টা দেখছি।’

কেউ অনিরাপদ বোধ করলে তাঁর নিরাপত্তা দেওয়া তাদের দায়িত্ব বলেও জানান হারুন অর রশীদ।

রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

২৯ জুলাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পরদিন অর্থাৎ ৩০ জুলাই নিহতদের স্মরণে দেশজুড়ে শোক পালন করা হবে। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে হওয়া বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। পরদিন মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। সেইসাথে কালো ব্যাজ ধারণের কথাও বলা হয়।

কিন্তু আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা সরকারের রাষ্ট্রীয় শোককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। তাঁরা সাফ জানিয়ে দেয়, কালো নয়, তারা বরং লাল রং ধারণ করবেন।

পরদিন ৩০ জুলাই। আন্দোলনের লাল সমুদ্র জেগে ওঠার দিন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত